দেশের প্রথম এলিভেটেড রেললাইনের স্প্যান বসছে উপজেলার সিরাজদিখানের বাসাইল ইউনিয়নের পুলাশপুরে। রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে যাত্রা করে পদ্মা সেতু দিয়ে চলবে যশোর পর্যন্ত। তার জন্য করা হচ্ছে ১৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন। দ্রুতগতিতে চলছে কাজ, বাস্তব হয়ে ধরা দিচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা বহুমুখী সেতু। এ সেতুর ওপরের অংশ দিয়ে চলবে যানবাহন। নিচের অংশ দিয়ে চলবে ট্রেন।
রেললাইনের মধ্যে ২৩ কিলোমিটার হবে এলিভেটেড রেলওয়ে। এটিই দেশের প্রথম এলিভেটেড রেললাইন। ঢাকার জুরাইন স্টেশন থেকে শুরু করে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানের কুচিয়ামোড়া পর্যন্ত হবে এ রেললাইন। এর আওতায় দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নির্মিত হচ্ছে এলিভেটেড রেলওয়ে স্টেশনও। তবে রেললাইন করা হচ্ছে সিঙ্গেল। তবে পরে সরকার চাইলে তা ডাবল লাইনে করা যাবে বলে জানায় সংশ্লিষ্টরা।
পদ্মা বহুমুখী সেতু এবং পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড (সিআরইসি)। গত বুধবার (৪ মার্চ) এ দুটি প্রকল্প এলাকার কাজ সরেজমিনে দেখার আয়োজন করেন। ওই আয়োজনে অংশ নিয়ে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এলিভেটেড রেললাইনের প্রথম স্প্যান বসানো হয়েছে মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার পলাশপুরে। এলিভেটেড রেললাইনের ২৩ কিলোমিটারে এ রকম মোট ৪১৮টি স্প্যান বসানো হবে বলে জানান কর্তৃপক্ষ।
সিরাজদিখানের পলাশপুরে প্রথম স্প্যানের নিচে দাঁড়িয়ে এলিভেটেড রেললাইন করার কারণ ব্যাখ্যা করেন প্রকল্পের কাজ দেখভালের দায়িত্বে থাকা সেনা কর্মকর্তা কামাল। তিনি বলেন, এ এলাকা অনেক নিচু। এখানে অনেকগুলো ব্রিজ রয়েছে। ধলেশ্বরীর শাখা নদী ও অন্যান্য নদী রয়েছে। নদীগুলোর জন্য ব্রিজটা উঁচু করতে হচ্ছে। এটা যেহেতু রেললাইন, তাই হঠাৎ করে উপরে উঠে নিচে নামা যাবে না। একটা স্মুথ লাইন করতে হয় ট্রেনের জন্য। তাছাড়া এখানে যে পরিমাণ সফট সয়েল (নরম মাটি) আছে, তাতে বাঁধ দিয়ে করার চেয়ে এলিভেটেড করলে কম খরচ হবে। সেই সঙ্গে জমির পরিমাণও কমে যাবে। এখানে জায়গার দামও অনেক বেশি। সবদিক বিবেচনা করে এটা এলিভেটেড করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এলিভেটেড রেললাইন এটিই দেশে প্রথম। কেরানীগঞ্জে দেশে প্রথমবারের মতো এলিভেটেড রেলওয়ে স্টেশনও করা হচ্ছে। লাইনটা সিঙ্গেল হলেও ব্রডগেজে করা হচ্ছে।
সাধারণত পরিকল্পনা করা হয় ৬০ থেকে ১০০ বছরের কথা চিন্তা করে। প্রতিনিয়ত ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ট্রেন যোগাযোগ বাড়বে। তাহলে একবারে ডাবল লাইন না করে সিঙ্গেল লাইন কেন করা হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) প্রকৌশলী গোলাম ফখরুদ্দিন এ চৌধুরী বলেন, এক কথায় বলতে গেলে খরচের কারণে করছি না। আমরা ডাবল লাইনের জন্য জমি অধিগ্রহণ করে রাখছি। ভবিষ্যতে এটাকেই ডাবল লাইন করা যাবে। ঢাকা থেকে যশোরে কতগুলো ট্রেন চলবে, এ হিসাবে এখনই ডাবল লাইন করতে চাচ্ছি না। ডাবল লাইন আমরা হয়তো ১৫-২০ বছর পরে করতে পারি। যখন সরকার মনে করবে ডাবল লাইন করা দরকার, তখন এর পাশ দিয়ে আরেকটা করে ফেলবে। জায়গা থাকবে, শুধু ব্রিজ করলেই হয়ে যাবে।
ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে যশোর পর্যন্ত মোট ১৭০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণকাজের এখন পর্যন্ত বাস্তব অগ্রগতি সাড়ে ৩ শতাংশ বলেও জানান গোলাম ফখরুদ্দিন এ চৌধুরী। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতির বিষয়ে তিনি বলেন, এলাকাজুড়েই আমাদের কাজ চলছে। সর্বোপরি আমাদের কাজ প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে মাওয়া থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করছি। এ অগ্রাধিকারমূলক অংশের প্রায় ৫০ শতাংশ কাজ শেষ করতে পেরেছি। ২০২১ সালের জুনে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার কথা রয়েছে। রেলের অগ্রাধিকারমূলক অংশের কাজ শেষ করে পদ্মা সেতুর সঙ্গে রেল চালুর লক্ষ্যে কাজ করছি। এটা আমাদের পক্ষেই সম্ভব।
গোলাম ফখরুদ্দিন এ চৌধুরী বলেন, করোনার কারণে আমাদের কাজের গতি কমে গেছে। কিন্তু থমকে যায়নি। আমরা যে লক্ষ্য স্থির করেছি, সেই লক্ষ্যেই কাজ শেষ করব। সেজন্য আমরা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। চীনে আমাদের প্রায় ১৫০ জন প্রকৌশলী আটকে গেছেন। তাদের পরিবর্তে চীনের যেসব প্রদেশ করোনায় আক্রান্ত নয়, সেসব প্রদেশ থেকে অন্য প্রকৌশলীদের আনার জন্য ইতিমধ্যে প্রক্রিয়া শুরু করেছি। আমরা বেইজিং রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। চিঠিপত্রও লিখেছি যেন তাদের সরাসরি ভিসা দেওয়া হয়। তাহলে করোনার প্রভাবে কাজে যে সাময়িক বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে তা কমবে।
প্রকল্প পরিচালক আরও বলেন, বাংলাদেশে যে কোনো প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ একটা দুরূহ কাজ। সেই কাজ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় দ্রুত সম্পন্ন করতে পেরেছি। তারা (প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান) যে অভিযোগ করেছে, কোনো স্থানে হয়তো একটা মসজিদ অথবা একটা বসতঘর সরাতে দেরি হচ্ছে, সেই প্রসঙ্গ তুলে হয়তো তারা কাজ করতে পারছে না। যখনই তারা সে সমস্যা আমাদের সামনে নিয়ে আসছে, আমরা ত্বরিতগতিতে অ্যাকশন নিয়ে সেই জায়গা পরিষ্কার করে দিচ্ছি।
এদিকে তহবিলের জন্য কোনোদিন কাজ বন্ধ ছিল না বা তহবিলের কোনো সমস্যাও নেই বলে দাবি করেন তিনি। অন্যদিকে গত বুধবার বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং পদ্মা বহুমুখী সেতু ও পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের গতি আনার জন্য চীনাদের অন-অ্যারাইভাল ভিসা দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এতে তারা (আগত প্রকৌশলীরা) করোনার প্রভাব কাটিয়ে এ দুই মেগা প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে পারেন বলেও মতামত দিয়েছেন রাষ্ট্রদূত।
সিরাজদিখান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশফিকুন নাহার বলেন, সরকারের এই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যখনই আমাদের ডেকেছে তখনই তাৎক্ষণিক সেটা করে দিয়েছি। আমাদের দেশের জন্য এই প্রকল্প একটা মাইলফলক । এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে যে কোনোভাবে জড়িত থাকতে পেরে আমরাও গর্বিত। ভালোভাবে কাজটা সম্পূর্ণ হোক এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
সিআরইসির তথ্য মতে, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ভূতাত্ত্বিক জরিপ ও অ্যালাইনমেন্টের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। বাঁধ নকশার কাজ হয়েছে ৮৯ দশমিক ৫ শতাংশ, টেস্ট পাইল ডিজাইন হয়েছে ৯২ দশমিক ৮৫, ওয়ার্কিং পাইল ডিজাইন ৩৭ দশমিক ৩, কালভার্টের ডিজাইন ৬৩ দশমিক ৬, বাঁধ নির্মাণের কাজ ২৫ দশমিক ২, টেস্ট পাইলের কাজ ৬০ দশমিক ৫ এবং ওয়ার্কিং পাইলের কাজ হয়েছে ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ। এ প্রকল্পে এখন পর্যন্ত মোট ১১ দশমিক ৩ শতাংশ অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশের কাছ থেকে সাহায্য ও সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে মাওয়া থেকে ভাঙ্গা (অগ্রাধিকারমূলক) অংশ পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণকাজ আগামী বছর শেষ হবে।