সব সাহিত্যই এক অর্থে গূঢ় রূপকথা

প্রবন্ধ, শিল্প-সাহিত্য

মৌ কর্মকার | 2023-08-31 04:17:14

জীবিকার তাগিদ, মানুষের জীবনযাত্রার প্রকৃতির পরিবর্তন অথবা যুগের প্রয়োজনে সংসারের সবাই বিশেষ করে মা-বাবা দুইজনই চাকরি কিংবা বিভিন্ন কাজে রত। করছেন নিজ নিজ কাজ। বাসায় বসে একাকী  শিশু বাচ্চাটি। বিষয়টি আপনার নজরে পড়েছে কি? যদি না পড়ে তাহলে কিছু রূপকথার গল্প পড়ে আসুন! দেখতে পাবেন নাগরিক জীবনের এ ব্যস্ত বাস্তবতার চিত্র যেন আমাদের রূপকথার জগতকেই নির্দেশ করছে। সেই রাজকন্যার গল্প, একাকিত্বকে সঙ্গী করে বেড়ে উঠছিল যে। সে যেন আমাদের ফ্লাটে বন্দি এই শিশু বাচ্চাটিই। আমরা যদি গ্রিক রূপকথার একটি গল্প লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যায়—

‘এক দেশে ছিল এক ছোট্ট রাজকন্যা। কিন্তু রাজকন্যার মনে বড় দুঃখ ... তাঁর কোনো বন্ধু নেই! বিশাল রাজপ্রাসাদের চৌহদ্দীর ভিতরেই সারাটা দিন কাটে রাজকন্যার। কত দাস-দাসী... কত পাইক-পেয়াদা!... কিন্তু রাজকন্যার কোনো সাথী নেই, কোনো বন্ধু নেই... মনের সুখ-দুঃখের দুটো কথা বলে সময় কাটানোর কেউ নেই! তাইতো রাজকন্যার মনটা খুব ভার! রাজপ্রাসাদের ভিতরে ছিল খুব সুন্দর একটা বাগান। সেই বাগানে কত নাম না জানা গাছ... কত ফুল! কিন্তু ফুলের বাগানেও রাজকন্যার ভালো লাগত না.... তাঁর কোনো বন্ধু নেই যে! একদিন রাজকন্যা দেখতে পেল... সেই বাগানের এক কোণায় ফুটে রয়েছে একটা চমৎকার ছোট্ট ঘাসফুল। ছোট্ট ঘাসফুলটিকে রাজকন্যার মনে ধরল!...’

গল্পের শেষ পর্যায়ে হয়তো রাজকন্যার বন্ধু হয়ে গেল সেই ঘাসফুল। কি? এই গল্পের সাথে আমাদের বর্তমান সময়ের শিশুদের মিল পাওয়া যায়? এই ঘাসফুলটির জায়গায় বর্তমানে আমরা যদি কম্পিউটার বা মোবাইলের কথা বলি তাহলে কি খুব ভুল হবে? গল্পটিতে রাজকন্যার সবই আছে—বিশাল রাজপ্রাসাদ, দাসদাসী, নেই শুধু একজন বন্ধু।

আধুনিক জীবনের ব্যস্ত নগরীতে শিশুরা  সারাদিন বাসায় একা একা কম্পিউটারে সময় কাটায়। উপরের  রূপকথার গল্পের রাজকন্যার ঘাসফুল বন্ধুর মতোই বর্তমানে শিশুরা বন্ধু হিসেবে খুঁজে নিয়েছে কম্পিউটারকে। দিনের এক দীর্ঘ সময় মা-বাবার সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হয় অনেক শিশু-কিশোর। রাজকন্যার জীবনও অনেকটা এরকমই ছিল। তবে রাজপুরীতে থাকার কারণে  প্রেক্ষাপটটি একটু ভিন্ন হতে পারে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বর্তমানে দুরন্তপনার  শৈশবের কোনো উচ্ছলতা নেই, একাকিত্বকে সঙ্গী করে বেড়ে উঠছে  শিশু-কিশোররা। যে কারণে একাকিত্ব, মানসিক কষ্ট—এসব শুধু বড়দেরকেই নয়, দেখা যাচ্ছে শিশুদের ক্ষেত্রেও। অতিরিক্ত পড়াশোনা, খেলাধুলার অভাব, বিভিন্ন পারিবারিক সমস্যা শিশুদের ওপরও প্রভাব ফেলে এবং তারা একাকিত্বে ভোগে। মানসিক চাপের মধ্যে বড় হতে থাকে। এতে প্রভাব পড়ে একাকী শিশুর শৈশবে।

এখন বলতেই পারেন, রূপকথার গল্পের সাথে বাস্তব জীবনকে কি জন্য তুলনা করছি। সেক্ষেত্রে বলতেই হয়, একটু লক্ষ্য করে দেখুন তুলনা করার আগেই রূপকথার রাজকন্যা আর ফ্লাটের বন্দি শিশুর জীবন কিভাবে মিলে যাচ্ছে। একটু লক্ষ্য করুন!

ড. বরুণকুমার চক্রবর্তীর ‘বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতি কোষ’ গ্রন্থে বলা হয়েছে—‘রূপকথা মূলত ঐতিহ্যবাহী রচনা। কথাগুলোকে আপাতভাবে অবাস্তব, অর্থহীন, উদ্ভট মনে হলেও এগুলোতে এমন এক সার্বজনীন আবেদন আছে, যা সহজেই পাঠককে টানে।’ এখন প্রশ্ন করা যায়, কেন টানে? নিশ্চয়ই আমাদের জীবনের সাথে মিল আছে তাই টানে। তাইতো? রফিকউল্লাহ খান বলেছেন—‘লোকজীবনের রোম্যান্সলোকের বিচিত্র ভাণ্ডার অবলম্বন করেই অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জন্ম নেয় রোম্যান্টিক ন্যাশনালিজম। ঐতিহ্য সন্ধানের সূত্রে লোককথার গভীর তলে একেকটা জাতি পেয়ে যায় তাদের আত্ম-আবিষ্কারের ভূমিতল। যেখানে রাজপুরীও যেন বাস্তবসত্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। লোকমুখের কথা গ্রহণ করা হয়, লেখ্য পাঠকলায়। তাতে অনেক ‘ইমেজ’ অপ্রতুলভাবে ফুটে উঠে, রোমাঞ্চরস সঞ্চারিত হয়, দেশজ স্মৃতি-সত্তার পরিচয়  প্রদীপ্তি হয়। সাহিত্যে যুক্ত হয় স্বতন্ত্র আনন্দের অভিমুখ।’ ( কালি ও কলম, জুলাই ৩১, ২০১৮) আসলেই কিন্তু তাই, রূপকথা  তুচ্ছ করে না কিছুই, বরং রাষ্ট্রিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বেষ্টনীকে প্রাচুর্যময় করে তোলে। ভ্লাদিমির প্রপ, মিখাইল বাখতিন, ক্লোদ লেভি স্ত্রাউসের তত্ত্ব,  পোস্ট-কলোনিয়াল ব্যাখ্যায়  অথবা তুলনামূলক পদ্ধতির মাধ্যেমেও আমরা রূপকথার রাজপুরী ও রাজকন্যার সাথে আধুনিক রাজপুরীরূপী ফ্লাট ও ফ্লাটে বন্দি শিশুর জীবন নিয়ে আলাদা একটি পাঠ আলোচনা করতে পারি। উপরের গল্পে ও আলোচনায় রাজকন্যার সাথে শিশুর জীবনের মিল পাওয়া গেছে বলে মনে হয়!  এবার রাজপুরী নিয়ে আলোচনা করা যাক।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর রূপকথা সম্পর্কে  বলেছিলেন ‘জাতির আশায় স্বপ্নের ভাষায় অভাবনীয় সত্য সাহিত্য হচ্ছে রূপকথা।’ (ঘোষ, ২০০৭) এই সত্যতার প্রমাণ আমরা পেয়ে যাই ঠাকুর মার ঝুলির ‘ঘুমন্তপুরী’ গল্পে—

‘আর অমনি রাজপুরীর চারিদিকে পাখি ডাকিয়া উঠিল, দুয়ারে দুয়ারী আসিয়া হাঁক ছাড়িল, উঠানে হাতি ঘোড়া ডাক ছাড়িল, সিপাই তরোয়াল ঝনঝন করিয়া উঠিল; রাজদরবারে রাজা জাগিলেন, মন্ত্রী জাগিলেন, পাত্র জাগিলেন হাজার বচ্ছরের ঘুম হইতে, যে যেখানে ছিলেন, জাগিয়া উঠিলেন লোক লস্কর, সিপাই পাহারা, সৈন্যসামন্ত তীর-তরোয়াল লইয়া খাড়া হইল। সকলে অবাক হইয়া গেলেন, রাজপুরীতে কে আসিল!’ (ঘুমন্তপুরী)

অথবা আমরা যদি রুশ উপকথার একটি গল্প লক্ষ্য করি—‘বহুকাল আগে, ছিল এক রাজপুরী। সেখানে ছিল রাজা, রানী, রাজপরিবার, রাজদরবার, প্রজাকুল—সবাইকে নিয়ে হাসিখুশি এক রাজ্য। বিরাট ঝলমলে রাজপ্রাসাদ, হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, বিরাট সৈন্যবাহিনী, দেশজুড়ে ছড়ানো অজস্র সম্পদ। রাজার ছিল ঝকমকে এক রাজপুত্তুর...’ (রুশ উপকথার গল্প)

রূপকথার ঘটনাবলি অবিশ্বাস্য ও রোমাঞ্চকর হলেও ঘটনামূলে এবং পাত্র-পাত্রীর নামের সঙ্গে অনেক ঐতিহাসিক সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়। উপরের ঠাকুরমার ঝুলির ‘ঘুমন্তপুরী’ গল্প এবং রুশ উপকথাটি যেন তারই প্রমাণ। গল্প দুটি একটি আদর্শ রাজপুরীর চিত্র আপন মহিমায় অঙ্কন করে তুলেছে। রাজপুরীটি গঠিত হয়েছে রাজা, রানী, রাজপরিবার, প্রজাকুল, রাজপ্রাসাদ, হাতিশালা, ঘোড়াশালা, বিরাট সৈন্যবাহিনী ও রাজপুত্তুরের মাধ্যমে। এছাড়াও রূপকথার গল্পে রাজপুরী রাজ ভাণ্ডার, সুন্দর বাগান, দেবী আরাধনার ঝলমলে মন্দির, শুকপাখি/ স্বর্ণপাখি ইত্যাদি উপাদান সমন্বয়ে গঠিত হয়। এখানে রূপকথার রাজপুরীর যে বর্ণনা পাওয়া গেছে তাতে রাজপুরীর সুন্দর এক রেখাচিত্র অঙ্কন করা যায়।  যায় কি?



রূপকথার রাজপুরী

বর্তমানে আমাদের ফ্লাট বাসাগুলোর চিত্রও কিন্তু ঠিক এরকমই। ছোট এক বাসা যেখানে আছে ছোট বাগান, পুকুরের জায়গায় আছে সুইমিংপুল বা বাথটাব, হাতিশালা বা ঘোড়াশালার জায়গায় খাঁচায় বন্দি পাখি বা একুরিয়ামে বন্দি মাছ, শুকপাখির জায়গায় কম্পিউটার বা মোবাইল।

জগতের সেরা রূপশিল্পী পিকাসো বলেছেন—‘তুমি যা কিছু কল্পনা করতে পারো তাই সত্যি।’ আবার প্রিয় কবি ইয়েটস গল্পকারদের সম্পর্কে বলেছেন—‘তাহলে চলো আমরা গল্প বানিয়েরা, প্রাণে যা চায় নির্ভয়ে শুনিয়ে যাই। সবকিছু আছে সবকিছুই সত্যি।’ (আনন্দবাজার পত্রপত্রিকা, সংখ্যা :  ৩০ মে, ২০১৫) তাহলে আরকি! আমাদের কল্পনা বা স্বপ্নই যদি বাস্তবতাকে তুলে ধরতে পারে তাহলে বাস্তবতা থেকে আমাদের কল্পনাই শ্রেয়। তাইতো? সব মিলিয়ে বলতে গেলে সব সাহিত্যই এক অর্থে গূঢ় রূপকথা। যা আমাদের সামনে আমাদেরই বাস্তবতাকে তুলে ধরে।

সহায়ক গ্রন্থ
১. ঠাকুর মার ঝুলি, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, ২০১১।
২. দক্ষিণারঞ্জন রচনাসমগ্র (দ্বিতীয় খণ্ড), দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, মিত্র ও ঘোষ, ১৯৬১, কলকাতা।
৩. বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতি কোষ, ড. বরুণকুমার চক্রবর্তী, কলকাতা, ২০০৪।
৪. আখ্যানতত্ত্ব ও চরিত্রায়ণ, রফিকউল্লাহ খান, চারুলিপি প্রকাশন, ২০১১।
৫. দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার ও তাঁর ঠাকুরমার ঝুলি, বিশ্বজিৎ ঘোষ, ২০০৭, ঢাকা।
৬. আনন্দবাজার পত্রিকা,  অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়, ৩০ মে, ২০১৫।
৭. কালি ও কলম, সাহিত্য শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ক মাসিক পত্রিকা, আবুল হাসনাত, জুলাই ৩১, ২০১৮।

এ সম্পর্কিত আরও খবর