বুকের পাঁজরে কাশফুল

গল্প, শিল্প-সাহিত্য

হাসান অরিন্দম | 2023-09-01 21:14:44

শনিবার সকাল পৌনে দশটার দিকে নাস্তা সেরে টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে বারন্দায় বসে খবরের কাগজ উল্টাচ্ছিলাম, কার কাছ থেকে যেন কানে খবর উড়ে এলো টিপু সুলতানকে কাল সন্ধ্যা থেকে কোত্থাও পাওয়া যাচ্ছে না। হতে পারে রাস্তার পথচারীরাই বলা-কওয়া করছিল। ১১ বছরের টিপু সুলতান আমার আপন কেউ নয়, কাজেই উদ্বেগ যতোটা না, কৌতূহল ও অনুসন্ধিৎসা বরং তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল। আমি ওকে বোধ হয় প্রায় আট বছর ধরে দেখে আসছি। ওর মায়ের ভাষ্যমতে জন্মের বছর-দুই পরে পায়ে কাঁটা ফুটে গ্যাংগ্রিনের লক্ষণ দেখা দেয়। তখন থেকেই কবিরাজ, ওঝা, হোমিওপ্যাথের পিছনে ছুটে কোনো ফল এলো না। আজকাল গায়ে সারা দিনরাত জ্বর থাকে, খেতে গেলে বমি পায়, প্রায়ই যন্ত্রণায় কাতরায়; তবে কারো প্রতি কোনো অভিযোগ তার নেই। পাড়ার লোকেদের কেউ কেউ বলল ও ছেলের ক্যান্সার, বাঁচবে না বেশি দিন। পরে টিপু সুলতানের যখন সাড়ে দশ বছর বয়সে সার্জারির ডাক্তারের কাছে গেল জবা আর ওর স্বামী, তখন ডাক্তার বলল ছেলেকে বাঁচাতে গেলে পুরো পায়ের পাতাটা কেটে ফেলতে হবে, সেটার আবার বায়োপসি না কি, তাও করা লাগবে। আরো আশঙ্কার কথা এতোদিন কেবল বাম পায়ে ক্ষত রক্ত আর লালচে কষানি ছিল, এখন ডান পায়ের তলায়ও লক্ষণটা দেখা দিয়েছে। যদিওবা এক পায়ে ভর দিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে বেশ হাঁটতো এখন লাঠি ছাড়া এক পা-ও এগোতে পারে না। জবা চার-চারটে সন্তানের মা, কাজেই একটাকে নিয়ে তার সারাদিন হা-হুতাশ করে বসে থাকবার ফুরসত নেই। ওদের অকালবৃদ্ধ হাড্ডিসার বাপও বছর দশেক হলো শ্বাসকষ্টের রোগী। দুদিন ভ্যানটা নিয়ে বেরোয় তো তিনদিন ভাঙা চালের দিকে তাকিয়ে ঘরে শুয়ে ‘ও আল্লাহ ও আল্লাহ’ বলে ছালওঠা বুড়ো কুকুরের মতো কাতরায়। কাজেই জবাকে কখনো কখানো জুটমিলে কখনো তামাকের ফ্যাক্টরিতে গতর খাটিয়ে ছেলেমেয়েগুলোর মুখে ভাত জুটাবার ব্যবস্থা করতে হয়। গা-গতর এখনো বেশ আঁটোসাঁটো বলে চকচকে নোট দেখিয়ে অনেক পুরুষই নিভৃতে পাওয়ার ইশারা করলেও জবা আজ অবধি সে-সব ইঙ্গিত পদদলিত করে চলতে পেরেছে। তার নিজেরও আশঙ্কা হয় কবে না আবার সংযমের মিহি সুতোখানা ছিঁড়ে যায়। দুএকবার যে মনে হয়নি গায়ে সুগন্ধীমাখা কোনো পুরুষের ডাকে সাড়া দিয়ে কুড়ি মিনিট জাপ্টাজাপ্টি করে দুতিন শ টাকা আয় করে আনবে—এমনও নয়। ঘরের মিনশের তো শরীরে কিছু নেই আবার তেজের বেলায় ষোলো আনার জায়গায় আঠারো আনা। একদিক দিয়ে ভাগ্যটা খানিক ভালো জবার, বড় মেয়ে জুলেখাকে বছর তিনেক আগে এক হোটেল কর্মচারীর সাথে বিয়ে দিয়েছে, সেখানে মেয়েটা দুবেলা খেয়ে মোটা কাপড় পরে দিব্যি দিন পার করে দিচ্ছে, সপ্তাহে কি মাসে জামাই একবার বৌকে পিটালেও সেটা আমলে নেয়ার প্রয়োজন বোধ করে না জবা। টিপু সুলতানের মায়ের যখন কোথাও কাজ থাকতো না প্রায়ই আমাদের বাড়িতে এসে ছেলেটাকে বাইরের বারান্দার মেঝেতে শুইয়ে রেখে নিজে যেচে আমার স্ত্রীর কাপড় কাঁচা, ফার্নিচার, গ্রিল, জানালার গ্লাস মোছা—এসব কাজ করে দিতো। তিন বছরের টিপু সুলতান বড় বড় দুটি চোখ নিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে দেয়ালে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে থাকতো। খানিক বাদে ওর মা একটা শুকনো রুটি হাতে দিয়ে গেলে সেটা প্রসন্ন চিত্তে চিবোতে থাকতো। ওর পায়ের রক্ত-কষানি দুএক ফোঁটা মেঝেতে পড়লে যাওয়ার সময় জবা স্যাভলন দিয়ে যত্ন করে পরিষ্কার করে রেখে যেতো।

চারটে সন্তানের মধ্যে ও-ই সবচেয়ে ফরসা গয়ের রঙ আর প্রায় নিখুঁত চেহারা নিয়ে জন্মেছিল। টানা টানা চোখ টিকল নাক দেখলে মনে হতো কোনো অভিজাত ঘরের শিশু, নিশ্চয়ই বড় হয়ে নামকরা কেউ হবে। তাই জবার স্বামী ছেলের রাজপুত্তুরের মতো চেহারা দেখে আকাশ সমান স্বপ্ন নিয়ে নাম রেখেছিল রাজা-বাদশার নামের সাথে মিলিয়ে। কিন্তু তিন বছর না-হতেই পায়ের তলায় পচনের আভাস তাদের হৃৎপিণ্ডকে ক্রমে চুরমার করে দিতে থাকে। ওর পা দেখে বিভিন্ন জন নানান কথা বলতো। জবা লোকের পরামর্শে তার সাধ্যের মধ্যে সবকিছুই করবার চেষ্টা করেছে। কখনো ফকির-কবিরাজ, কখনোবা সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার। মাঝে মাঝে কিছু উন্নতির লক্ষণ—পায়ের কষানি বন্ধ হওয়া, ঘায়ে টান ধরা দেখে জবার মনে আশার আলো জ্বলতো। কিন্তু আবার হয়তো দুতিন মাস না-যেতেই আগের অবস্থা কিংবা আরো অবনতি।

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জন যেদিন দেখলেন ততদিনে টিপু সুলতানের বয়স সাড়ে দশ পেরিয়েছে। ডাক্তার রেগেমেগে বললেন, ‘তোমাদের নিয়ে বড় যন্ত্রণা, এই সাত-আট বছর কী করেছো? এখন ছেলেকে বাঁচাতে হলে দুটো পায়ের পাতাই কেটে ফেলতে হবে। এর মধ্যে ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে কিনা সেটাও বায়োপসি করে যাচাই করতে হবে।’

ফিরবার সময় কলা-পাউরুটি কিনে ছেলেকে নিয়ে ঘামের গন্ধঅলা মানুষের ভিড় ঠেলে বাসে উঠে জবা আর ওর স্বামী। টিপু সুলতান সকাল থেকে কিছুই মুখে নেয়নি। বেলা প্রায় দুটো বাজে, কলা-পাউরুটির কিছুই সে স্পর্শ করে না। ছেলের শুষ্ক বিরস মুখের দিকে তাকিয়ে জবা বলে, ‘খা বাবা খা।’

কিছুক্ষণ বাইরে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে, তারপর হঠাৎ টিপু সুলতান হাউমাউ করে কেঁদে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘মা, পা ক্যাটে ফেললি আমি হাঁটপো কিরাম করে? আমি আরো ভাবছিলাম পা ভালো হলি আমি ফুটবল খেলতি পারব।’ ছেলের কথা শুনে জবাও চোখের জল আটকাতে পারে না। জবার স্বামী তখন একটা বিড়ি ধরানোর খুব তাগিদ বোধ করলেও ভিড়ের মধ্যে লোকের ধমকের ভয়ে বিড়িতে আগুন জ্বালাতে সাহস হয় না তার।

রাতে বড়বোনের পাশে নড়বড়ে চৌকিতে শুয়ে টিপু সুলতানের ঘুম আসে না। মনে হয় বুকের ভেতর শ্বাসটা কোথায় যেন কুণ্ডলি পাকিয়ে যাচ্ছে। বার বার এপাশ-ওপাশ করতে করতে শুনতে পায়, মেঝেতে শোয়া বাবা-মা তাকে নিয়েই শলাপরামর্শ করছে। এই ছেলে কি তবে ভিক্ষে করে খাবে? অপারেশন করার টাকা কীভাবে জোগাড় করা যায়—এইসব। টিপু সুলতানের কিছুতেই ঘুম আসছিল না। তার কেবলই মনে হচ্ছিল আচ্ছা আজ রাতে সে যদি মরে যেত তো কেমন হতো? বাবামা আর ভাইবোনেরা খুব কাঁদবে তাহলে সকালে? কাল সারাদিন? তারপর আরো কিছুদিন থেকে থেকে—তারপর একদিন কেউ আর কাঁদবে না। কেবল গোরস্থানের পথ ধরে যাওয়ার সময় শিরিষ গাছে নিচে দুদণ্ড দাঁড়িয়ে মায়ের চোখজোড়া ভিজতে থাকবে বহুকাল। টিপু সুলতান কিছুদিন মক্তবে পড়তে গিয়ে লম্বাটে হুজুরের কাছে শুনেছিল মৃত্যুর পর পাপীদের কী ভয়ঙ্কর শাস্তি ভোগ করতে হয়। দোজখে কেবল সাপবিচ্ছুর দংশন, পায়ে পরানো হবে আগুনের বেড়ি, খেতে হবে কাঁটাগাছ আর রক্ত-পুঁজ। সে হিসেব করে দেখে এই জীবনে তার কিছু পাপ আছে। আব্বার পকেট কিংবা মায়ের কৌটা থেকে না-বলে পয়সা সরিয়ে রেখে সে চকোলেট, আইসক্রিম, চিপস কিনে খেয়েছে। এর-ওর গাছ থেকে কিছু ফল পেড়েছে, চুরি করেছে। ভাইবোনদের সাথে ঝগড়া-মারামারি করেছে। মায়ের কথা শোনেনি ঠিকমতো। এসব পাপের জন্য আল্লাহ কি তাকে দোজখে রাখবেন? তা হোক, পুড়বে না হয় দোজখে কিছুকাল। কিছুদিন পর পাপমুক্ত হতে পারলে তো অনন্ত শান্তির দেখা মিলবে। সেখানে মানুষের খিদে আছে, খাদ্য আছে; কিন্তু মলমুত্রের মতো বিরক্তিকর ব্যাপার নেই। মানুষের রোগ নেই, নেই ডাক্তার। পচা পায়ে যন্ত্রণা নিয়ে আর বাঁচতে ভালো লাগে না। মানুষের দুটো পা-ই যদি না থাকল, ইচ্ছেমতো ছুটতে না পারল, দেখতে না পারল চারপাশ—তার জীবনের কী দাম আছে?

আমি যখন জানলাম টিপু সুলতানকে পাওয়া যাচ্ছে না তখন মনে মনে অনুসন্ধান করতে থাকি ও কীভাবে হারাতে পারে। প্রথমেই আমার মনে হয় নদীর কথা। ওরা যেখানে থাকে তার ষাট-সত্তর গজ দূরেই তো নদী। নদীটা মরা অথচ ওতেই প্রতি বছর দুএকজন লোক ডুবে মরে। ছমাস আগে জুলেখা নামের গর্ভবতী এক যুবতী নির্জন দুপুরে গোসল করতে গিয়ে তলিয়ে যায়। অথচ জুলেখা দিব্যি সাঁতার জানতো—বালিকা বয়স থেকেই এই নদীতেই চিৎসাঁতার ডুবসাঁতার দিয়ে বড় হয়েছে সে। তাই লোকে বলছিল ওসব ভূতের কাণ্ড, গেছো ভূত কিংবা মেছো ভূত ওকে নির্জনে পেয়ে পানিতে চুবিয়ে মেরেছে। একবার মনে হয় ছেলেধরার হাতে পড়লো নাকি টিপু সুলতান? নাকি রাগ করে বাড়ি ছেড়েছে? তখন মনস্থির করি, বাড়িতে বসে সাত-পাঁচ না ভেবে বরং একবার সরজমিনে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসা যায়, আমার আর বিশেষ কাজ কী। তাছাড়া জবা আমাদের আপনজন বলেই জানে। শহরের শেষ প্রান্তে যেখানে গ্রাম এলাকা শুরু নদীর কাছে টিপু সুলতানদের বাড়িতে পৌঁছে যাই আধ ঘণ্টার মধ্যে। জবা উঠোনে বসে নানান কথা বলতে বলতে কাঁদছে, ওর চোখে জল শুকনোর দাগ। ওর স্বামী লোকজন নিয়ে হন্যে হয়ে রাস্তাঘাটে খোঁড়া ছেলে খুঁজে বেড়াচ্ছে। প্রতিবেশিরা আমাকে জানায় ওরা রাতে ঘুমিয়ে ছিল, ভোর বেলা ঘরের দরজা খোলা দেখে জবার সন্দেহ হয়, এবাড়িতে তার আগে তো কেউ জাগে না। সে তখনই খেয়াল করে টিপু সুলতান বিছানায় নেই। ঘরে নেই, উঠোনে নেই। আম বাগান, নদীর ধার, প্রাইমারি ইস্কুলের মাঠ, বটতলা বাজার কোত্থাও না।

জবা আমাকে দেখেও খানিক নির্বাক ছিল। হঠাৎ সে ফ্যাঁসফেঁসে কণ্ঠে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। ‘মামা, আমার টিপুর কাইল অপারেশন হওয়ার কথা ছিল, আইজ ভোরেরতে সে ছেলে উধাও। আমি এখন কী করব কতি পারেন?’ কোন সুবাদে যেন জবা আমাকে ‘মামা’ বলে ডাকে আর ওর ছেলেমেয়েরা ‘ভাইয়া’।

‘তুমি অতো ভেঙে পড়ো না। পা কাটার কথা শুনে মনে হয় ভয় পেয়েছে। কোথাও লুকিয়ে আছে দেখো ঠিকই চলে আসবে। দুটো দিন ধৈর্য্য ধরো।’

আমি নিশ্চিত নই টিপু সুলতান আদৌ ফিরে আসবে কিনা। ও বেঁচে আছে না মরে গিয়েছে, তবু মনগড়া সান্ত্বনা দিই জবাকে।

ও আমার পা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আপনি চিষ্টা করলি পারবেন। আপনি এ এলাকার নামকরা সাংবাদিক—ডিসি এসপি সবার সাথে জানাশুনা। আমার টিপু সুলতান ছাড়া আমি বাঁচপ কীরাম করে মামা?’

২.
আমি অভিজাত হাসপাতালটির ফটক থেকে দ্রুত পদক্ষেপে বেরিয়ে একটা চকচকে ট্যাক্সি ডাক দিই। যুবক ড্রাইভার বাম দিকের গ্লাস নামিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘স্যার কোথায় যাবেন?’
‘দূরে, শহরের বাইরে কোথাও। যাবেন?’
‘যাব, কিন্তু সিটি করপোরেশনের বাইরে গেলে যে ডাবল ভাড়া লাগবে স্যার।’
আমি ‘দেব’ বললে ড্রাইভার দরজা মেলে ধরে, আমি গা এলিয়ে সিটে বসে পড়ি।
গাড়ি বিশ্বরোডের কাছে এলে যুবক বলে, ‘স্যার, টঙ্গির দিকে যাব?’
‘যান। আমরা টঙ্গি, চৌরাস্তা পেরিয়ে ময়মনসিংহ রোড ধরব।’

আজ শুক্রবার আর ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে বলে রাস্তায় জ্যাম বেশ কম। বসুন্ধরার নিউলাইফ হসপিটাল থেকে পঁচিশ মিনিটেই গাড়ি টঙ্গি পেরিয়ে যায়। চৌরাস্তা অতিক্রম করে আরো খানিক বাদে শহরের কোলাহল পেছনে ফেলে এলে গভীর বিষণ্নতার মধ্যেও মনের উপরিতল খানিকটা ফুরফুরে হয়ে ওঠে। ড্রাইভারকে বলি, ‘আপনার গাড়িতে গান নেই?’
যুবক সসংকোচে বলে, ‘আপনাদের শোনার মতো গান নেই স্যার।’
‘কী বলেন? শুধু নিজের দিকে খেয়াল দিলে হবে—যাত্রীদেরও তো একটা দাবি থাকতে পারে, না?’
‘স্যার, লালনের গান শুনবেন?’
‘শুনব তো, ছাড়েন। তবে যে বললেন সে-রকম গান নেই!’
যুবক ড্রাইভার রিমোট চাপ দিলে কয়েক সেকেন্ড পরে বেজে ওঠে—
বেদ বিধির পর শাস্ত্র কানা/ আর এক কানা মন আমার/ এসব দেখি কানার হাটবাজার।। এক কানা কয় আর এক কানারে/ চল এবার ভব পারে।/ নিজে কানা পথ চেনে না/ পরকে ডাকে বারংবার।। পণ্ডিত কানা অহংকারে/ সাধু কানা অনবিচারে/ মোড়ল কানা চোগলখোরে/ আন্দাজে এক খুঁটি গেড়ে/ জানে না সীমানা কার।

গানটা শুনতে শুনতে আমার মনের উপরিতল আবার বিষণ্ন হয়ে ওঠে। সে-বিষণ্নতা চেতনার গভীরতল, মগজ ও রক্তকণিকায় ছড়িয়ে পড়ে। তখন আমার মনে হয়—সত্যিই কি পৃথিবী কানার হাটবাজার, আসলে কেউ কিছু জানে না? বস্তুত ওয়েটিং ফর গডো? তাহলে এখন এই ঘূর্ণিঝড়ের পরিস্থিতিতে অগ্রপশ্চাৎ না-ভেবে আমার কী করা উচিৎ? আমি এই গাড়িটাকে আরও ত্রিশ-চল্লিশ কিলোমিটার বা তার চেয়ে বেশি পথ উত্তর বরাবর নিয়ে যাব। তারপর ড্রাইভারকে পাওনা বুঝে দিয়ে নাম না জানা গ্রামের নির্জনতায় নদীর তীরে নেমে পড়ব। নদীর তীরে কার যেন একটা ডিঙি নৌকা বাঁধা। নৌকার পানি সেচে আমি তাতে উঠে বৈঠা দিয়ে কূলে ধাক্কা দিয়ে ঘোলা জল কেটে নৌকা ছাড়ব। আমি যদিও বলেছি অগ্রপশ্চাৎ ভাবনা বাদ দিয়ে—বস্তুত আমি চেতনে-অবচেতনে দ্রুত অনেককিছু ভেবে তবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি।

কদিন পরপর সামান্য জ্বর আসছিল। প্যারাসিটামল খাই, কিছু দিন ভালো থাকি, আবার জ্বর। পরে আমার ডাক্তার একটি বড় প্রাইভেট হাসপাতালে প্রফেসরের কাছে রেফার করেন। ঢাকাতে অনেক আত্মীয়-স্বজন থাকলেও এই বয়সে কারো বাড়িতে গিয়ে উঠতে মন চায় না। আমি এয়ারপোর্টের কাছে একটা হোটেলে গিয়ে উঠি। দুটো দিন রক্ত, এক্স রে, বোন ম্যারো ইত্যাদি নানার রকম টেস্টের জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে হলো। ডাক্তার আমাকে স্পষ্ট করে না বললেও আমি বুঝতে পারি তিনি আমাকে যে ধরনের ইনভেস্টিগেশন দিচ্ছেন তাতে তার ধারণা আমি লিম্ফোমার প্যাশেন্ট। আজকে দুপুর আড়াইটাই ব্লাড টেস্ট হাতে পেয়ে আমি নিশ্চিত হই ডাক্তারের আশঙ্কাই সত্যি। ইন্টারনেট ঘেটে বুঝে নিই এটা তৃতীয় স্টেজ। এই পর্যায়ের রোগীর ভালো চিকিৎসা এদেশে নেই। দেশের বাইরে মানে সিঙ্গাপুর বা ব্যাংকক গেলে আমার জমানো টাকা মাসখানেকও টিকবে না। এবছর একমাত্র ছেলেটা আইএসসি পাশ করল। ওর যা রেজাল্ট, আমরা জানি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের যোগ্যতায় চান্স পাবে না। ওর মা তিল তিল করে এতো বছর ধরে ছেলেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবে বলে কুড়ি লাখের মতো টাকা জমিয়েছে। আমার এই অসুখের কথা শুনলে সুহিতা উদ্বিগ্ন হয়ে সব টাকা আমার হাতে তুলে দেবে। প্রেসের ব্যবসায় দীর্ঘদিন লস খেয়ে জেলা শহরে চার কাঠার ওপর পৈতৃক বাড়িটা ছাড়া আর কোনো সম্পত্তি আপাতত আমার নেই। আমার নিজের সম্পাদিত একটি সুপরিচিত সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল সেটা বন্ধ হয়েছে বছরখানেক। এই বয়সে বাড়িটা বিক্রি করার মতো অবিমৃশ্যকারিতা আমি দেখাতে চাই না। তাছাড়া বাড়ি বেচলেও আমার সুস্থ হবার সম্ভাবনা তেমন নেই, মিথ্যে আশা বুকে নিয়ে অচল গাড়ির পেছনে পয়সা ঢালার মতো স্বার্থপর আমি নই। জ্বর, ওজন কমা, অরুচি, বমিভাব, মাথার ভেতরে চক্কর, বিমর্ষতা—সব লক্ষণই আমি বহন করছি বেশ আগে থেকেই। ফলে রিপোর্ট হাতে পেয়ে আমি অটল সিদ্ধান্ত নিই আমার হেমাটোলোজিস্ট সুরিয়া কান্তি সিনহার সঙ্গে আর সাক্ষাৎ নয়, এবার বরং নিরুদ্দেশ হই। আজ হোক কাল হোক, সবাইকে তো ত্যাগ করতেই হবে। তখন কেন যেন মাসখানেক আগে হারিয়ে যাওয়া টিপু সুলতানের কোমল মুখটি আমার মনে ভেসে ওঠে।

দুপাশে শাল আর গজারি গাছের সারির ভেতর দিয়ে কালো রঙের এলিয়ন গাড়িটি আশি কিলোমিটার বেগে ছুটে চলেছে। আরো মিনিট চল্লিশেক পরে গাড়িটাকে রাস্তার ডান দিকে কোথাও রাখতে বলব। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বড় রাস্তা থেকে নেমে খানিক মেঠো পথ ধরে সন্তর্পণে হেঁটে একটা ছোট নদীর দেখা পাব। নদীর দুপাশে সবুজ ধানক্ষেত। আমি কিছুক্ষণ আনমনে দাঁড়িয়ে থাকব, দেখব শরতের বাতাসে কীভাবে তীক্ষ্ণ সবুজ পাতারা দোল খায়। সেখানে কীভাবে চলে আলোছায়ার খেলা। আশ্চর্য, এই বিকেল বেলা নদীর তীর ও বিস্তৃীর্ণ মাঠ জুড়ে কোনো জনমানুষের টিকি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। তবে দৃষ্টিসীমার ভেতর অজস্র পাখি কলকাকলি করে বেড়াচ্ছে। নদীর জলে দেখছি কতক মাছ—চাঁদা, ডানকিনা, তিতপুঁটির ঝাঁক। এমন সময় আমার চোখে পড়বে নদীর কূলে একটা নৌকা বাঁধা। আনাড়ী হাতেও নৌকা বেয়ে ছোট নদীটি পেরুতে দশ মিনিটের বেশি লাগবে না। নদী পেরুতে বৈঠা মেরে আমি ঘেমে উঠব। শার্টের দুটো বোতাম খুলে দিয়ে বাবলা গাছটার তলায় বসে খানিক বাতাস গায়ে মাখব। সে-সময় হঠাৎ ধানখেতের পাশে একটা ঘাসের জমিনে প্রথম একজন মানুষের দেখা পাব। উচ্ছল ছেলেটা আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে বলবে, ‘ভাইয়া, আপনি এখানে?’
আমি অবাক হয়ে বলব, ‘আরে টিপু সুলতান তুই। ওদিকে তোর জন্য কেঁদে কেঁদে তোর মার তো চোখ অন্ধ হতে চলেছে।’ কথা বলতে বলতে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে যাব। চেহারার সেই একই আদল। অথচ মুখ জুড়ে কী এক আশ্চর্য আলো ঠিকরে পড়ছে, আলোটা প্রগাঢ় জ্যোৎস্নার মতো।

‘আমি জানি, কিন্তু আমার যে ফেরার উপায় নেই।’ ওর চেহারায় বিষণ্নতা ছায়াপাত করে।

আমি পকেট থেকে চিনে বাদাম আর চিপস বের করব। দুজন মুখোমুখি বসে খুব ধীরে ধীরে খাবো। এক সময় সব অতীত ভুলে ঘাসে মাথা রেখে নীল আলোর আকাশ দেখতে দেখতে, পাখির কিচিরমিচির শুনতে শুনতে আমি আর টিপু সুলতান ঘুমিয়ে পড়ব। টিপু সুলতান এক সময় ঘুম থেকে জেগে উঠবে। জেগে মলিন আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখবে একটা কমলা রঙের কাটা ঘুড়ি উঁচু আকাশ থেকে মাটির দিকে পতিত হচ্ছে। ঘুড়ির নেশায় সে লাফ দিয়ে ওটার পিছু নিয়ে দে ছুট। তখনও আমি গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। পাখিদের কলকাকলি তীব্র হয়ে এক সময় আবার চারদিক শুনশান। দিন পেরিয়ে রাত হবে, ঝিঁঝিঁ ডাকবে, শুরু হবে শেয়ালের চিৎকার, বিপণ্ন কণ্ঠে ডাকবে রাতজাগা অচেনা পাখি, তখনও আমার চেতনা ফিরবে না। আমার বুকের উপর দিয়ে অন্ধকারে হেঁটে যাবে কাঁকড়া আর শামুকের ঝাঁক। শেষ রাতে মেঘ গর্জে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামবে, চারদিকে বৃষ্টির ঝুমঝুম বাতাসের শো শো আওয়াজ। একদিন দুদিন পাঁচ দিন যাবে, বৃষ্টি থামার নাম থাকবে না। সপ্তম দিবসে যখন ক্রন্দনরত আকাশ শান্ত হবে, পৃথিবী ধাতস্থ হবে, ততদিনে প্রায় সমগ্র দেশ প্লাবিত বানের বাঁকা জলে। আমার তন্দ্রাচ্ছন্ন দেহ ডুবে আছে বালু আর জলরাশির ভেতর। প্লাবনজল নেমে গেলে আমি পলির নিচে রোদে-বৃষ্টিতে কুয়াশায়, উত্তাপে-শীতলতায় ক্রমে পঞ্চভূতে বিলীন হতে থাকি। বছর পেরিয়ে আবারো আসবে এমন উজ্জ্বল শরৎ, বাতাসের সাথে খেলবে আজকের মতো সাদা মেঘের দল। তখন আমার পাঁজর ফুড়ে বেরোনো ঘাসগুলো কাশের গাছ হয়ে উঠবে, কতকদিন না যেতেই ওদের যৌবন আসবে। আমার বুকের জমিনে ফোটা কাশফুল গুলো দুলতে থাকবে এমনি মোহময় বাতাসে। সেই অনাগত বিকেলে কম্পমান কাশফুলের ফাঁকে কান পাতলে কেউ হয়তো শুনতে পাবে দূরের কান্নার মতো কোনো অস্ফুট ধ্বনি। হয়তো মানুষের কান্নাই—অনাদিকালের বহু মানুষের!

এ সম্পর্কিত আরও খবর