কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৯)

আত্মজীবনী, শিল্প-সাহিত্য

জিনি লকারবি ।। অনুবাদ: আলম খোরশেদ | 2023-08-31 04:11:40

পুনর্মিলন ও পূর্বাভাস

[পূর্ব প্রকাশের পর] লিন ও আমি, আমাদের বন্ধুদের দেখতে ও তাদের অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চেয়েছিলাম। খুব সাবধানে আমরা এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যাই, তাদের গল্প শুনি, অভিজ্ঞতা বিনিময় করি, প্রার্থনা করি এবং ঈশ্বর তাদের বিপদমুক্ত রেখেছেন বলে উল্লাস করি। প্রথমদিকেই আমরা গিয়েছিলাম আমাদের রবিবারের স্কুলের কিশোরী ছাত্রীদের বাড়িতে। ঈশ্বর আমাদের যাওয়ার এই সময়টাকে একেবারে নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা করেছিলেন। প্রথম-বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা দেখি, একটি ছাত্রীর মা গুরুতরভাবে অসুস্থ। তাঁর রক্তচাপ ও শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করে আমরা একটা জটিল গর্ভধারণের আলামত হিসাবে সন্দেহ করি। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করার দরকার তক্ষুনি। তাঁর সাত বাচ্চার প্রত্যেকেই বাড়িতে জন্মেছে, তাই পরিবারটি তাঁকে কোনো অবস্থাতেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবেনি, আর যদি তারা তা ভাবতোও, সেটা করার সঙ্গতি তাদের ছিল না। আমরা দ্রুত তার ব্যবস্থা করি এবং তাঁকে চন্দ্রঘোনায় ব্রিটিশ ব্যাপ্টিস্ট হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিই।

হাসপাতালে যাবার পথে, সেই মা আমাদেরকে বলেন, তিনি এই গোলযোগের সময়ে তাঁর বড় মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে খুবই চিন্তিত। আমরা তাঁকে নিশ্চয়তা দিই যে, ঈশ্বর তাঁর মেয়েদের রক্ষা করবেন। তারপর ঈশ্বর আমাদেরকে নির্বাচন করেন এবং মনে করিয়ে দেন যে, তিনি তাঁর ইচ্ছা চরিতার্থ করার নিমিত্তে মানুষকেই বাহন করার কথা ঠিক করেছেন। একটি ফুটফুটে বাচ্চা ছেলে নিয়ে মা চন্দ্রঘোনা থেকে ফেরার একটু পরেই ষোল বছরের লুসি আমাদের সঙ্গে থাকতে আসে।

আরেক বিকালে আমরা যখন একঘরের একটি বাড়িতে, রাস্তার দিকে মুখ করা বিছানায় বসে ছিলাম তখন উর্দি পরা দুজন লোককে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দেখি। তাদের একজন খুবই বাচাল প্রকৃতির ছিল এবং আমাদের দিকে অশোভনভাবে তাকাচ্ছিল।

“তোমরা কী?”
“তোমরা বাঙালি?”
“তোমরা সাহেব?”

তার সহযোগীকে মনে হয় সংলাপ দ্রুত শেষ করে সামনে এগুতে ইচ্ছুক, কিন্তু মুখপাত্র বলেই চলে, “তোমরা কী করো?”

আমরা আমাদের ব্যাখ্যায় কোথাও এগুতে না পারায়, একজন বৃদ্ধা তার সঙ্গে উর্দুতে কথা বলতে শুরু করেন। “এটা একটা খ্রিস্টান পাড়া। এরা আমাদের সঙ্গে প্রার্থনা করতে এসেছেন।”
“ওহ।” আলো দেখা দিলে, সে উত্তরে জানায়, “তোমরা তাহলে দেবী!”

নৈরাজ্যপূর্ণ চট্টগ্রামে ক্যাথলিক হিসাবে আমরা প্রতিদিনই ঈশ্বরের উপস্থিতি ও তাঁর নির্দেশনা সম্পর্কে সচেতন হতাম, কিন্তু আমরা এও বিশ্বাস করি যে, পিতা আসলে প্রতিটি দেশি বিশ্বাসীর চোখেই একটা শক্তি হিসাবে প্রতিভাত করছিলেন নিজেকে।

এখানে একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পুরুষ ও তাঁর স্ত্রী, তাঁদের পরিত্রাণের এমন এক ঘটনা বর্ণনা করেন, যাকে কেবল অলৌকিকতা দিয়েই ব্যাখ্যা করা যায়। নিচের লেখাগুলো ছিল মি. জিমি রজার্স ও তাঁর পত্নীর নিজের হাতে লেখা সত্যি ঘটনার বিবরণ।

“জুলফিকার আলি ভুট্টো ১৯৭১ সালের তেসরা মার্চে ডাকা জাতীয় সংসদ অধিবেশনকে বানচাল না করে দিলে আমার এই গল্পটা বলা হতো না।”

“ছয় বছর বয়সে অনাথ হয়ে, হিমালয়ের পাদদেশে প্রয়াত ডা: জে এ গ্রাহাম কর্তৃক স্থাপিত বিখ্যাত অনাথাশ্রমে ভর্তি হই আমি। আমাদের গোটা জীবনটাই রাজকীয় কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রতিনিয়ত বদলে-যাওয়া মুখাবয়ব দ্বারা আচ্ছন্ন থাকত। অনাথাশ্রমটি ছিল একটি খ্রিস্টান প্রতিষ্ঠান, যেখানে আমি কেবল খুব ভালো শিক্ষাই কেবল পাই না, স্বয়ং খ্রিস্টকে আমার ত্রাতা হিসাবেও পাই, এবং বাইবেল পাঠ ও প্রার্থনার অভ্যাস গড়ে তুলি।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন নৌবাহিনীতে ঢুকে আমার প্রথম জীবনের সেইসব অভিজ্ঞতার কথা ভুলে যাই। যুদ্ধ একজনকে ঈশ্বর কিংবা শয়তানের নিকটবর্তী করে তুলতে পারে, বিশ্বাসের গভীরতা ও বন্ধুসঙ্গের প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। বিশ্বাস থেকে সরে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি আমার ক্ষেত্রে একটু ধীর ছিল; প্রথমে মদ্যপান, তারপর জুয়া খেলা, তারও পর যিশু থেকে ক্রমে দূর থেকে দূরে ছিটকে পড়া; খুন ছাড়া, আইনের চোখে এমন কোনো অপরাধ ছিল না যা আমি করিনি।”

“শেষ পর্যন্ত নিজের ধ্বংসের কাছে এসে এবং নিজেকে একটি ডাকাতির অভিযোগে মিথ্যেভাবে অভিযুক্ত হতে দেখে আমি ঈশ্বরের শরণাপন্ন হই। এক মুহূর্তে আমার জীবন ছিল অন্ধকার ও অবসাদে আচ্ছন্ন, আর পরের মুহূর্তেই আলো, শক্তি ও আশ্বাস। অনেক বছর পেরিয়ে যায়—নিয়মিত চাকরি, পদোন্নতি সবই ঘটে। আমাদের যেহেতু কোনো সন্তান ছিল না, আমার স্ত্রী ও আমি দুটো বাঙালি মেয়েকে দত্তক নিই।”

“আমাদের আরামদায়ক জীবন ছিল এবং মোটামুটি স্বচ্ছলই ছিলাম আমরা। তারপর হঠাৎ করেই আকাশ ভেঙে পড়ে। আমি চাকরি হারাই এবং বিভিন্ন খুচরো কাজ করি তার পরের ছয়মাস। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে আমি ঢাকায় কাজ করছিলাম। আমার স্ত্রী ও দুই কন্যা, তখন বয়স তিন ও চার, ১৭৫ মাইল দক্ষিণে চট্টগ্রাম শহরে থাকত। আমাদের বাসাটি বিহারি অধ্যুষিত এলাকা থেকে মাত্র আধমাইল দূরে একটি মিলিশিয়া ক্যাম্পের পাশেই ছিল। সেটা খুব নির্জন এলাকা, যার কাছাকাছি মাত্র আর একটা বাড়িই ছিল।”

“ডিসেম্বরের ২৭ তারিখে আমি যখন ক্রিসমাসের জন্য বাড়ি এসেছিলাম, তখন আমার মনে একটা জোর বিশ্বাস জেগেছিল যে, আমি হয়তো আমার বাড়িটা আর দেখব না। এই অনুভূতিটা এমন জোরালোভাবে আমার মনে গেঁথে থাকে যে, আমি আমার এক মিশনারি বন্ধু জিন গুর্‌গানসকে চট্টগ্রামে চিঠি লিখে সেই ভয়ের কথা খুলে বলি এবং আমার পরিবারের দেখভাল করার অনুরোধ করি।”

“মার্চের ১ তারিখ শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানিরা জাতীয় সংসদ অধিবেশন বানচাল করার জন্য যেসব বাধাবিঘ্ন সৃষ্টি করছিল তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য বাঙালিদের ডাক দেন। গোটা পূর্ব বাংলা তাঁর ডাকে জেগে ওঠে। মার্চের ১ তারিখ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত অবস্থা খুব উৎকণ্ঠাময় ছিল এবং নানা দাঙ্গাহাঙ্গামাও হচ্ছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি মিলিটারি একটা সর্বাত্মক অভিযান শুরু করল বাঙালিদেরকে দমিয়ে দেওয়ার জন্য এবং তাতে তারা কিছুটা সফলও হয়েছিল বলা চলে।

ঢাকাকে রাতারাতি দমন করা গেলেও চট্টগ্রামে যুদ্ধ আরো কুড়ি দিনের মতো চলে। ২৫ মার্চ রাত দশটায় ঢাকা শহরে গোলাগুলি ও বোমাবাজি শুরু হয়। আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনি। রাত দুটোর দিকে মিলিটারি সারা শহর ঘুরে লাউডস্পিকারে লোকদের সাবধান করতে থাকে এই বলে যে, আগামীকাল ২৬ মার্চ সারাদিন র্কাফ্যু থাকবে। বাড়ি থেকে কেউ বার হলেই তাকে গুলি করে মারা হবে।”

“বিকালের মধ্যে আমি ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে পারছিলাম না, তাই সাহস করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে খাদ্যের সন্ধান করতে থাকি। আমি একটা ছোট্ট ঘুপচিঘর দেখি যার একটি ছোট্ট জানালার ভেতর দিয়ে চা বিক্রি করা হচ্ছিল। আমি এক বোতল চা ভর্তি করে নিই, কেননা আমার সেই অভিযানে আমি এই একটি মাত্র খাদ্যের খোঁজ পেয়েছিলাম। পরদিন আমি একই দোকান থেকে একটি বাসি রুটি এবং আরো কিছু চায়ের ব্যবস্থা করতে পারি। চারটি বাঙালি পরিবার আমার ঘরে আশ্রয় নেয়। আমি একটি ১০ বাই ১০ ফুট ঘরে থাকতাম, ফলে আপনারা বুঝতেই পারছেন কী অসুবিধাই না হচ্ছিল সবার।”

“মার্চের ২৮ তারিখ আমি চট্টগ্রামে আমার পরিবারের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি। আমি দুবার ক্যান্টনমেন্টে যাই একটা বিমানের টিকিটের অনুমতির জন্য, কিন্তু তারা আমাকে মুখের ওপর না করে দেয়। এপ্রিলের ৩ তারিখ আমি আমাকে সাহায্য করার জন্য একজন বন্ধুকে যোগাড় করি, যে কিনা উর্দু বলতে পারে। সে আমাকে সাহায্য করে ঠিকই, কিন্তু নিজেকে বিশাল বিপদের মুখে ফেলে দিয়ে। সে তখন আমাকে অনুরোধ করে, তার সঙ্গে সেই মিলিটারি অফিসারের কাছে যেতে, যে-এই অনুমতিটি প্রদান করছিল। আমি আসার পর আমাকে বলা হয়, আমার বন্ধু আমার নাম ব্যবহার করেছে বিমানের টিকিটের জন্য। তাকে গুলি করার সমূহ ইচ্ছা ছিল তাদের, কিন্তু আমি আমার বন্ধুকে কোনোমতে সেই দুর্দশা থেকে উদ্ধার করে আনতে পারি। সে বলে যে, তাকে লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল গুলি করার জন্য, কিন্তু সে নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করে। সে যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভাষা উর্দু বলতে পারত, সেহেতু তাকে এই সুযোগ দেওয়া হয় যেন আমি এসে তার কথার সত্যতা প্রমাণ করি। অবশ্যই আমি সেদিন কোনো বিমানযাত্রার অনুমতি পাইনি। বাকি সারা সপ্তাহ আমি লাইনে দাঁড়িয়ে সেই চেষ্টা করে যাই কিন্তু আমাকে প্রতিবারই প্রত্যাখ্যান করা হয়, কারণ আমি যে পাকিস্তানি তার কোনো প্রমাণ দেখাতে পারছিলাম না। পাঁচটি ব্যর্থ চেষ্টার পর অবশেষে ৬ই মে-র একটি উড়ানের অনুমতি দেওয়া হয় আমাকে।”

“আমার বিমানযাত্রার আগের রাতে, আমি একটা টেলিগ্রাম পাই যে, আমার স্ত্রী ও কন্যারা নিরাপদে আছে এবং তারা বাইবেল ইনফরমেশন সেন্টারে আছে। এটা আমাকে রীতিমতো বিস্মিত করে। আমি তখনই বুঝতে পারি, আমার বাড়ির কিছু একটা হয়েছে, তা নাহলে আমার স্ত্রী কিছুতেই বাড়ি ত্যাগ করত না। কিন্তু আমি সেই টেলিগ্রাম আসার সময়টাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করব? আমি এর আগে বিমানযাত্রার অনুমতি পেলে, সরাসরি বাড়ি চলে গিয়ে বাড়ির এই হাল দেখে ধরে নিতাম যে, আমার স্ত্রী কন্যাদের হত্যা করা হয়েছে। ওই সময়ে টেলিগ্রামটা পাওয়াতে আমি সেই মুহূর্তের আতঙ্ক ও বুকের যন্ত্রণা, বেদনা থেকে অব্যাহতি পাই। এই খবর পেয়ে আমি সরাসরি বাইবেল ইনফরমেশন সেন্টারে যাই এবং আমার পরিবারের সঙ্গে পুনর্মিলিত হই। দিন গড়িয়ে যায় এবং আমি আমার স্ত্রীর অভিজ্ঞতার কথা জানতে পারি। আমি তাকেই সেসব বর্ণনা করতে বলব।” [চলবে]

কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৯)
পুনর্মিলন ও পূর্বাভাস
জিনি লকারবি ।। অনুবাদ: আলম খোরশেদ

[পূর্ব প্রকাশের পর] লিন ও আমি, আমাদের বন্ধুদের দেখতে ও তাদের অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চেয়েছিলাম। খুব সাবধানে আমরা এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যাই, তাদের গল্প শুনি, অভিজ্ঞতা বিনিময় করি, প্রার্থনা করি এবং ঈশ্বর তাদের বিপদমুক্ত রেখেছেন বলে উল্লাস করি। প্রথমদিকেই আমরা গিয়েছিলাম আমাদের রবিবারের স্কুলের কিশোরী ছাত্রীদের বাড়িতে। ঈশ্বর আমাদের যাওয়ার এই সময়টাকে একেবারে নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা করেছিলেন। প্রথম-বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা দেখি, একটি ছাত্রীর মা গুরুতরভাবে অসুস্থ। তাঁর রক্তচাপ ও শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করে আমরা একটা জটিল গর্ভধারণের আলামত হিসাবে সন্দেহ করি। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করার দরকার তক্ষুনি। তাঁর সাত বাচ্চার প্রত্যেকেই বাড়িতে জন্মেছে, তাই পরিবারটি তাঁকে কোনো অবস্থাতেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবেনি, আর যদি তারা তা ভাবতোও, সেটা করার সঙ্গতি তাদের ছিল না। আমরা দ্রুত তার ব্যবস্থা করি এবং তাঁকে চন্দ্রঘোনায় ব্রিটিশ ব্যাপ্টিস্ট হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিই।

হাসপাতালে যাবার পথে, সেই মা আমাদেরকে বলেন, তিনি এই গোলযোগের সময়ে তাঁর বড় মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে খুবই চিন্তিত। আমরা তাঁকে নিশ্চয়তা দিই যে, ঈশ্বর তাঁর মেয়েদের রক্ষা করবেন। তারপর ঈশ্বর আমাদেরকে নির্বাচন করেন এবং মনে করিয়ে দেন যে, তিনি তাঁর ইচ্ছা চরিতার্থ করার নিমিত্তে মানুষকেই বাহন করার কথা ঠিক করেছেন। একটি ফুটফুটে বাচ্চা ছেলে নিয়ে মা চন্দ্রঘোনা থেকে ফেরার একটু পরেই ষোল বছরের লুসি আমাদের সঙ্গে থাকতে আসে।

আরেক বিকালে আমরা যখন একঘরের একটি বাড়িতে, রাস্তার দিকে মুখ করা বিছানায় বসে ছিলাম তখন উর্দি পরা দুজন লোককে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দেখি। তাদের একজন খুবই বাচাল প্রকৃতির ছিল এবং আমাদের দিকে অশোভনভাবে তাকাচ্ছিল।

“তোমরা কী?”
“তোমরা বাঙালি?”
“তোমরা সাহেব?”

তার সহযোগীকে মনে হয় সংলাপ দ্রুত শেষ করে সামনে এগুতে ইচ্ছুক, কিন্তু মুখপাত্র বলেই চলে, “তোমরা কী করো?”

আমরা আমাদের ব্যাখ্যায় কোথাও এগুতে না পারায়, একজন বৃদ্ধা তার সঙ্গে উর্দুতে কথা বলতে শুরু করেন। “এটা একটা খ্রিস্টান পাড়া। এরা আমাদের সঙ্গে প্রার্থনা করতে এসেছেন।”
“ওহ।” আলো দেখা দিলে, সে উত্তরে জানায়, “তোমরা তাহলে দেবী!”

নৈরাজ্যপূর্ণ চট্টগ্রামে ক্যাথলিক হিসাবে আমরা প্রতিদিনই ঈশ্বরের উপস্থিতি ও তাঁর নির্দেশনা সম্পর্কে সচেতন হতাম, কিন্তু আমরা এও বিশ্বাস করি যে, পিতা আসলে প্রতিটি দেশি বিশ্বাসীর চোখেই একটা শক্তি হিসাবে প্রতিভাত করছিলেন নিজেকে।

এখানে একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পুরুষ ও তাঁর স্ত্রী, তাঁদের পরিত্রাণের এমন এক ঘটনা বর্ণনা করেন, যাকে কেবল অলৌকিকতা দিয়েই ব্যাখ্যা করা যায়। নিচের লেখাগুলো ছিল মি. জিমি রজার্স ও তাঁর পত্নীর নিজের হাতে লেখা সত্যি ঘটনার বিবরণ।

“জুলফিকার আলি ভুট্টো ১৯৭১ সালের তেসরা মার্চে ডাকা জাতীয় সংসদ অধিবেশনকে বানচাল না করে দিলে আমার এই গল্পটা বলা হতো না।”

“ছয় বছর বয়সে অনাথ হয়ে, হিমালয়ের পাদদেশে প্রয়াত ডা: জে এ গ্রাহাম কর্তৃক স্থাপিত বিখ্যাত অনাথাশ্রমে ভর্তি হই আমি। আমাদের গোটা জীবনটাই রাজকীয় কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রতিনিয়ত বদলে-যাওয়া মুখাবয়ব দ্বারা আচ্ছন্ন থাকত। অনাথাশ্রমটি ছিল একটি খ্রিস্টান প্রতিষ্ঠান, যেখানে আমি কেবল খুব ভালো শিক্ষাই কেবল পাই না, স্বয়ং খ্রিস্টকে আমার ত্রাতা হিসাবেও পাই, এবং বাইবেল পাঠ ও প্রার্থনার অভ্যাস গড়ে তুলি।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন নৌবাহিনীতে ঢুকে আমার প্রথম জীবনের সেইসব অভিজ্ঞতার কথা ভুলে যাই। যুদ্ধ একজনকে ঈশ্বর কিংবা শয়তানের নিকটবর্তী করে তুলতে পারে, বিশ্বাসের গভীরতা ও বন্ধুসঙ্গের প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। বিশ্বাস থেকে সরে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি আমার ক্ষেত্রে একটু ধীর ছিল; প্রথমে মদ্যপান, তারপর জুয়া খেলা, তারও পর যিশু থেকে ক্রমে দূর থেকে দূরে ছিটকে পড়া; খুন ছাড়া, আইনের চোখে এমন কোনো অপরাধ ছিল না যা আমি করিনি।”

“শেষ পর্যন্ত নিজের ধ্বংসের কাছে এসে এবং নিজেকে একটি ডাকাতির অভিযোগে মিথ্যেভাবে অভিযুক্ত হতে দেখে আমি ঈশ্বরের শরণাপন্ন হই। এক মুহূর্তে আমার জীবন ছিল অন্ধকার ও অবসাদে আচ্ছন্ন, আর পরের মুহূর্তেই আলো, শক্তি ও আশ্বাস। অনেক বছর পেরিয়ে যায়—নিয়মিত চাকরি, পদোন্নতি সবই ঘটে। আমাদের যেহেতু কোনো সন্তান ছিল না, আমার স্ত্রী ও আমি দুটো বাঙালি মেয়েকে দত্তক নিই।”

“আমাদের আরামদায়ক জীবন ছিল এবং মোটামুটি স্বচ্ছলই ছিলাম আমরা। তারপর হঠাৎ করেই আকাশ ভেঙে পড়ে। আমি চাকরি হারাই এবং বিভিন্ন খুচরো কাজ করি তার পরের ছয়মাস। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে আমি ঢাকায় কাজ করছিলাম। আমার স্ত্রী ও দুই কন্যা, তখন বয়স তিন ও চার, ১৭৫ মাইল দক্ষিণে চট্টগ্রাম শহরে থাকত। আমাদের বাসাটি বিহারি অধ্যুষিত এলাকা থেকে মাত্র আধমাইল দূরে একটি মিলিশিয়া ক্যাম্পের পাশেই ছিল। সেটা খুব নির্জন এলাকা, যার কাছাকাছি মাত্র আর একটা বাড়িই ছিল।”

“ডিসেম্বরের ২৭ তারিখে আমি যখন ক্রিসমাসের জন্য বাড়ি এসেছিলাম, তখন আমার মনে একটা জোর বিশ্বাস জেগেছিল যে, আমি হয়তো আমার বাড়িটা আর দেখব না। এই অনুভূতিটা এমন জোরালোভাবে আমার মনে গেঁথে থাকে যে, আমি আমার এক মিশনারি বন্ধু জিন গুর্‌গানসকে চট্টগ্রামে চিঠি লিখে সেই ভয়ের কথা খুলে বলি এবং আমার পরিবারের দেখভাল করার অনুরোধ করি।”

“মার্চের ১ তারিখ শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানিরা জাতীয় সংসদ অধিবেশন বানচাল করার জন্য যেসব বাধাবিঘ্ন সৃষ্টি করছিল তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য বাঙালিদের ডাক দেন। গোটা পূর্ব বাংলা তাঁর ডাকে জেগে ওঠে। মার্চের ১ তারিখ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত অবস্থা খুব উৎকণ্ঠাময় ছিল এবং নানা দাঙ্গাহাঙ্গামাও হচ্ছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি মিলিটারি একটা সর্বাত্মক অভিযান শুরু করল বাঙালিদেরকে দমিয়ে দেওয়ার জন্য এবং তাতে তারা কিছুটা সফলও হয়েছিল বলা চলে।

ঢাকাকে রাতারাতি দমন করা গেলেও চট্টগ্রামে যুদ্ধ আরো কুড়ি দিনের মতো চলে। ২৫ মার্চ রাত দশটায় ঢাকা শহরে গোলাগুলি ও বোমাবাজি শুরু হয়। আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনি। রাত দুটোর দিকে মিলিটারি সারা শহর ঘুরে লাউডস্পিকারে লোকদের সাবধান করতে থাকে এই বলে যে, আগামীকাল ২৬ মার্চ সারাদিন র্কাফ্যু থাকবে। বাড়ি থেকে কেউ বার হলেই তাকে গুলি করে মারা হবে।”

“বিকালের মধ্যে আমি ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে পারছিলাম না, তাই সাহস করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে খাদ্যের সন্ধান করতে থাকি। আমি একটা ছোট্ট ঘুপচিঘর দেখি যার একটি ছোট্ট জানালার ভেতর দিয়ে চা বিক্রি করা হচ্ছিল। আমি এক বোতল চা ভর্তি করে নিই, কেননা আমার সেই অভিযানে আমি এই একটি মাত্র খাদ্যের খোঁজ পেয়েছিলাম। পরদিন আমি একই দোকান থেকে একটি বাসি রুটি এবং আরো কিছু চায়ের ব্যবস্থা করতে পারি। চারটি বাঙালি পরিবার আমার ঘরে আশ্রয় নেয়। আমি একটি ১০ বাই ১০ ফুট ঘরে থাকতাম, ফলে আপনারা বুঝতেই পারছেন কী অসুবিধাই না হচ্ছিল সবার।”

“মার্চের ২৮ তারিখ আমি চট্টগ্রামে আমার পরিবারের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি। আমি দুবার ক্যান্টনমেন্টে যাই একটা বিমানের টিকিটের অনুমতির জন্য, কিন্তু তারা আমাকে মুখের ওপর না করে দেয়। এপ্রিলের ৩ তারিখ আমি আমাকে সাহায্য করার জন্য একজন বন্ধুকে যোগাড় করি, যে কিনা উর্দু বলতে পারে। সে আমাকে সাহায্য করে ঠিকই, কিন্তু নিজেকে বিশাল বিপদের মুখে ফেলে দিয়ে। সে তখন আমাকে অনুরোধ করে, তার সঙ্গে সেই মিলিটারি অফিসারের কাছে যেতে, যে-এই অনুমতিটি প্রদান করছিল। আমি আসার পর আমাকে বলা হয়, আমার বন্ধু আমার নাম ব্যবহার করেছে বিমানের টিকিটের জন্য। তাকে গুলি করার সমূহ ইচ্ছা ছিল তাদের, কিন্তু আমি আমার বন্ধুকে কোনোমতে সেই দুর্দশা থেকে উদ্ধার করে আনতে পারি। সে বলে যে, তাকে লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল গুলি করার জন্য, কিন্তু সে নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করে। সে যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভাষা উর্দু বলতে পারত, সেহেতু তাকে এই সুযোগ দেওয়া হয় যেন আমি এসে তার কথার সত্যতা প্রমাণ করি। অবশ্যই আমি সেদিন কোনো বিমানযাত্রার অনুমতি পাইনি। বাকি সারা সপ্তাহ আমি লাইনে দাঁড়িয়ে সেই চেষ্টা করে যাই কিন্তু আমাকে প্রতিবারই প্রত্যাখ্যান করা হয়, কারণ আমি যে পাকিস্তানি তার কোনো প্রমাণ দেখাতে পারছিলাম না। পাঁচটি ব্যর্থ চেষ্টার পর অবশেষে ৬ই মে-র একটি উড়ানের অনুমতি দেওয়া হয় আমাকে।”

“আমার বিমানযাত্রার আগের রাতে, আমি একটা টেলিগ্রাম পাই যে, আমার স্ত্রী ও কন্যারা নিরাপদে আছে এবং তারা বাইবেল ইনফরমেশন সেন্টারে আছে। এটা আমাকে রীতিমতো বিস্মিত করে। আমি তখনই বুঝতে পারি, আমার বাড়ির কিছু একটা হয়েছে, তা নাহলে আমার স্ত্রী কিছুতেই বাড়ি ত্যাগ করত না। কিন্তু আমি সেই টেলিগ্রাম আসার সময়টাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করব? আমি এর আগে বিমানযাত্রার অনুমতি পেলে, সরাসরি বাড়ি চলে গিয়ে বাড়ির এই হাল দেখে ধরে নিতাম যে, আমার স্ত্রী কন্যাদের হত্যা করা হয়েছে। ওই সময়ে টেলিগ্রামটা পাওয়াতে আমি সেই মুহূর্তের আতঙ্ক ও বুকের যন্ত্রণা, বেদনা থেকে অব্যাহতি পাই। এই খবর পেয়ে আমি সরাসরি বাইবেল ইনফরমেশন সেন্টারে যাই এবং আমার পরিবারের সঙ্গে পুনর্মিলিত হই। দিন গড়িয়ে যায় এবং আমি আমার স্ত্রীর অভিজ্ঞতার কথা জানতে পারি। আমি তাকেই সেসব বর্ণনা করতে বলব।” [চলবে]


কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৮)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৭)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৬)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৫)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৪)

এ সম্পর্কিত আরও খবর