প্রকৃতিতে শরৎ এসেছে। হাওয়ায় দুলছে কাশফুল। আকাশে ভেজা তুলোর মতো মেঘমালা ছুটছে দিগন্তের দিকে। আজ ১৫ই সেপ্টেম্বর, দুদিন বাদেই ১৭ই সেপ্টেম্বর মহালয়া। এইরকম এক শরৎকালে ব্রিটিশ ভারতে ১৮৭৬ সালে বাংলার বুকে আরো এক শরৎ নেমে এসেছিলো। তিনি অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। শুভ জন্মদিন, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আজ ঘোরলাগা মহামারীর বুকে ‘শরৎ’ এসেছে নতুন কিছু উপলদ্ধি নিয়ে।
আমার প্রয়াত পিতার মুখে শরতের একটি কালজয়ী উক্তি শুনে শুনে বড় হয়েছি- “কোনো বড় ফলই বড় রকমের দুঃখভোগ ছাড়া পাওয়া যায় না”। চন্দ্রনাথ উপন্যাসে বাবা আমাকে পড়ে শুনিয়েছিলেন “যাহার প্রাসাদতুল্য অট্টালিকা নদীগর্ভে ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে, সে আর খান কতক ইট বাঁচাইবার জন্য নদীর সহিত কলহ করিতে চাহে না”। তখন কিশোর মন। কিছুটা বুঝতে পারতাম, কিছুটা বুঝতাম না। কিন্তু সাহিত্যপাঠে বাবার আসক্তি আমাকে কৈশোরে শরতের প্রতি মুগ্ধতা তৈরি করে। বাবার প্রিয় উপন্যাস ছিলো ‘গৃহদাহ’। ১৯৭৭ সালের ৫ই জুলাই তারিখে সদ্য কেনা বইটিতে আমার বাবার টাইপোগ্রাফি করা আছে। বাবা তখন ২৪ বছর বয়সের তরুণ! পারিবারিক লাইব্রেরি থেকে উপন্যাসটি প্রায়ই নামিয়ে পাতা উল্টাই। বাবা নেই কিন্তু ভাবি, বইয়ের প্রতিটি পাতায় আমার বাবার স্পর্শ আছে। তাঁর হাতের লেখায় তিনি এখনো বেঁচে আছেন বইয়ের পাতায়। মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠ্য সন্তান হিসেবে মুখাগ্নি করে তাঁকে দাহ করেছিলাম, কিন্তু মহামারীর এই দুঃসময়ে গৃহদাহ'র মতো উপন্যাসে বলা আছে মহামারীর সময় কী করতে হবে। মনে মনে ভাবছি, এটাই হয়তো বাবার রেখে যাওয়া শিক্ষা!
‘শেষ প্রশ্ন’ উপন্যাসে নায়কের মুখ দিয়ে শরৎ বলছেন, ‘মানুষের দীর্ঘ-জীবনে তাকে অনেক পা চলতে হয়, দীর্ঘ পথটির কোথাও কাদা, কোথাও পিছল,কোথাও উঁচু-নীচু থাকে, তাই লোকের পদস্থলন হয়; তারা কিন্তু সে কথা বলে না, শুধু পরের কথা বলে পরের দোষ, পরের লজ্জ্বার কথা চীৎকার করে বলে, সে শুধু আপনার দোষটুকু গোপনে ঠেকে ফেলবার জন্যই। মানুষের দুঃখটাই যদি দুঃখ পাওয়ার শেষ কথা হত, তার মূল্য ছিল না। সে একদিকের ক্ষতি আর একদিকের সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে পূর্ণ করে তোলে”।
বাংলা সাহিত্যের দীনবন্ধু মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ছিলেন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সম্ভ্রান্তবংশীয় জমিদার। সেযুগের শরৎচন্দ্র এক এবং একমাত্র সাহিত্যেরই জোরেই কলমে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। শরৎ তাই শরতের প্রস্ফুটিত কাশফুলের মতোই বিরাজমান। মহামারীর এই ঘোরলাগা পৃথিবী অনেকের কাছে নতুন মনে হচ্ছে। অথচ অবাক হলেও সত্যি, এই পরিস্থিতির বর্ণনা ভবিষ্যৎবক্তার মতো বলে গেছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর দুয়েকটি উপন্যাসে।
শরৎচন্দ্রের সময়টা ছিল বৃটিশ পিরিয়ড। পরাধীনতার শেকল ভেঙে এক নতুন জাগ্রত সমাজ তৈরির স্বপ্ন দেখেছিলেন শরৎ, তাই তার চরিত্ররা মহামারীতেও ভালোবাসায় জড়ায়, টানাপড়েনে ভোগেন, নৈতিকতায় ক্ষত-বিক্ষত হয়। অচল সমাজকে ভাঙার রিফ্ল্যাকশন দেখি 'পথের দাবী' উপন্যাসে। খুব মনে পড়ছে কৈশোরে পড়া সব্যসাচী, বিমলা আর অপূর্বদের জীবনবোধ তাড়িত মূল্যবোধ আর আকুতি! ভারতী আর অপূর্বের প্রেম হয় মহামারীর সময়। কী কঠিন এক পরিস্থিতিতে বিহ্বল সব সংলাপ।
কিংবা 'শ্রীকান্ত' উপন্যাসে আমরা দেখি পেনডামিক হিসেবে এসেছে বসন্ত! বার্মায় ছড়িয়ে পড়া মহামারীর মধ্যে সমাজ বদলের স্বপ্ন নাকি নিজেদের বদলের স্বপ্ন দেখবে শ্রীকান্ত আর রাজলক্ষ্মী? ওদিকে 'গৃহদাহ' উপন্যাসে বন্ধুর স্ত্রী অচলার প্রতি প্রেম তাড়িত অনুভবে বিপর্যস্থ হয়ে পড়ে সুরেশ। নৈতিকবোধে চালিত সুরেশ পাপবোধ থেকে নিষ্কৃতি পেতে পেনডামিকে সংক্রমিতদের সেবা দিতে চলে যায়।
পৃথিবীজুড়ে করোনাভাইরাসের প্রকোপ। কী এক অদৃশ্য জীবাণুর কাছে সুদৃশ্য পৃথিবী অচল! নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন ডাক্তার। চিকিৎসাবিজ্ঞান জেগে আছে হাসপাতালে হাসপাতালে। শ্রীকান্ত– উপন্যাসে 'quarantine' বলে একটি শব্দের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় বাংলা সাহিত্যের, শরৎ কি জানতেন, একদিন পৃথিবীজুড়ে চর্চিত হবে এই খটমটে শব্দটি? শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে মহামারি এসেছে অনেকভাবে। কখনো ভাঙা প্রেম, কখনো নৈতিক প্রশ্ন, কখনো আবার সমাজের অচলায়তন ভাঙার বিপ্লবী সংগ্রাম হিসেবে শরৎ এসেছে বহু ব্যঞ্জনায়। শরৎ এসেছে এই কোভিড-১৯-এর ভয়াবহতার মধ্যেও। শরতের চরিত্ররা আমাদের কাঁদায়, হাসায়, সাহস জোগায় কিন্তু দ্বিধায় ফেলে না। শরৎ মোহাচ্ছন্ন হয়ে রাখে কিন্তু মোহগ্রস্থ করে না। দেবদাস উপন্যাসে তিনি লিখছেন, ‘মানুষ এমনি দুঃসময়ের মাঝে আশা- নিরাশার কূলকিনারা যখন দেখিতে পায় না , তখন দুর্বল মন বড় ভয়ে ভয়ে আশার দিকটাই চাপিয়া ধরিয়া থাকে। যেটা হইলে তাহার মঙ্গল, সেইটাই আশা করে। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সেই দিক পানেই নিতান্ত উৎসুক নয়নে চাহিয়া দেখিতে চাহে’ । তুমুল ভালোবাসার মানুষের অবহেলাকে ঘিরে শরৎ কখনো নিরাশ হতেন না। তিনি মনে করতেন, ঘোর অন্ধকার-অমানিশার মাঝেও কিছু প্রদীপ দপ করে জ্বলে ওঠে। শরৎ তাঁর বড়দিদি উপন্যাস শুরু করেছেন এইভাবে- ‘এ পৃথিবীতে এক সম্প্রদায়ের লোক আছে, তাহারা যেন খড়ের আগুন। দপ্ করিয়া জ্বলিয়া উঠিতেও পারে, আবার খপ্ করিয়া নিবিয়া যাইতেও পারে। তাহাদিগের পিছনে সদা-সর্ব্বদা একজন লোক থাকা প্রয়োজন,– সে যেন আবশ্যক অনুসারে, খড় যোগাইয়া দেয়’। মারী ও মড়কে, ঝড়ে ও তুফানে এবং ব্যক্তির ভেতরের ক্ষয়ের মধ্যে এই চিত্র বহুবার দেখা গেছে। আজ একটা অণুজীব এসে গৃহবন্দী মানুষকে বুঝিয়ে দিলো পৃথিবী কতোটা অন্তঃসারশূন্য আড়ম্বরতায় ছিলো এতদিন।
শরৎকে বলা হয় অমর কথাশিল্পী। তিনি বলেছেন, ‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলে দেয়।’ পৃথিবীর বুকে ঘোরলাগা মহামারীতে শরৎ সাহিত্য আজো ভীষণ প্রাসঙ্গিক। দূরে ঠেলতে ঠেলতে ভালোবাসাকে যে আরো কাছে আনা যায়, তার বিপ্লবী বাণী শরতের মতো আর কে বলেছে? মহামারীর বুকে ঘোরলাগা সঙ্গরোধ নিস্তরঙ্গ সময়ে ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাসের পাতায় চোখ রাখলেই দেখবো- ‘আমি ঠকিনি, কারণ আমি ভালোবাসতে পেরেছিলাম। কিন্তু ঠকেছে সে, সে ভালোবাসতে পারেনি’।
রাজীব নন্দী, শিক্ষক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়