শান্ত সাগরে বিপথগামী রোহিঙ্গারা

কক্সবাজার, দেশের খবর

মুহিববুল্লাহ মুহিব, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কক্সবাজার | 2023-08-22 21:12:34

বঙ্গোপসাগর এখন শান্ত। সাগরে নেই বুক কাঁপানো ঢেউ, নেই মাছ ধরার ট্রলারডুবির খবর। এসব নেই-এর মাঝেও আছে দালালদের নির্যাতন ও সাগরের ফেলে দেওয়ার ভয়! গন্তব্য মালয়েশিয়া হলেও কিছু দূর নিয়ে গিয়ে কক্সবাজারেরই বিভিন্ন এলাকায় যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়ার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। বলছি মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কথা।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারি সত্ত্বেও সাগরপথে মানবপাচার থামানো যাচ্ছে না। উপকূলীয় জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় প্রতিদিনই উদ্ধার করা হচ্ছে মালয়েশিয়াগামী রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুদের।

জানা যায়, জেলে নৌকায় সাগরপথে মালয়েশিয়া পাঠানোর জন্য পাচারকারীরা কক্সবাজারের উপকূলের বেশ কয়েকটি পয়েন্ট ব্যবহার করছে। সেগুলো হলো— টেকনাফের শামলাপুর, শীলখালী, রাজারছড়া, নোয়াখালীপাড়া, জাহাজপুরা, শাহপরীর দ্বীপ, কাঁটাবনিয়া, মিঠাপানির ছড়া, জালিয়াপালং, ইনানী, হিমছড়ি, রেজুখাল, কুতুবদিয়াপাড়া, খুরুশকুল, চৌফলদন্ডী ও মহেশখালী। এ ছাড়া সীতাকুণ্ড ও মাঝিরঘাট এলাকা হয়েও ট্রলারে মানবপাচার হয়ে থাকে।

উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গা নারীরা

মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন স্থানীয়সহ বেশ কয়েক রোহিঙ্গা নেতা। তারা সবাই উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পের বাসিন্দা। এ ছাড়া মালয়েশিয়ায় অবস্থানকারী মানবপাচারকারী কয়েকজন রোহিঙ্গাও এই চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই মাসে কক্সবাজারের বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকা থেকে ২৩৯ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে পুলিশ। এসব ঘটনায় বিভিন্ন দালালের নামে ১৬ মামলা দায়ের করা হয়। আটক করা হয় অন্তত ৪১ জনকে। এছাড়াও সাগরপথ পাড়ি দিতে গিয়ে ট্রলারডুবে নিহত হয়েছে ২১ জন রোহিঙ্গা।

উদ্ধার হওয়াদের মধ্যে, গত শনিবার ভোরে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাচারের প্রস্তুতিকালে টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া কয়েকটি এলাকা থেকে ২১ রোহিঙ্গাকে আটক করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে ১২ নারী ও ৯ পুরুষ রয়েছেন। তারা সবাই বিভিন্ন ক্যাম্পের বাসিন্দা।

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি একই এলাকা থেকে মালয়েশিয়াগামী ৬ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে আটক করা হয়। একই এলাকা থেকে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৭ রোহিঙ্গা নারী-উদ্ধার করা হয়। এছাড়াও মহেশখালী থেকে ২১ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুকে উদ্ধার করা হয়।

উদ্ধার হওয়া নুর বেগম বার্তা ২৪.কমকে বলেন, মালয়েশিয়াতে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। পরিবারের সদস্যরা মিলে আমাকে স্বামীর কাছে পাঠাতে দালালের মাধ্যমে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বৈধপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার কোনো সুযোগ না থাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথেই যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম।

মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গা নারীরা

উদ্ধার হওয়া আরেক রোহিঙ্গা যুবতী সানজিদা বেগম বলেন, মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত রোহিঙ্গা যুবকদের সাথে বিয়ে দিতে দালালরা সুন্দরী যুবতীদের টার্গেট করে বিভিন্ন প্রলোভনের মাধ্যমে মালয়েশিয়া পাচার করছেন। সেটি আমি এখন জানতে পেরেছি।

ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের অতিরিক্ত কমিশনার শামসুদ্দৌজা নয়ন বার্তা২৪.কমকে বলেন, মানবপাচারবিরোধী সচেতনা বৃদ্ধিতে উখিয়া-টেকনাফের প্রত্যেক ক্যাম্পের ইনচার্জকে নির্দেশনা দেওয়া আছে। তারা প্রতিদিন রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন নেতা, মসজিদের ইমামদের মাধ্যমে মানবপাচারবিরোধী প্রচারণা চালান।

এদিকে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ইকবাল হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেন, বিভিন্ন দালাল চক্রের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা প্রথমে ক্যাম্প ছাড়ে। তারপর চলে মালয়েশিয়া যাওয়ার পরিকল্পনা। তবে বেশির ভাগ পরিকল্পনায় নস্যাৎ করে দিয়েছে পুলিশ। উদ্ধার করা হয়েছে অন্তত ২৩৯ জন রোহিঙ্গাকে। মানবপাচার নিয়ে পুলিশ তৎপর রয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত ১১ ফেব্রুয়ারি অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় ১৩৮ যাত্রী নিয়ে একটি ট্রলার সেন্টমার্টিনের দক্ষিণে পাথরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ডুবে যায়। এতে ২১ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়। একই ঘটনায় ৭৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ১৯ দালালকে অভিযুক্ত করে থানায় মামলা করে কোস্টগার্ড। এ মামলায় এ পর্যন্ত নয়জনকে আটক করেছে পুলিশ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর