রবীন্দ্র-নজরুল প্রসঙ্গ ও সম্পর্ক
রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক বাংলা সাহিত্যে অনালোচিত ও উপেক্ষিত একটি বিষয়, যা নিয়ে নিবিড় গবেষণা ও বহুমাত্রিক চর্চার আবশ্যকতা রয়েছে। অনেকেই হয়ত জানেন না যে, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে নজরুল রচনা করেছিলেন এক মর্মস্পর্শী স্মরণ সঙ্গীত। রবীন্দ্র প্রয়াণের পটভূমিতে অসীম শ্রদ্ধার প্রলেপে অবিস্মরণী হয়ে আছে সেই গান: ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে/জাগাও না জাগাও না। ‘রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক এবং তার পরে‘ শীর্ষক এক প্রবন্ধে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন (কালি ও কলম, চৈত্র ১৪২৬, মার্চ ২০২০)।
শুধু তাই নয়, ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু সংবাদে নজরুল শোকে বিহ্বল-বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। শোকাচ্ছন্ন অবস্থাতেই তিনি পরপর তিনটি শ্রদ্ধাজ্ঞাপক কবিতা রচনা করেন। একটিতে বলেন ‘দুপুরের রবি ঢলে পড়েছে অস্তপারের কোলে’। কবিতাটি তিনি কলকাতা রেডিওতে যখন আবৃত্তি করছিলেন, তখন, আবৃত্তি করার সময়েই, তাঁর দেহে রোগাক্রমণের লক্ষণ দেখা দেয়। আবৃত্তি তিনি সম্পূর্ণ করতে পারেন নি। তাঁর জিহ্বা আড়ষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল। পরের বছর ১৯৪২ সালে মাত্র ২২ বছরের সৃষ্টিশীল জীবনের অবসান ঘটিয়ে নজরুল চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যান।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপাল, জীবনে ও কর্মে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী ব্যক্তিত্বের মানুষ হলেও তাঁদের যোগাযোগ, সম্পর্ক ও পারস্পরিক মনোভাব কেমন ছিল, তা সাহিত্যবোদ্ধা মাত্রই জানতে আগ্রহী হবেন। তাঁদের মধ্যে ব্যক্তিগত মিল ও অমিল এবং সম্পর্কের ইতিবৃত্তটিও তাঁদের আলাদা সাহিত্য রুচি ও বৈশিষ্ট্যের মতো পার্থক্যপূর্ণ হবে, এটাই স্বাভাবিক। তথাপি একই সময়কালের আগে ও পরে দু’জনের অবস্থান হওয়ায় তাদের পারস্পরিক সংশ্লেষ ও সম্পর্কের তুলনামূলক পর্যালোচনা সকলের বিশেষ মনোযোগের কারণ।
তবে, সমাজের দশজন সাধারণ মানুষের বিচারে যা প্রামাণ্য মাপকাঠি, তা দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে এবং তাদের সম্পর্ককে বিচার করা সংগত হবে না। কারণ সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে যা সম্ভব-অসম্ভব এবং স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়, তাঁদের ক্ষেত্রে তা সর্বত্র প্রযোজ্য নয়। যেমন, স্কুলে কোনো একজন কতোটুকু পাটীগণিত-বীজগণিত-ইংরেজি-বাংলা-ইতিহাস-ভূগোল ইত্যাদি শিখে কতোটা ভালো ফলাফল করেছে, সেটা একজন সাধারণ লোকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ডের বিষয় হলেও প্রতিভাবানদের ক্ষেত্রে তা কদাচ নয়। তাঁদের জীবনের দিকে তাকালেই এ সত্য প্রতিভাত হয়।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন স্কুল পালানো ছেলে। প্রথাগত শিক্ষা ও স্কুল ব্যবস্থার শক্ত কাঠামোর বিরুদ্ধে তাঁর এন্তার অভিযোগ ও অনেক সমালোচনা রয়েছে। তা সত্ত্বেও তিনি রবীন্দ্রনাথ হয়েছিলেন। এর ব্যাখ্যায় বলা যায়, তাঁর জন্ম হয়েছিল কলকাতার অত্যন্ত অভিজাত একটি পরিবারে। এ পরিবারের শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ছিল ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে অগ্রগণ্য এবং প্রায়-তুলনাহীন। প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না-হয়েও তাই সেই পরিবেশে লালিত-পালিত হয়ে একটি ছেলের পক্ষে রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠার বিশ্বাসযোগ্য একটা ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়।
কিন্তু বৃহত্তর বাংলার এক সুদূর প্রান্তবর্তী পাড়াগাঁয়ের ছেলে ‘দুক্ষু/দুখু মিয়া’ নজরুল ইসলাম হয়ে উঠলেন, সে এক অজানা ‘রহস্য‘। তাঁর অধিকাংশ জীবনী-লেখকরা সেই রহস্যের বিশ্বাসযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ না-দিলেও সর্ব-সাম্প্রতিক একটি নজরুল-জীবনী গবেষণার বিস্তারিত পরিসরে বিষয়টি তুলনামূলকভাবে আলোচিত হয়েছে: দুঃসহ দারিদ্র্য ও অশিক্ষার বন্ধন কাটিয়ে নজরুল কী করে নজরুল হলেন, সেটা কেবল একটা বিস্ময়ের ব্যাপার নয়, সেটা প্রায়-অবিশ্বাস্য ব্যাপার (গোলাম মুরশিদ, বিদ্রোহী রণক্লান্ত: নজরুল-জীবনী, ঢাকা: প্রথমা প্রকাশন, ২০১৮)।
নজরুলের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম পরিচয় লেখার মাধ্যমে, চাক্ষুষ ও সরাসরি নয়। এবং সেটা বাংলায় বা কলকাতায় নয়। বরং যোগাযোগের সময়কাল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঢামাঢোলের মধ্যে সিন্ধু প্রদেশের করাচির সেনানিবাসে, যেখানে সৈনিক নজরুল তখন অবস্থান করছিলেন আর রবীন্দ্রনাথ যথারীতি বাংলায়।
উল্লেখ্য, ১৯১৪ সালের জুলাই মাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হলে স্কুলের দেয়াল-পত্রিকায় সৈন্য বাহিনীতে যোগদানের একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় এবং তা দেখে কিশোর নজরুল বাঙালি পল্টনে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন। ঘটনাটি সবিস্তারে বিবৃত করেছেন অরুণকুমার বসু (নজরুল-জীবনী, কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০০০, পৃ. ২১)।
করাচির সেনানিবাসে নজরুল কী কী করতেন এবং কী কী পড়তেন, সে সম্পর্কে যে বিবরণ জানা যায়, তা হলো: ভাণ্ডারের দায়িত্ব পালন করতেন দিনের বেলা, রাতের বেলা করতেন লেখাপড়া। তিনি রবীন্দ্রনাথ পড়েছিলেন, বিশেষ করে কবিতা আর গান। তদুপরি, নজরুল করাচি থেকে কলকাতায় ফিরে আসার সময় সঙ্গে যেসব জিনিপত্র নিয়ে এসেছিলেন, তাতে ব্যবহার্য পোষাক ছাড়াও কবিতার খাতা, গল্পের খাতা, পুঁথি-পুস্তক, মাসিক পত্রিকা ও রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি ইত্যাদিও ছিল। পুস্তকগুলির মধ্যে ছিল ইরানের মহাকবি হাফিজের দিওয়ানের একখানা খুব বড় সংস্করণ। এ তথ্য দিয়েছেন নজরুল-সুহৃদ কমরেড মুজফফর আহমদ (কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা, কলকাতা: ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, ১৯৯৫, পৃ. ১৭)। তদুপরি গবেষক গোলাম মুরশিদ দাবি করেছেন, করাচিতে লেখা তাঁর গল্প ও অন্যান্য রচনায় বহু রবীন্দ্রসংগীতের উদ্ধৃতি আছে।
১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হওয়ায় ১৯২০ সালে সৈন্য বাহিনী ভেঙে দিলে নজরুল কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতায় তিনি বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মেসে উঠেছিলেন। পরে তিনি চলে আসেন মুজফফর আহমদের আস্তানায়। চলে আসার নেপথ্য কারণ ছিল সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি। এ প্রসঙ্গে তিনটি ভাষ্য পাওয়া যায়। তবে, এর ফলে তাঁর মনে হিন্দু-বিদ্বেষ তৈরি হতে পারতো, কিন্তু তেমনটা হয়েছিল বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং তিনি জাতিভেদ এবং ছোঁয়াছুঁয়ির তীব্র নিন্দা জানিয়ে কবিতা ও গান লিখেছিলেন, দাবি করেন গবেষক গোলাম মুরশিদ।
মুজফফর আহমদ বাংলাদেশের সদ্বীপে জন্মগ্রহণকারী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, যে দলটি ১৯২৫ সালে স্থাপিত হয়। কিন্তু ১৯২০-এর দশকে তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং নজরুলের মুক্তি কবিতা এবং হেনা ব্যথার দান প্রকাশ করেছিলেন। মুজফফর আহমদ থাকতেন ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে। নজরুলকে তিনি আহ্বান করেছিলেন যে সৈন্য বাহিনী থেকে কলকাতায় ফিরে তিনি যেন তাঁর মেসে ওঠেন। এসব ঘটনাবলীর বিবরণ রয়েছে মুজফফর আহমদের আত্মজৈবনিক গ্রন্থসমূহে (কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা, কলকাতা: ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, ১৯৯৫ এবং আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, কলকাতা: ন্যাশনাল বুক এজেন্সি ১৯৯৬)।
কলকাতার নতুন আবাসে ১৯২০-২১ সালের সময়কালে নজরুলের সঙ্গে সাহিত্য পরিমণ্ডলের যোগসূত্র নিবিড়ভাবে স্থাপিত হয়। শিক্ষিত মুসলমান যুবক ছাড়াও প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কবি-লেখকগণের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। কলেজ স্ট্রিটের আস্তানায় আগে থেকেই অনেক হিন্দু-মুসলমান কবি-সাহিত্যিক আড্ডা দিতে আসতেন। নজরুলের আগমনের পরে তাঁর গান এবং ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে সে আড্ডার পরিধি দ্রুত সম্প্রসারিত হয়। এ সময়ে যাঁরা আসতেন, তাঁদের কয়েকজনের নাম উল্লেখ করেছেন মুজফফর আহমদ। এঁরা হলেন শশাঙ্কমোহন সেন, গোলাম মোস্তাফা, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রলাল রায়, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, কান্তি ঘোষ, ধীরেন গঙ্গোপাধ্যায়, যোগীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, শান্তিপদ সিংহ। মোহিতলাল মজুমদারের নামও উল্লেখ করেছেন তিনি।
কলকাতার আবাসস্থল ৩২ নম্বরে আড্ডা দেওয়া ছাড়া নজরুল এ সময়ে আরো আড্ডা দিতে যেতেন গজেন্দ্রনাথ ঘোষের আসরে-বৈঠকে, যিনি ছিলেন মিত্র ও ঘোষ প্রকাশনীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও কথাসাহিত্যিক। মিত্র ও ঘোষ প্রকাশনীর সুদীর্ঘদিনের কর্মী ও পরবর্তীতে অন্যতম পরিচালক সবিতেন্দ্রনাথ রায় (ভাণু বাবু) নিজের তিন খণ্ডের স্মৃতিচারণে বিস্তারিত জানিয়েছেন যে (কলেজ স্ট্রিটে সত্তর বছর, কলকাতা: দীপশিখা প্রকাশন, ২০১০), সেখানে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে পরিচয় হয় নজরুলের। এ ছাড়া, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরচ্চন্দ্র (দাদা ঠাকুর). মতিলাল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের সঙ্গেও তাঁর পরিচয় হয়েছিল।
নজরুলের সঙ্গে দুজন গায়কের ঘনিষ্ঠতা জন্মে। তাঁদের একজন তখনকার কলকাতার নাম-করা রবীন্দ্রসংগীত-শিল্পী হরিদাস চট্টোপাধ্যায় আর একজন নলিনীকান্ত সরকার। পত্রপত্রিকার সূত্রে আরো অনেকের সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয়। তাঁদের মধ্যে অরবিন্দ ঘোষের কনিষ্ঠ ভ্রাতা বারীন ঘোষ, যিনি সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিলেন। রাজনীতির পথে নয়, সে সময় পত্রিকার সূত্রে নজরুলের পরিচয় হয় চিত্তরঞ্জন, ফজলুল হক এবং আরো অনেক কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিকের সঙ্গে।
তবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তখনো তাঁর সাক্ষাত-পরিচয় হয়নি। সে পরিচয় হয়েছিল পরের বছর (১৯২১)। কারণটি গোলাম মুরশিদ জানাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথ এ সময়ে একটানা ষোল মাস ইউরোপ-অ্যামেরিকায় ভ্রমণে ছিলেন।
কিন্তু কোনো কোনো জীবনীকার দাবি করেছেন যে, ১৯২১ সালের আগস্ট-অক্টোবর মাসের কোনো এক দিন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুল দেখা করেন। এ সম্পর্কে দু‘টি মত প্রচলিত আছে। প্রথম মতটি হলো, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় নজরুলকে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে নিয়ে যান। কিন্তু এ মতটিকে আপাতদৃষ্টিতে ভ্রান্ত বলেছেন গোলাম মুরশিদ। কারণ পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় কোথাও উল্লেখ করেননি যে তিনি নজরুলকে রবীন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি প্রতিদিন রবীন্দ্রনাথের কাছে যেতেন না যে, নজরুলকে নিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করার যোগ্য মনে করবেন না। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা তাঁর আত্মজীবনীতে (চলমান জীবন, কলকাতা: প্রতিক্ষণ পাবলিকেশনস, ১৯৯৪) বেশ বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে গেলেও তা লিপিবদ্ধ করতেন।
আরেকটি বিবরণে জানা যায়, ১৯২১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথের ষাট বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ তাঁকে একটি সংবর্ধনা দেয়। নাটোরের মহারাজা সে অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। কিংবদন্তী প্রচলিত আছে যে, এই সভায় রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে তাঁর পাশের আসনে বসার জন্যে আহ্বান জানান। অরুণকুমার বসু (নজরুল জীবনী, কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০০০) এমন দাবি করলেও অনেকের মতে তা সঠিক নয়। গোলাম মুরশিদ এই দাবি নাকচ করে বলেছেন, তখন পর্যন্ত নজরুলকে রবীন্দ্রনাথ চিনতেনও না। প্রশান্ত পালের রবি জীবনীতে কলকাতার প্রসিদ্ধ দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে এই অনুষ্ঠানের কার্যাবলীর দীর্ঘ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। তাতে নজরুলের কোনো উল্লেখ নেই। এই অনুষ্ঠানের মাত্র তিন সপ্তাহ আগে রবীন্দ্রনাথ প্রায় ষোলো মাস বিদেশে থাকার পর প্রথমবারের মতো কলকাতায় আসেন। এ সময়ে অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে তাঁর দিন কাটে। বেশ কয়েকটি সংবর্ধনা সভায় তাঁকে যোগ দিতে হয়। বিভিন্ন জায়গায় তিনি কয়েকটি বক্তৃতাও দেন। এর মধ্যে একটা বক্তৃতা ছিল টিকেট করে যোগদানের। মহাত্মার গান্ধীও তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসার কথা এ অনুষ্ঠানের দুদিন পরে। এতো ব্যস্ততার মধ্যে তখনকার করুণ ও অপরিচিত নজরুলের পক্ষে রবীন্দ্রনাথের দেখা না-পাওয়াই সম্ভব।
তবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথমবারের মতে নজরুলের দেখা হয় ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে। এ সময়ে পূজার ছুটিতে একদিন ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে নজরুল শান্তিনিকেতনে যান রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে। সেখানে নজরুল তাঁর আগমনী কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনান। কিন্তু এই তথ্যের বিষয়েও ভিন্নমত আছে। মুজফফর আহমদের বিবরণ অনুযায়ী দুর্গাপূজার ছুটিতে নজরুল কুমিল্লা যান। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি, তাঁর সঙ্গে দেখা করার গুরুত্ব এবং আকর্ষণ দুই-ই নজরুলের ছিল। কিন্তু এক কিশোরীও তাঁকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করছিল পূর্ব বাংলার মফস্বল শহর কুমিল্লার কান্দিরপাড় থেকে। সেটা অবশ্য প্রেম ও প্রত্যাখ্যানের বেদনাময় অন্য আরেক কাহিনী। ধুমকেতুর মতো গতিময় নজরুল জীবনের প্রায়-সকল ঘটনাই ঘটেছে চরম অস্থিরতার মধ্যে, সিদ্ধান্তহীন আকস্মিকতায় ও অপরিকল্পিতভাবে। তবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত গভীর ও সার্বক্ষণিক যোগাযোগের ভিত্তিতে পরিচালিত না হলেও তা নিবিড়তায় পরিপূর্ণ ছিল। রবীন্দ্র-নজরুল প্রসঙ্গ ছিল শ্রদ্ধা-স্নেহের প্রলেপে আচ্ছাদিত। নজরুলের প্রতি রবীন্দ্রনাথের শুভেচ্ছা, সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ছিল না। রবীন্দ্র-নজরুল প্রসঙ্গ ও সম্পর্কের সুবিস্তৃত আলোচনা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে ঋদ্ধ করবে এবং অখণ্ড বাংলা সাহিত্যের পরম্পরাকেও পরিপুষ্ট করবে।