'এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়' রচয়িতা, দ্রোহ ও ভালোবাসার কবি হেলাল হাফিজ আর নেই!
আমার প্রিয় কবি ও একসময়ের জ্যেষ্ঠ সহকর্মী কবি হেলাল হাফিজের প্রয়াণে আমি অত্যন্ত ব্যথিত।
বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিদের অন্যতম, অভিমানী এই কবি চিরবিদায় নিয়েছেন।
১৩ ডিসেম্বর ঢাকার একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।
অকৃতদার এই কবি শাহবাগের একটি হোস্টেলে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছিলেন। বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ কবি আজ বাথরুমে পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছিলেন।
কবির রচনা সেই ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাঙালির গণআন্দোলন, বিদ্রোহ, মুক্তিযুদ্ধ এবং ভালোবাসায় প্রেরণা যুগিয়েছে। তারুণ্যকে উদ্দীপিত করেছে প্রতিবাদে ও দ্রোহে।
তরুণ-তরুণীর মুখে মুখে ফেরে তাঁর কবিতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল জুড়ে আঁকা থাকে তাঁর কবিতার পংক্তি। আবৃত্তির আয়োজন সম্পূর্ণ হয় না তাঁর কবিতা ছাড়া।
কবি হেলাল হাফিজের সবচেয়ে বেশি খ্যাতি তাঁর 'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়' কবিতা এবং প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'যে জলে আগুন জ্বলে'র জন্য। তাঁর গ্রন্থসংখ্যা মাত্র তিনটি।
অধুনালুপ্ত 'দৈনিক দেশ'-এ অনুজ সহকর্মী হিসেবে প্রায় চার বছর (১৯৭৯-১৯৮৩) তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পেয়েছি আমি। আর স্নেহধন্য ছিলাম সেই সময় থেকে। আমার কৈশোর উত্তীর্ণ তারুণ্যে। কবি তখন যৌবনে।
অনেক স্মৃতি আমার কবি হেলাল হাফিজকে নিয়ে।
পত্রিকা অফিসে তাঁর নিরিবিলি কক্ষে বসে আমার রিপোর্ট লেখার সুযোগ, চা পান, সাহিত্য আলোচনা থেকে শুরু করে ঢাকা স্টেডিয়ামে একসাথে ফুটবল খেলা উপভোগের অজস্র ঘটনা।
তাঁর সম্পাদিত সাহিত্য পাতায় আমার একাধিক গল্প প্রকাশ করেছেন। আমার কবিতা সম্পর্কে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
আমার পারিবারিক আয়োজনে তাঁর উপস্থিতি সমৃদ্ধ করেছে আমাদের মনন।
আমার জীবনসঙ্গিনী কবি শিউলী জাহান সাংবাদিক হিসেবে কবির সাক্ষাৎকার নেওয়ার কারণে আমাদের বিয়ের আগে থেকেই কবির স্নেহধন্য। আমাদের কন্যা উপলকেও অত্যন্ত স্নেহ করতেন তিনি।
কবি হেলাল হাফিজকে নিয়ে আরও লিখবো পরে।
দুই বছর আগে কবির জন্মদিনে তাঁকে নিয়ে আমার স্মৃতিচারণের অংশবিশেষ আজ:
কবি ও ক্যাকটাস • সৈকত রুশদী
অধুনালুপ্ত 'দৈনিক দেশ'-এর কার্যালয় তখন স্থানান্তর হয়েছে ২৭ পুরানা পল্টন থেকে সেগুনবাগিচার পাঁচ নম্বর বাড়িতে।
পত্রিকাটির সাহিত্য সম্পাদক, অগ্রজ সহকর্মী কবি হেলাল হাফিজের জন্য নির্ধারিত কক্ষের দরোজার সামনে এক চিলতে বারান্দার পরই মাটির উপর অদ্ভুত ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে থাকা কণ্টকিত এক ক্যাকটাস।
তিন থেকে সাড়ে তিন ফুট উঁচু। একসময়ে যত্নে থাকলেও ভাড়া বাড়িতে পুষ্প পল্লবহীন, কিছুটা শ্রীহীন এই ক্যাকটাসের সর্বাঙ্গে অযত্নের ছাপ সুস্পষ্ট। ধুলোয় ধূসরিত।
পাশের ঘরে রিপোর্টিং-এর বৈঠকশেষে দুপুরে বা বিকেলে কবির কক্ষে এসে বসতাম নিয়মিত। বসার আগে কখনও কখনও চোখে পড়তো অবহেলায় থাকা ক্যাকটাসটি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবনের শেষ বর্ষ, আর পূর্ণ সময়ের সাংবাদিকতায় অতি ব্যস্ত প্রতিটি দিনই। সেই ব্যস্ত জীবনের কারণে, অথবা তারুণ্যের উচ্ছলতায় অনেক সময় খেয়াল করা হতোনা দোতলা ভবনের নিচতলায় ঢোকার মুখে সিঁড়ির বাম পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট উদ্ভিদটি।
রিপোর্টিং কক্ষে ভিড় বেশি হলে সন্ধ্যার পরেও সাহিত্য সম্পাদকের কক্ষে বসে রিপোর্ট লেখা শেষ করতাম।
'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়' কবিতার জন্য বিখ্যাত ও অত্যন্ত জনপ্রিয় কবি হেলাল হাফিজ ভাইয়ের সৌজন্যে এক কাপ রঙ চায়ের সাথে।
মৃদুভাষী কবির সাথে কথা হতো প্রতিদিনই। তাঁর গুণমুগ্ধ আমি। তাঁর স্নেহধন্যও।
একদিন প্রকাশিত হলো তাঁর এই কবিতাটি সংবাদপত্রের সাহিত্য পাতায়।
নজর কাড়লো ক্যাকটাসটি আমাদের সকলের, নতুন করে। নতুন পাতার আগমনে স্নিগ্ধ হয়ে ওঠা ক্যাকটাসে ও কবি হেলাল হাফিজের কবিতায় বিমুগ্ধ হলাম!
সেটি চল্লিশ বছর আগের, ১৯৮২ সালের ঘটনা।
আজও মনে হয়, এইতো সেদিনের কথা!
কবির শরীর খুব ভালো যাচ্ছে না বেশ কিছুদিন ধরে।
অকৃতদার এই প্রেমিক কবি'র আবাস হোটেল কক্ষ ছেড়ে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে অবস্থান প্রায় নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাঁর পূর্ণ আরোগ্য কামনা করছি। যাতে কবি আবার নতুন উদ্যমে তারুণ্য উদ্দীপ্ত কবিতা রচনায় মগ্ন হতে পারেন।
প্রার্থনা করি, আল্লাহ যেন প্রয়াত কবি হেলাল হাফিজের রূহকে জান্নাতুল ফেরদৌসে চিরশান্তি প্রদান করেন।
আন্তরিক সমবেদনা কবির জ্যেষ্ঠ ভাই দুলাল হাফিজ ও পরিবারের সকলের প্রতি।
টরন্টো
১৩ ডিসেম্বর ২০২৪
সৈকত রুশদী, রাজনৈতিক ও গণমাধ্যম বিশ্লেষক, সাংবাদিক, ব্রডকাস্টার, কবি ও লেখক। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক। বর্তমানে কানাডায় অভিবাসী।