তিন বছর ৬ মাস ১২ দিন আগে ১৫ লাখ টাকা নিয়ে নিখোঁজ হন গাজীপুরের কাপাসিয়ার গরু ব্যবসায়ী আবদুর রশিদ (৩৬)। তিনি রায়েদ ইউনিয়নের টানচৌড়াপাড়া গ্রামের মৃত ছফুর উদ্দিনের ছেলে। তার নিখোঁজের পরদিন ২০১৬ সালের ১১ সেপ্টেম্বর স্ত্রী মোসা. শামসুন্নাহার কাপাসিয়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি নম্বর ৩৬৩) করেছিলেন। কিন্তু নিখোঁজ রশিদের কোনো সন্ধান দিতে পারেনি পুলিশ।
জিডি করার প্রায় চারমাস পর ২০১৭ সালের ২ জানুয়ারি সকালে উপজেলার রায়েদ ইউনিয়নের ভূলেশ্বর বাজারের পশ্চিম পাশের জ্ঞান চন্দ্র মোহন দাসের গজারি বনের গভীরে গাছের নিচে মাথার খুলি, হাড় ও লুঙ্গি এবং গাছের ডালে গেঞ্জি ও টর্চলাইট ঝুলে থাকতে দেখে স্থানীয়রা। এরপর পুলিশে খবর দেয়া হয়। সেদিন নিহতের ছোট ভাই আকরাম হোসেন বলেছিলেন, আলামত দেখে বোঝা যাচ্ছে, খুলিটি তার বড় ভাই আবদুর রশিদের।
কাপড় ও দেহাবশেষ উদ্ধারের দুদিন পর ওই বছরের ৪ জানুয়ারি রাত আটটায় নিজ গ্রামে নিহত আবদুর রশিদের গায়েবানা জানাজা হয়। এরপর উদ্ধার হওয়া খুলি ও হাড় দাফন করা হয়।
অন্যদিকে দেহাবশেষ উদ্ধারের দিনই পরিকল্পিতভাবে হত্যার পর মরদেহ গুমের অপরাধ এনে অজ্ঞাত লোকদের আসামি করে কাপাসিয়া থানায় মামলা (নম্বর ২) করেন নিহতের স্ত্রী। মামলাটি প্রথম তদন্তের দায়িত্ব পান কাপাসিয়া থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) দুলাল মিয়া। বাদীর আবেদনে মামলাটি গাজীপুর ডিবিতে স্থানান্তর করায় তিনি প্রাথমিক তদন্তের বেশি এগুতে পারেননি বলে বার্তা২৪.কমের কাছে দাবি করেন।
বাদী শামসুন্নাহারের অভিযোগ, তার স্বামী আব্দুর রশিদ নিখোঁজের আগে ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর রাত ৯টায় সর্বশেষ স্থানীয় নতুন বাজারের মুদি দোকানদার আব্দুর কাদিরের সঙ্গে কথা বলেছেন। এরপর থেকেই রশিদের আর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না।
বাদীর দাবি, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকায় প্রথমে তিনি এজাহারে আসামিদের নাম উল্লেখ করতে পারেননি। পরে তিনি সন্দেহভাজন ৬ জনের নামে কাপাসিয়া থানায় সম্পূরক এজাহার দিলেও সেটি গ্রহণ করেননি ওসি।
পরে তিনি ২০১৭ সালের ৩১ জুলাই গাজীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সম্পূরক এজাহার দাখিল করলে আদালত সেটি আমলে নেন।
সম্পূরক এজাহারের আসামিরা হলেন- ভূলেশ্বর গ্রামের মৃত ফাইজ উদ্দিন সিকদারের ছেলে মো. হারুন অর রশিদ ও তার ভাই মো. রেহান উদ্দিন সিকদার, বড়হর গ্রামের মৃত ওয়াজ উদ্দিনের ছেলে আমরাইদ বাজারের বিকাশ এজেন্ট মো. মোকলেছুর রহমান, ভূলেশ্বর নতুন বাজারের দোকানদার দেওনা গ্রামের মৃত অহেদ আলীর ছেলে মো. আব্দুল কাদের, ভূলেশ্বর গ্রামের মমতাজ উদ্দিনের ছেলে মো. নজরুল ইসলাম মাস্টার ও একই গ্রামের মৃত পারহা কাদিরের ছেলে মো. হাদিকুল ইসলাম।
এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, পরিকল্পিতভাবে এই ৬ জন মিলে ব্যবসায়িক ও লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়ে তার স্বামীকে হত্যার পর মরদেহ গুম করতে গজারি বনে ফেলে দেয়। তারাই আব্দুর রশিদকে হত্যা করেছে বলে এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে।
এমনকি সম্পূরক এজাহার জমা দেয়ার আগে অভিযুক্তরা বিষয়টি নিয়ে আইনের দ্বারস্থ না হতে বাদীর স্বজনদের বিভিন্ন সময় হুমকি প্রদান শুরু করে। উপায় না পেয়ে ২০১৭ সালের ১৮ মার্চ কাপাসিয়া থানায় আসামি মো. হারুন অর রশিদ ও তার ভাই মো. রেহান উদ্দিন সিকদারের নামে সাধারণ ডায়েরি (জিডি নম্বর ৭১৯) করেন বাদী নিজেই। পুলিশ জিডির অভিযোগ তদন্ত করেনি বলে শামসুন্নাহারের অভিযোগ।
ডিবির তৎকালীন এসআই মিঠু শেখ প্রায় দেড় বছর তদন্ত করেও হত্যার রহস্য উন্মোচন করতে পারেননি। পরবর্তীতে মামলাটি যায় অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি)। গাজীপুর সিআইডির পরিদর্শক শহিদুল্লাহ শহীদ প্রথমে মামলাটি তদন্ত করেন। এরপর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির আরেক পরিদর্শক মো. মোজাম্মেল হক। সিআইডির দুজন কর্মকর্তা মামলাটি দেড় বছরের বেশি তদন্তের পর মামলাটি যায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে। বর্তমানে পিবিআইয়ের এসআই মো. সানোয়ার হোসেন মামলাটি তদন্ত করছেন। পাঁচবার তদন্ত কর্মকর্তা বদল হলেও এই হত্যা মামলাটি আলোর মুখ দেখেনি।
গাজীপুর ডিবির তৎকালীন এসআই মিঠু শেখের সঙ্গে দুদিন চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। জানতে চাইলে গাজীপুর অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক শহিদুল্লাহ শহীদ বার্তা২৪.কমকে বলেন, তিনি মামলাটি শেষ পর্যন্ত তদন্তের সুযোগ পাননি। তাই অসম্পূর্ণ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চান না।
একই বিষয়ে সিআইডির আরেক তদন্ত কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক বার্তা২৪.কমকে বলেন, হত্যার ঘটনাটি সত্য। কিন্তু সাক্ষী, প্রমাণ বা আলামত সেইভাবে পাওয়া না যাওয়ায় আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট বা চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। আমার আগের তদন্ত কর্মকর্তারা উদ্ধার হওয়া আলামত ফরেনসিক ল্যাবে পাঠিয়ে পরীক্ষা করেছেন।
মামলাটির রহস্য কেন উন্মোচন করতে পারেননি প্রশ্নে তিনি বলেন, অনেক চেষ্টা করেছি। পূর্বের তদন্তকারীরাও চেষ্টা করেছে। এখনও পিবিআই চেষ্টা করছে। কিন্তু সেরকম কোনো আলামত না পাওয়ায় অগ্রসর হওয়া যায়নি। নিহত আব্দুর রশিদকে- কে, কোথায় ও কিভাবে নিয়ে গেছে সেই ধরণের কোনও সাক্ষী প্রমাণও পাওয়া যায়নি।
সম্পূরক এজাহারের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি একজনকে হেফাজতে, রিমান্ডে নিয়েছি। বিভিন্ন কৌশলে জিজ্ঞাসাবাদ করেও সুস্পষ্ট বা সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য তার কাছে পাওয়া যায়নি।
মামলাটি আদৌ আলোর মুখ দেখবে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, সিআইডি সব সময়ই ক্লু-লেস মামলাগুলোকে সিরিয়াসলি তদন্ত করে। হয়ত কোনোটা আলোর মুখ দেখে, কোনোটা দেখে না। পুলিশ তো আর ফেরেশতা না- যে চাইলেই অনুমান করে সব বের করতে পারব। আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করেও পারিনি। এটি আমাদের দুর্ভাগ্য।
তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে পিবিআইর এসআই মো. সানোয়ার হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেন, সিআইডি ফাইনাল রিপোর্ট দেয়ার পর বাদীর নারাজিতে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছি। তদন্ত করছি, সোর্স নিয়োগ করেছি। এখনই কিছু বলা সম্ভব নয়।
আগেও দুজন পরিদর্শক ও দুজন এসআই ব্যর্থ হয়েছে আপনি রহস্য উদঘাটন করতে পারবেন কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, চেষ্টা করে দেখি। এখন পর্যন্ত কাউকে হেফাজতে নিতে পারিনি।
নিহতের ভায়রার ছেলে মো. সেলিম ফরাজী বার্তা২৪.কমকে বলেন, তিনি ছাড়া তাদের স্বজনদের মধ্যে শিক্ষিত কেউ নেই। তাই এতো বছর ধরে তিনিই মামলাটি তদারকি করছেন।
মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্ত কর্মকর্তারা আন্তরিক হলে আমাদের সহযোগিতায় হত্যার রহস্য উদঘাটনের পর অনেক আগেই আসামিদের আইনের হাতে সোপর্দ করা যেতো। কিন্তু কোনও তদন্ত কর্মকর্তাই আন্তরিক নন।
তিনি বলেন, আসামিদের কাছ থেকে তদন্ত কর্মকর্তারা অনৈতিক সুবিধা নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। কেননা সিআইডির পরিদর্শক মোজাম্মেল হক সম্পূরক এজাহারের বাইরেও জ্ঞান চন্দ্র মোহন দাসের ছেলে শাওন ওরফে সম্পদকে গ্রেফতারের পর রিমাণ্ডে নিয়েছিল। সে ৩ মাসের মতো জেলও খেটেছে। এ ছাড়াও মামলার চার নম্বর আসামি আব্দুল কাদেরকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়েছিলেন সিআইডির পরিদর্শক শহিদুল্লাহ শহীদ। কাদের প্রায় ৫ মাস জেল খেটে হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন। তবে মামলার মূল আসামি হারুনকে হেফাজতে নেয়নি পুলিশ। তাকে গ্রেফতার না করার বিষয়ে প্রতিবারই তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন উপর মহল থেকে তাদের উপর চাপ আছে।