কবি হেলাল হাফিজ: ‘আমাকে দুঃখের শ্লোক কে শোনাবে…?’
১৯৬৯ সাল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পূর্বপ্রস্তুতির প্রাক্কালে। গোটা দেশ যখন পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে উত্তাল। ওই সময় এক যুবক কবির আবির্ভাব। যার ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’—নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় কবিতার অমর এ পঙ্ক্তি বিপ্লবীদের মধ্যে এনে দিয়েছিল বিদ্রোহের জোয়ার। তিনি প্রেম ও দ্রোহের কবি হেলাল হাফিজ। একটি কবিতা দিয়ে ছাত্রজীবনেই খ্যাতির চূড়ায় আরোহন করেন। তাঁর কবিতার পরতে পরতে ছিল লড়াই, সংগ্রাম, প্রেম-বিরহ, বিপ্লবের গল্প।
একদিকে তিনি যেমন প্রেমিকদের যুদ্ধে নিতে উদ্ধুদ্ধ করেছেন। অন্যদিকে ‘এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো/পত্র দিয়ো’- প্রেমিকার পত্র চেয়ে হাজারো প্রেমিকের প্রতিনিধি হয়ে আক্ষেপও করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখবোধের গল্প তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে।
১৯৮৬ সালে নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়সহ ৫৫টি কবিতা মিলে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'যে জলে আগুন জ্বলে' প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের সর্বাধিক বিক্রিত কাব্যগ্রন্থ এটি। ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৫ সালের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে কাব্যগ্রন্থটির কবিতাগুলো লেখেন তিনি। যা ওই সময় তারুণদের মধ্যে জাগরণ তৈরি করে। তাঁর কবিতার সহজ-সরল ভাষা মানুষের হৃদয় আলোড়িত করে। একটা কাব্যগ্রন্থ দিয়ে হেলাল হাফিজ ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও আসামান্য খ্যাতি লাভ করেন। যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
'যে জলে আগুন জ্বলে' কাব্যগ্রন্থের পর তিনি দীর্ঘ বিরতির পর ২০১২ সালে ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থের কবিতার সঙ্গে কিছু কবিতা যুক্ত করে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা একাত্তর’ প্রকাশিত হয়। ২০১৯ সালে তৃতীয় ও শেষ কবিতার বই ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ প্রকাশিত হয়।
কবি হেলাল হাফিজ ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন নিঃসঙ্গ পথচারি। ছোটবেলায় মাকে হারিয়ে বাবার কাছে বেড়ে ওঠা। বাবাকে হারানোর পর প্রেম জীবন ছিল তাঁর চলার পাথেয়। কিন্তু এক পর্যায়ে প্রেমিকাও তাঁকে ছেড়ে যান। বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে সেই বিচ্ছেদের ব্যবচ্ছেদও করেছিলেন তিনি। প্রেমিকার বিয়ের কথা শুনে ‘ভেতরে ঝড় উঠলেও’ তাঁকে আটকানোর চেষ্টা করেননি কবি। ‘ভালোবাসা মিলনে মলিন হয়, বিরহে উজ্জ্বল’- এই পঙক্তিকে ধারণ বাকি জীবন কাটাতে চেয়েছিল প্রেমিক এই কবি।
সংসারহীন, গৃহহীন- হেলাল হাফিজ দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন হোটেল হোটেলে। তাই শেষ জীবনে একাকীত্ব নিয়ে আফসোস করেছেন। গণমাধ্যমের সাক্ষাৎকার ও দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে দেখা যার আভাস পাওয়া যায়। ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ কবি রিখেছেন ‘আমাকে দুঃখের শ্লোক কে শোনাবে?/কে দেখাবে আমাকে দুঃখের চিহ্ন কী এমন…’,।
কষ্ট নেবে কষ্ট/হরেক রকম কষ্ট আছে/কষ্ট নেবে কষ্ট!’ কবি হেলাল হাফিজ শেষ জীবনে তার কবিতার মতো কষ্টের ফেরিওয়ালা হয়ে নিভৃতে জীবন কাটিয়েছেন।
প্রেম ও দ্রোহের কবি হেলাল হাফিজ শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) দুপুরে শাহবাগের সুপার হোম হোস্টেলে তশেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মরদেহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) রাখা হয়েছে।
১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলার বড়তলী গ্রামে হেলাল হাফিজের জন্ম। শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য কেটেছে নিজের শহরেই। ১৯৬৭ সালে নেত্রকোনা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন।
দেশে খ্যাতি পাওয়া কবিদের মধ্যে অন্যতম হেলাল হাফিজ সাহিত্যে ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। তার আগে খালেকদাদ চৌধুরী পুরস্কারসহ নানা সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।