মহান রুশ কথাশিল্পী ইভান তুর্গেনেভের ছোটগল্প মুমু পাঠান্তে যে কোনো সংবেদী পাঠকের মনে এ প্রশ্ন তৈরি হবে। আমরা প্রশ্নটির জবাব খুঁজতে চেষ্টা করব, একবিংশ শতকেও বা গল্পটি পাঠের জরুরত কতটুকু?
১৮৫৪ সনে গল্পটি প্রকাশের পর থেকেই এর অভিঘাতময় বার্তা চারদিকে আলোড়ন তোলে। জার শাসনামলের শেষের সেই দিনগুলোয় অন্যান্য প্রগতিশীল নাগরিকের মতো তুর্গেনেভ নিজেও ছিলেন ভূমিদাস প্রথার কঠোর সমালোচক। জমিদার পরিবারের সন্তান ছিলেন, বেড়ে উঠেছিলেন নিজের মাকে একজন অত্যাচারী জমিদারনি হিসেবে দেখে দেখে। ভূমিদাসদের ওপরে যথেচ্ছ অত্যাচার চালাতে পারদর্শী এ মহিলাটি তুর্গেনেভের শৈশবকে বড় বিবর্ণ করে তুলেছিলেন। সুতরাং তার রচনায় ঘুরেফিরে মানবতার এই বেদনা উঠে এসেছে নানান দৃষ্টিকোণে।
মুমু গল্পটিতে দেখা যায়, গেরাসিম নামের এক দৈত্যাকৃতি ভূমিদাসকে গ্রাম থেকে শহরে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন এক বৃদ্ধা জমিদারনি। প্রচণ্ড শারীরিক শক্তিধর গেরাসিম একাই চারজনের কাজ করতে পারে কিন্তু সে বোবা-কালা, বলতে গেলে সবাই তাকে ভয় পেয়ে চলে। শহরে এসে তাকে ভারী কোনো কাজ করতে হয় না। মালকিনের বাড়িটির আঙিনা ঝকঝকে তকতকে রাখা আর রাত্তিরে পাহারা দেওয়া, এই শুধু তার দায়িত্ব। মোটামুটি নিরুপদ্রব চলে যাচ্ছিল তার দিন। এর মাঝেই তাতিয়ানা নামের এক পরিচারিকাকে ভালো লেগে যায় তার। বোবা, কিছু বলতে পারে না। কিন্তু আকারে ইঙ্গিতে গেরাসিম সবাইকে বুঝিয়ে দিতে চায় যে, তাতিয়ানার ওপরে শুধু তার অধিকার। গল্পের বৃদ্ধা জমিদারনিকে বর্ণনা করা হয় পুরান প্রথার সমর্থক হিসেবে। অর্থাৎ সেই বৃদ্ধা পছন্দ করে অজস্র চাকর-বাকর পরিবেষ্টিত হয়ে দিন কাটাতে। এবং নিজের খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত ওদের ওপর চাপিয়ে দেওয়াটা ছিল তার এক পদের বিনোদন। সেরকম একটি বিনোদন হিসেবেই বৃদ্ধা তার চাকরদের মাঝে এক মুচি—কাপিতন ক্লিমভের সঙ্গে তাতিয়ানার বিয়ে ঠিক করে। বাড়িটিতে হল্লা পড়ে যায় গোপনে, এবার বুঝি আর গেরাসিমকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। তাতিয়ানাকে সে পছন্দ করে, এমনকি তার সঙ্গে কেউ কথা বলতে এলে পর্যন্ত অসুরের মতো লোকটা তাকে শাসিয়ে দেয়। আর এখন একদম কাপিতনের সঙ্গে তার বিয়ে? যদিও যথাসময়ে বিয়েটা হয়ে যায়, আর গেরাসিম কিছুই করে না, তাতিয়ানাও নিজের পছন্দ বিসর্জন দেয়—যেহেতু মালকিনের হুকুম। বিষণ্ণ হয়ে নিজের ঘরে পড়ে থাকে গেরাসিম, একা একা চলে যায় নদীর তীরে। তার হৃদয় ভেঙেছে এটা বোঝা চলে।
এ নদীর তীরেই একটি কুকুরছানাকে কুড়িয়ে পায় সে, অর্ধমৃত অবস্থায়—ঘরে তুলে এনে সন্তানের মতো যত্ন করে। গেরাসিমের একাকিত্ব কেটে যায় কুকুরছানাটিকে পেয়ে, ওর নাম সে রাখে মুমু। ধীরে ধীরে চারপেয়ে প্রাণীটি বড় হয়ে ওঠে এবং দেখা যায় চাকর-বাকর মহলে ওর কদর অনেক, ও যেন গেরাসিমের সন্তান। দু’কান লম্বা ও বড় বড় ভাবালু চোখের মুমু দিনমান আঙিনায় খেলে বেড়ায়, গেরাসিম যেখানে, সেখানেই মুমু—এমন হয় অবস্থা। কিন্তু বৃদ্ধা জমিদারনি পুনরায় হানা দেয় গেরাসিমের রাজ্যে। মুমুকে তুলে নিয়ে যায় আদর করবার জন্য। কিন্তু কুকুরের চেয়ে বিশ্বস্ত প্রাণী আর কী আছে? মালিক হিসেবে গেরাসিমকেই তার পছন্দ। একটি চাকরের কুকুর নিজের বশে আসছে না, এই ক্রোধে বৃদ্ধা হুকুম দিয়ে বসেন, ওকে যেন মেরে ফেলা হয়, ওর চিৎকারে রাতে তিনি ঘুমাতে পারেন না।
গল্পটা আসলে শুরু হয় এখান থেকেই।
প্রথমত গেরাসিম চেষ্টা করে মুমুকে লুকিয়ে রাখতে। ওতে স্বাভাবিক অসফলতা তার জন্য ভিন্ন কোনো পথ খোলা রাখে না। ভূমিদাসপ্রথা মানবতাকে কীরূপ হুকুমের শেকলে বন্দি করে ফেলেছিল, একজন ভূমিদাস চাইলেই সে শৃংখল ভাঙবার মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠত না—গেরাসিমের কর্মকাণ্ড তার উজ্জ্বল প্রমাণ। মালকিন তাকে গ্রাম থেকে শহরে এনেছেন, এটা হুকুম, সে অমান্য করেনি—শহরবাসে তার প্রথমদিকে কষ্ট হলেও মেনে নিয়েছে। মালকিন যখন তাতিয়ানার বিয়ে অন্য কারো সঙ্গে ঠিক করেছেন, সেটির প্রতিবাদের ক্ষেত্রেও সে অসাড় ছিল একই কারণে। পরবর্তী সময়ে যখন মুমুকে হত্যার হুকুম দেওয়া হয়, তখন ভিন্ন আচরণ গেরাসিম কিভাবে করতে পারত?
গেরাসিমরা তো একটা ছাঁচে তৈরি মানুষ, দাসপ্রথার কারাগারে যাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা—তারা নিজ থেকে সিদ্ধান্ত নেবার কথা জানে না কিংবা হয়তো বোঝেও না, কর্তার হুকুমই তাদের জীবনকে তাড়িয়ে নেয়। সেদিক থেকে ভাবলে গেরাসিম কিন্তু একদিক দিয়ে শেকল ভেঙেছে, মনিবের হুকুম সে মেনেছে যেহেতু এর বাইরে কী করতে হয় তার জানা নেই, মুমুকে—নিজের একমাত্র ভালোবাসাকে সে হত্যা করেছে নিজ হাতে, আর কাউকে কাজটা সে করতে দেয়নি। কিন্তু শহরের আবাসটিতে সে আর ফেরে না—গ্রামে পালিয়ে যায়। তখন প্রশ্নটা আবার উঠে আসে : গ্রামেই যদি পালাবে, মুমুকে সঙ্গে করেই কি পলায়নটা অধিক ভালো হতো না? নিশ্চয় ভালো হতো। কিন্তু আমাদের নায়ক যে গেরাসিম। মালকিনের যদি হুকুম থাকত শহর ছেড়ে আর গ্রামে ফেরা যাবে না, নিশ্চয় আমরা দেখতাম মুমুকে হত্যা করে নিজের বিলীন হৃদয় নিয়ে সে পুনরায় ফিরে গিয়েছে নিজের গুমটি ঘরে।
এই যে পালিয়েছে, ওটুকু গেরাসিমের প্রতি লেখকের কৃপা।
দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছে, জমিদারি আমল ফুরিয়েছে—কিন্তু অজস্র ভূমিদাসের সমব্যাথীগণ কি দুনিয়ার কোণায় কোণায় এখনো দিন পার করছে না? এই একুশ শতকের আধুনিক গেরাসিমরা তো নিজের অজান্তেই এক অদৃশ্য দাসপ্রথার উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে চলেছে। গেরাসিমরা জানত তারা দাস, কিন্তু আজকের মানুষেরা নিজেদের স্বাধীন জেনেই এক অদৃশ্য দাসত্ব মেনে নিয়েছে বেনিয়াতন্ত্রের কাছে। এই যদি সত্য হয়, দেড়শ বছর আগে লেখা তুর্গেনেভের মুমু কখনোই তার প্রাসঙ্গিকতা হারাবে না।