গল্প
হেলমেট মানব
আজিম রাস্তায় হাঁটছে। কিন্তু চমকে যাচ্ছে বারবার। এ কোথায় এলো সে! আজিম ছাড়া সবার মাথায় হেলমেট। অথচ রাস্তার কোথাও কোনো মোটর সাইকেল নেই। হেলমেট পড়ে যে মারামারি করছে তাও না। প্রতিটা মানুষ স্বাভাবিক চলাফেরা করছে। অথচ মাথায় হেলমেট! কেবল আজিমের মাথায় কিছু নেই। হেলমেটের কারণে মুখের কিছুই দেখা যায় না। হেলমেটের সামনে অংশ কালো গ্লাস দিয়ে ঢাকা। হেলমেটের মানুষ হাঁটছে। ওই অবস্থাতেই কথা বলছে একে অপরের সাথে। কী অদ্ভুত। একটা বাস গেলো। বাসের যাত্রীদের সবার মাথায় হেলমেট। একেবারে মুখ ঢাকা।
আজিমের ঘোর কাটছে না। এ কোথায় এলো সে!
‘আজিম সাহেব?’
কে যেন ডাক দিলো।
‘কে, কে?’
চমকে উঠলো আজিম।
‘এই যে আপনার পেছনে।’
আজিম হকচকিয়ে পেছনে তাকালো। একটা লাল হেলমেট পরা মানুষ।
‘কে আপনি? আপনাকে চিনছি না তো। হেলমেট পরে আছেন কেন?’
হেলমেটের মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লোকটা হাসছে।
‘আপনিও পরবেন। সমস্যা নাই।’
‘দেখুন, হেলমেট না খুললে আমি কথা শুনব না। আপনাকে না দেখে তো আমি কথা বলছি না।’ আজিম রেগেই গেলো এবার।
লোকটা হেলমেট খুললো। আজিমের ঘোর কাটছে না। এ কি দেখছে সে!
লোকটার মাথাটা সংবাদপত্র দিয়ে মোড়ানো। চোখ নেই, নাক নেই। শুধু ঠোঁট, দাঁত আর জিহবা আছে। দাঁত দেখিয়ে হাসছে লোকটা।
লোকটার হাসি দেখে আশেপাশে আরো কয়েকজন হেলমেট মানব এলো। ওরাও দাঁড়ালো। আজিম খেয়াল করলো, সবাই গোল ওকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। হেলমেট খুলে ওরাও হাসছে জোরে জোরে।
ওদেরও সবার মাথা সংবাদপত্র দিয়ে মোড়ানো। এদেরও চোখ নেই, নাক নেই। দাঁত বের করে হাসছে আজিমের দিকে তাকিয়ে। যেন আজিম একটা কৌতুক।
একটা ঝাঁকুনি দিলো শরীরটা। মনে হলো হোঁচট খেলো। এতেই ঘুমটা ভাঙলো আজিমের। বিরক্ত মুখে বালিশের পাশে রাখা মোবাইল ফোনটায় সময় দেখলো। রাত ৪টা ২৯ মিনিট। কোনো মানে হয়? প্রায়ই ঘুম ভেঙে যাচ্ছে এই গভীর রাতে। স্বপ্নটা আবারো হানা দিয়েছে আজিমের চোখে। সেই একই স্বপ্ন। গরমে ঘেমে গেঞ্জি আর বিছানার চাদর এক হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। মগবাজারে আজিম যে বিল্ডিংটায় থাকে সেটা আটতলা। আজিম থাকে টপ ফ্লোরে। মাথার ওপরে ছাদ। আর ছাদ দিনভর সূর্যে তেতে থাকে। ফ্যানে আপাতত ঠাণ্ডা মেলে কিন্তু শরীরতো বিদ্রোহ করে।
তিন বেডরুমের ফ্ল্যাট বাসাটায় আজিম একটা রুমে থাকে। অন্য দুই রুমে থাকে সাদেক ও আফজাল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে হলে দুইজনই ছিল আজিমের রুমমেট। সাদেক এখন ব্যাংকার আর আফজাল কাজ করে ওষুধ কোম্পানিতে। পাস করে বের হওয়ার পর বাসাও একটা নেয়া একসাথে। সেই সাথে ডাইনিং রুমের জন্য একটা ডাইনিং টেবিল, ফ্রিজ আর কম দামের একটা সোফা সেট। ব্যাচেলর হলেও বাসাটাকে একটা পরিবারের স্পর্শে রাখা।
আজিম সাংবাদিক। সবচেয়ে দেরি করে বাসায় ফেরা লোক। রাত ১২টায় অফিস থেকেই বের হয়। বাসায় ফিরে বিছানায় যেতে যেতে রাত ১টার মত বেজে যায়। এরপরও যদি রাত ৪টার দিকে ঘুম ভেঙে যায় তাহলে মন ও মেজাজ কিছুই ভালো থাকার কথা না। এর ওপর বাড়তি যন্ত্রণা হয়ে এসেছে এক স্বপ্ন। সেটা দু:স্বপ্ন না ভালো কিছু সেটাই বুঝতে পারছে না আজিম। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় বিছানার পাশে রাখা স্টিলের গ্লাসটা শেষ করেও কাজ হলো না। ডাইনিং এ যেতেই হবে। এক বিন্দুও ইচ্ছা করছে না আজিমের। বাড়ি গেলে বিছানার পাশে বিশাল পানির বোতলটা রেখে দিয়ে যেতেন আজিমের বাবা, সিদ্দিকুর রহমান। সাথে একটা গ্লাস। রাতে যেনো রুম থেকে বের হওয়া না লাগে। রুমের দরজা লক করে না আজিম। ভোরের দিকে টের পেতো আজিমের গায়ে চাদর। কখন সিদ্দিকুর রহমান এসে চাদর দিয়ে ওকে ঢেকে দিয়ে গেছে টেরেই পায়নি সে।
রুমের দরজা খুলেই দেখে ডাইনিং রুমের বাতি জ্বালানো। ডাইনিং টেবিলে বসে পত্রিকা পড়ছেন সিদ্দিকুর রহমান!
আজিম অবাক হলো।
‘বাবা, আপনি কখন এলেন?’
পাজামা-পাঞ্জাবি পড়া সিদ্দিকুর রহমানের চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। চশমাটা হাতে নিয়ে ফ্রেমের কাঁচটা পাঞ্জাবির কাপড়ে পরিস্কার করলেন। এটা সিদ্দিকুর রহমানের অনেক পুরানো অভ্যাস।
‘তোমার এখানে আসতে আসতে রাত ৯টা বেজে গেলো। তুমি অফিসের কাজে এই সময় ব্যস্ত থাকো, সেটা আমি জানি। তাই ফোন করে বিরক্ত করিনি।’
‘কী বলেন? আপনি এসেছেন, আমাকে বলবেন না? এতক্ষণ ধরে এখানে? খেয়েছেন? বাসায় আসার পরও ডাকেননি কেন?’
আজিম ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সিদ্দিকুর রহমান রুটিন মেনে চলা লোক। খেয়েছেন কিনা ঠিক মত, না ঘুমিয়ে এখানে বসে থাকা?
‘আরে তুমি এত ব্যস্ত হয়ো না। এখানে বসো। আমি ঠিক আছি?’ সিদ্দিকুর রহমান হেসে বললেন।
‘আচ্ছা তোমার লেখা মনে হচ্ছে কম আসছে। কারণ কী?’
আজিম হাসলো।
‘বাবা, ইদানিং ডেস্ক সামলাতে হচ্ছে। বাইরে যাওয়ার সময় কম পাচ্ছি। তাই রিপোর্ট লেখার সময় কম মিলছে।’
‘এটা কী করে হয়। তুমি এত ভালো রিপোর্ট করো আর তোমাকে ডেস্কে বসিয়ে দিলো! এডিটর জানে না তোমার রিপোর্ট ভালো হয়?’
‘জানেন বাবা। তারপরও উনার মনে হয়েছে ডেস্কেও যদি সময় দেই তাহলে ভালো হয়। আর ইচ্ছে করলেই বাইরে গিয়ে স্পেশাল রিপোর্ট করতে পারি। তাতে এডিটরের কোনো না নেই।’
‘হুম। আর তুমি বাইরে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছো!’
আজিম যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য সাংবাদিকতা বেছে নেয় তখন সিদ্দিকুর রহমান বেশ খুশি হয়েছিলেন। আজিমের মনে আছে ছোট বেলায় ওদের বাসায় দুটো পত্রিকা দিয়ে যেতো হকার। ইত্তেফাক আর অবজারভার। বইয়ের চেয়ে বেশি প্রিয় ছিল আজিমের ওই দুই পত্রিকা। খেলার খবর, কত ছবি, কত শব্দ, কত কত বাক্য। পাস করে বের হওয়ার পরই একটা পত্রিকায় চাকরি হয়ে যায় আজিমের। সিদ্দিকুর রহমানের খুশি ধরে রাখে কে! ছেলের নামে যেদিন রিপোর্ট ছাপা হয় নিজে সেদিন বন্ধুবান্ধব ও স্বজনদের বাসায় পত্রিকা নিয়ে দিয়ে আসেন। ছোট্ট শহরে ছেলেকে বিখ্যাত বানিয়ে তুলতে সিদ্দিকুর রহমানের উৎসাহের কমতি নেই।
‘আপনি খাওয়া দাওয়া করেছেন?’ আজিম পানি দিল তাঁর বাবাকে।
‘হ্যাঁ, তোমার বন্ধুরা বেশ খাইয়েছে। খেয়েই তো ড্রইংরুমে হেলান দিয়েছিলাম। তাতেই ঘুম।’
‘ঘুম ভাঙার পর আমার রুমে যেতেন। এখানে বসে ছিলেন কষ্ট করে।’
‘তুমি খুব ক্লান্ত থাকো। বিরক্ত করতে ইচ্ছা করল না। তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করছিল। তাই চলে এলাম।’
‘ভালো করেছেন। কখন রওনা দিলেন?’
‘রওনা দেয়ার কথা সকালেই। কিন্তু দেরি হয়ে গেলো। প্রচণ্ড রোদ আর গরম মাথায় নিয়ে বের হলাম। বাসে উঠার পর বৃষ্টি। বাস থেকে নামার পর আবার গরম।’
বাইরে তাকালো আজিম। বিজলির চমক দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি নামবে দ্রুত।
‘এক কাজ করো। চা বানাও। তোমার জন্যও বানিও। চা খেতে খেতে গল্প করি।’
রান্নাঘরে যাওয়ার আগে নিজের রুমের আর ড্রইংরুমের জানালার গ্লাস টেনে দিলো আজিম। বৃষ্টিতে ঘর ভিজে যায়। ওদিকে ডাইনিংয়ে জানালার পাশেই বসেছেন সিদ্দিকুর। বাতাসে তাঁর পাতলা চুল উড়ছে। ৭০ এর বেশি বয়স হলেও চুলে কালো রং দেন তিনি। আজিম ভাবে, বাবাকে সাদা চুলে কখনোই ভালো লাগবে না।
‘জানালাটা লাগিয়ে দিব?’
‘না, থাক। তুমি চায়ের ব্যবস্থা করো।’
আজিম রান্নাঘরে যায়। বাবার জন্য চা বানানোটা সহজ। পানি গরম করলেই হয়। কাপে একটা টি প্যাক। আর কিছু না। আজিমও এভাবেই চা খায়। তবে চায়ে তার নেশা নেই।
চায়ে চুমুক দিলেন সিদ্দিকুর রহমান।
‘চায়ের সাথে কিছু খাবেন? মুড়ি আছে।’
‘না, তুমি বসো। দেশের কী অবস্থা?’
পত্রিকা সরিয়ে এক পাশে ভাঁজ করে রাখলেন সিদ্দিকুর।
‘আমি সাংবাদিক বলে আমার কাছে দেশের খবর সব থাকবে?’
আজিম ইচ্ছে করেই ওভাবে বললো।
‘অবশ্যই। তুমি দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছো। কাজ করছ খবর নিয়ে। মানুষ তোমার কাছেই তো খবর জানতে চাইবে। এটাই স্বাভাবিক।’
আজিম ভাবতে থাকে। এর কী উত্তর হতে পারে? আসলেই কি আজিম খবরের সাগরে ভেসে বেড়ায়? মানুষ চাইলেই কলসিতে করে বা বোতলে করে চাহিদা অনুযায়ী সাপ্লাই দেয়? কাগজের দাম বাড়ছে। মানুষ বাসায় পত্রিকা রাখা কমিয়ে দিচ্ছে। এখন অনলাইনের সময়। চাইলেই পকেটে থাকা ফোনেই খবর পড়ে নেওয়া যায়। আগে সারাদিন কাজ করে একটা সংবাদপত্র প্রকাশ হতো। এখন ওই পত্রিকার অনলাইন ভার্সন চলে এসেছে। যা মিনিটে মিনিটে খবর সাপ্লাই দেয়। তাতে তো কাজের ব্যস্ততা বেড়েছে। খুশি হওয়ার কথা। মুহিত সেদিন লিখেছে, ওজন কমানোর পাঁচ উপায়। সেটা সেদিন সবচেয়ে বেশি পঠিত সংবাদের তালিকার শীর্ষে ছিল। এডিটর পর্যন্ত বাহবা দিয়েছে ওকে। আমেরিকার নির্বাচন, ইউরোপের বাজারের খবর পর্যন্ত এখন মিনিটে মিনিটে আপডেট করা যায় দেশে বসে। কিন্তু, যমুনায় ভেসে যাওয়া গ্রামের স্কুলটার আপডেট কী? কবে আবার স্কুলটা চালু হবে সেই খবরটা মেলে না এত এত অনলাইনে। কাগজে আরো মেলে না। এখন কাগজের অনেক দাম।
‘থাক, দেশের অবস্থা বলতে হবে না। তোমার অবস্থা বলো। লেখাটা চালু রেখো। ছেড়ে দিও না। রিপোর্ট না লিখতে পারো এখন, কলাম লিখবে। তুমি কলামও ভালো লিখতে পারো।’
‘কলেজে পড়ার সময় ডিরোজিও কে নিয়ে একটা কলাম লিখেছিলাম। আপনার মনে আছে?’
`হ্যাঁ। ডিরোজিওর জন্মদিন উপলক্ষে লিখেছিলে। আমাদের শহরের সাপ্তাহিক পত্রিকাটায় ছাপা হয়েছিল সেটা। বেশ মনে আছে।’
‘এসএসসি পরীক্ষার পর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই সময় বইটি কিনে দিয়েছিলেন আপনি। এক উপন্যাসে কত চরিত্র, কত ইতিহাস। কত কত নায়ক।’
‘তোমার ওই লেখা ছাপানোর কয়েক দিন পর ওই পত্রিকার সম্পাদকের সাথে আমার দেখা। আমাকে বলে, স্যার লেখাটা আপনার ছেলেই লিখেছে নাকি আপনি সাহায্য করেছেন? দিয়েছিলাম ধমক। ও নিজেই লিখেছে।’
‘তাই নাকি। এ কথা তো বলেননি কোনো দিন?’ আজিম অবাক হয়।
‘ওতটুকু বয়সে তোমাকে ওই কথা বললে তোমার কনফিডেন্স কমে যেতো। আমার মনে আছে, উপন্যাসটা পড়ে তুমি ডিরোজিওর ওপর আরো দুইটা বই পড়ে ফেলেছিলে।’
আজিম চায়ে চুমুক দেয়।
আজিম ভাবছে, সে বাসায় এলো। তার বাবাকে চোখে পড়লো না কেন? এসেই অবশ্য নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকে দেয়। গোসল করেই ঘুম দেয়। অফিসেই রাতের খাওয়াটা সেরে ফেলে আজিম। ছোটবেলায় রাত সাড়ে আটটায় রাতের খাবার শুরু করতে হতো। সিদ্দিকুর রহমানের কড়া নির্দেশ। রাত আটটায় বিটিভির বাংলা সংবাদ শুরু। সেটা দেখে তারপর খাওয়া। আর ১০টার দিকে ঘুম। আজিম হলেও রাত আটটার দিকে খেয়ে ফেলতো। অভ্যাসটা এখনো আছে।
বাবা তো ওর ঘরেও শুয়ে থাকতে পারতো। আজিম আসলে কিছু মেলাতে পারছে না।
‘আমি বাসায় আসার পর আমাকে ডাকলেন না কেন? এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?’ আজিম এবার প্রশ্নই করে।
‘আরে ওদের সাথে খেয়ে ড্রইংরুমেই সোফায় হেলান দিয়ে বসে ছিলাম। কখন যে ঘুম এসে গেলো টের পাইনি। বাতিটাও নেভানো ছিল। তুমি হয়তো খেয়াল করো নি।’
এটা ঠিক। আজিম নি:শব্দে বাসায় ঢুকে। না পারতে ড্রইং বা ডাইনিংয়ের বাতি জ্বালায় না। এমনিতেই দেরি করে বাসায় আসে। এর ওপরে রাতে শব্দ করাটা আসলেও অন্য দুইজনের ওপর অন্যায়।
‘তুমি কেমন আছো সেটা বললে না কিন্তু।’ সিদ্দিকুর চশমার কাঁচ মুছলেন।
‘এইতো বাবা। চলছে।’
‘না। সামথিং রং। আমাকে বলো।’ সিদ্দিকুর ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন।
‘তেমন কোনো সমস্যা না।’
‘তাহলে যে স্বপ্নটা দেখছো, ঘুম ভাঙছে রাতবিরাতে সেটাকে সমস্যা মনে হচ্ছে না?’
‘বলেন কী? আমার এ কথা আপনি জানলেন কী করে?’ আজিম অবাক হয়। সাদেক বা আফজালের কেউ বলবে। এরা যে কী?
‘আমাকে বলো।’
আজিম পানি খেলো। সিদ্দিকুর এমনিতেই তাকে নিয়ে টেনশন করেন। এসব স্বপ্ন টপ্নের কথা বলে তাঁকে চিন্তায় ফেলার ইচ্ছা ছিল না আজিমের। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বাবাকে বললেই একটা সুরাহা মিলবে।
‘বিষয়টা তোমাকে নিয়ে হেলমেট মানবেরা হাসাহাসি করে ওই পর্যন্তই? নাকি আরো কিছু দেখো?’ সিদ্দিকুর জানতে চাইলেন।
‘মাঝে মাঝে একটু বেশিও দেখি। হঠাৎ এক হেলমেট মানব দৌড়ে আসতে থাকে। হাতে বড় একটা লাঠি। এটা দিয়ে সে আমার মাথায় জোরে আঘাত করে। তীব্র যন্ত্রণায় আমি মাটিতে বসে পড়ি। লাঠির আঘাতে আমার মাথাটা দুই ভাগ হয়ে যায়। বেরিয়ে যায় মগজ, রক্তে মুখটা ভরে যায়। আর….’
‘আর কী?’ সিদ্দিকুর মন দিয়ে শুনছেন।
‘মাথাটা ফেটে যাওয়ার সাথে সাথেই মাথাটা থেকেই কতগুলো বর্ণ, শব্দ দৌড়ে বের হয়ে গেলো! ঠিক যেমন কোনো বস্তা বা ব্যাগে আটকা ইঁদুর ছাড়া পেলে যেভাবে দৌড় দেয়, ঠিক সেই রকম।’
‘বর্ণগুলো বা শব্দগুলো কীসের?’
‘জানি না। আমি খেয়াল করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু এরপরই ঘটে আরেকটা ঘটনা। একজন হেলমেট মানব একটা সংবাদপত্র নিয়ে দৌড়ে আমার কাছে আসতে থাকে। আরেকজন হেলমেট মানব একটা হেলমেট নিয়ে আসতে থাকে। আমার মগজবিহীন রক্তাক্ত মাথাটা সংবাদপত্র দিয়ে মুড়ে দিতে থাকে। এমনকি চোখটাও ঢাকা পড়ে যায়। অন্ধকার হয়ে আসে সবকিছু।’
আজিম ঘামতে থাকে। শ্বাস নিতে থাকে জোরে জোরে। টেবিলে মাথা ফেলে দুই হাত দিয়ে মাথাটা ঢেকে রাখার চেষ্টা করে।
‘মাথাটা অসম্ভব যন্ত্রনা করে বাবা।’
‘হ্যাঁ। বুঝতে পারছো কী রক্ষা করা দরকার? ওই শব্দগুলো বেঁচে থাকুক, বর্ণগুলোও।’
‘এই আজিম। আজিম। উঠ। কীরে কী হলো তোর?’ সাদেক ডাকছে।
আজিম মাথা তুলে তাকালো, চোখে বিস্তর ঘুম।
‘কীরে, ডাইনিং টেবিলে ঘুমাচ্ছিস কেন?’ সাদেক অবাক হলো।
আজিম মাথাটা তুলে এদিক ওদিক তাকালো। সকালের রোদ এসে পড়েছে টেবিলে। গরমে ঘেমে গেছে আজিমের শরীর।
‘উঠে রুমে যা। রুমে গিয়ে ঘুমা। কখন এসেছিস এখানে?’
আজিম এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু খোঁজার চেষ্টা করলো।
‘কীরে কিছু খুঁজছিস?’ সাদেকের প্রশ্ন। আফজালও বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো।
বাসায় আর কেউ নেই। আজিম বুঝতে পেরে আর কিছু বললো না।
‘আমি ঠিক আছি। সমস্যা নেই। মুখ ধুয়ে আসছি। নাস্তা করব তোদের সাথে।’
‘আজিম, তুই বাড়ি যাবি কবে? ভাবছি ছুটি পেলে তোর সাথে যাব। কাকার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তোর সাথে না হয় থাকলাম দিনটা।’ আফজাল বলে।
‘তাই তো। কবে যেন আজিম?’ সাদেক বলে।
‘আগামী সপ্তাহে। ১৭ তারিখ। বাবার মৃত্যুর এক বছর হবে।’ আজিম খেয়াল করলো টেবিলে দুই কাপ চা। একটা শেষ হয়েছে। আরেকটাতে কেউ চুমুক দেয়নি।
পরিশিষ্ট
দুপুরে অফিসে যাচ্ছে আজিম। মেট্রোরেলের গেটের নিচে এক ভবঘুরে লোক বসা। এই গরমে তার গায়ে চাদর। দুই পাশে পুরানো ছেঁড়া কম্বল। এ ধরণের ভবঘুরে ঢাকা শহরে অনেক। তারপরও আজিম দাঁড়িয়ে গেলো। লোকটার মাথায় হেলমেট। এমন হতদরিদ্র, ভবঘুরে লোকটার মাথায় লাল একটা হেলমেট। যার সামনের দিকটা কালো গ্লাসে ঢাকা!
‘ভাই, ওরে কী দেখেন। পাগল। ওভারব্রিজ নাইলে মেট্রোরেলের গেটের কাছে বইসা থাকে হেলমেট পইরা, চাদর গা দিয়া। এখন দেখি এখানে বইসা পড়সে। কবে উঠব কে জানে।’
সিটি করপোরেশনের ঝাড়ুদার বলছিল আজিমকে এসব কথা।
হঠাৎ করে ভবঘুরেটা হেলমেটের গ্লাসটা উপরের দিকে তুললো। আজিমের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসলো।
আজিমের দিকেই তাকিয়ে বললো, ‘কীরে, হেলমেট পড়বি?’