কায়সারবাগের কাকা-হুজুর

ভ্রমণ, শিল্প-সাহিত্য

মঈনুস সুলতান | 2023-08-31 04:28:04

সারা দুপুর সেন্ট্রাল রেঙুনের হাটবাজার ঘেঁটে ঘামে গরমে লবেজান হয়ে আমি ও হলেণ আমাদের ঘুমন্ত কন্যা কাজরিকে কাঁধে নিয়ে সুলে প্যাগোডার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবি—এবার যাওয়া যায় কোথায়? আমাদের সামনে সুলে প্যাগোডার সুনশান সোনালি স্থাপত্য। তার চারপাশের চুনকাম করা শপিং কমপ্লেক্সে ক্রেতা বিক্রেতার কোনো পাত্তা নেই। দিন কয়েক হলো আমরা রেঙুনের হাটবাজারে বিস্তর ঘুরছি। খুঁজে খুঁজে খরিদ করছি বর্মার তাঁতে বোনা বস্ত্র, সোনালি ল্যাকারে রঞ্জিত লক্ষীপ্যাঁচা, টিক কাঠের ট্রে ও জেড পাথরের হাতি। কাজরি সব সময় স্থির থাকতে চায় না, সুতরাং তাকে নিয়ে বেশিক্ষণ বাজার-সওদা করা মুশকিল। তাই আমরা তাকে বিরতি দিতে প্রায়ই চলে আসি সুলে প্যাগোডার ভেতরের আঙিনায়। মন্দিরের হিমেল বাতাবরণে সে ওখানে ছোটাছুটি করতে ভালোবাসে। জনা কয়েক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীনীদের সাথে তার ভাবও হয়েছে। মাঝেমাঝে সে তাদের সাথে পালকের ঝাড়ু হাতে মন্দিরের বিগ্রহ ছড়ানো পরিসরে ঝাট দিতেও হাত লাগায়। এ মুহূর্তে সে ঘুমিয়ে পড়েছে, এবং আমাদের খুব পিপাসা পেয়েছে বলে আমরা কায়সারবাগ রেস্তোরাঁর দিকে হাঁটি।

সুলে প্যাগোডার পেছনভাগে ওয়ারলেস টাওয়ারের ছায়া ধরে হেঁটে আমরা কায়সারবাগ রেস্তোরাঁয় ঢুকি। খুব সস্তা কাঠ ও টিন দিয়ে সম্প্রতি তৈরি রেস্তোরাঁর ঘরটি আশপাশের অন্যান্য দোকানপাটের ডিজাইন থেকে ভিন্ন, এবং মানের দিক থেকে এক নজরে তার গরিবি হালতও খুব স্পষ্ট। এ রেস্তোরাঁয় আমরা আরো বার কয়েক এসেছি। সেন্ট্রাল রেঙুনে আসলে এখানে বসে এক পেয়ালা দুধপাত্তি চায়ের সাথে চালের রুটি দিয়ে সুজির হালুয়া—আমাদের পারিবারিক প্রিয় খাবারের তালিকায় পড়ে। এখানকার খদ্দেরদের বেশিরভাই বর্মার মুসলিম অভিবাসি সম্প্রদায়ের বেকার তরুণ। কায়সারবাগের বর্তমান স্বত্বাধিকারীর পরদাদা অনেক বছর আগে লখনৌ থেকে বর্মাটিক কাঠের ব্যবসা করতে রেঙুন এসেছিলেন। লখনৌ শহরে কায়সারবাগ নামে নবাবী আমলের মশহুর একটি প্রাসাদ আছে। রেস্তোরাঁর বর্তমান মালিক তার পুত্র সে স্মৃতিতে আদনা এ চা-খানার নামকরণ করেছেন। বয়সের দিক থেকে মুরব্বি হওয়ার কারণে সকলের কাছে তিনি কাকা-হুজুর বলে পরিচিত। তাঁর আসল নাম এ অব্দি আমাদের জানার সুযোগ হয়নি।


সেন্ট্রাল রেঙুনের দৃশ্যপট

কাকা-হুজুরের বয়স হলেও তাকদ এবং তনদুরুস্তির দিক থেকে তিনি এখনো দড়ো আছেন। তাঁর দীর্ঘ কোঁকড়ানো দাড়ি মেহদি রঞ্জিত। উপর ও নিচের পাটি মিলিয়ে তাঁর মোট চারটি দাঁত খোয়া গেছে। তাই হাসলে তাঁর মুখমণ্ডলকে শিক-ভাঙ্গা জানালার মতো দেখায়। কারণে অকারণে তিনি লখনৌয়ের কবি তকী মীরের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিতে পছন্দ করেন। তাঁর কাউন্টারে ক্যাশবাক্সের পাশে ১৮৮৯ সালে লখনৌ থেকে ছাপা মীরের কবিতার একখান দিওয়ান হামেশা মজুদ থাকে। দিওয়ানের পাতাগুলো জিল ছিঁড়ে ঝুরঝুরে হয়ে গেছে। তাই তিনি শের-শায়েরীর কেতাবখানা তাঁতের কাপড়ে তৈরি বস্তনীতে সিজিলমিছিল করে রাখেন।

বেশ কিছুক্ষণ হলো আমরা কায়সারবাগে এসে বসেছি। কাকা-হুজুর আমাদের কোনো খোঁজখবর নিচ্ছেন না দেখে একটু অবাক লাগে। তাঁর খালি কাউন্টারে একটি আগরবাতি অযথা পুড়ে পুড়ে খুশবু ছড়াচ্ছে। আমরা পিপাসার্ত, তাই তাঁর খোঁজে কিচেন থেকে যে ফোঁকর দিয়ে চা-নাশতা সাপ্লাই দেওয়া হয়, তার সামনে এসে দাঁড়াই। রান্নাঘরে জ্বলন্ত চুলার উপর মস্ত এক হান্ডিতে কাকা-হুজুর হাতা দিয়ে কিছু নাড়ছেন। আমার সাথে চোখাচোখি হতেই তিনি কপালের ঘাম মুছে বলেন, ‘জেরা ইন্তেজার করো বেটা, আখনি পাকা রাহা হ্যায়।’ সাথে সাথে আমার নাকে এসে লাগে মশলাদার খুশবু। আমাদের কিন্তু বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না, গামছায় হাত মুছতে মুছতে দু’পেয়ালা লাচ্ছি হাতে কাকা-হুজুর আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান। তারপর খুব স্নেহের স্বরে হলেণের কাঁধে হাত রেখে বলেন, ‘বহুত পেরেশান লাগতা হ্যায়.. বাচ্চেলোক, শরবত লাচ্ছি পিয়া করো, আল্লাকা নাম লিয়া করো।’

আমরা হাতপাখা দিয়ে মাছি তাড়িয়ে ধীরেসুস্থে লাচ্ছি পান করতে থাকি। কাকা-হুজুর এখন কাউন্টারে বসে চশমা চোখে বস্তনী খুলে ঘাঁটছেন তকী মীরের শের-শায়েরী। আজ থেকে হপ্তা দুয়েক আগে পয়লা যেদিন তাঁর চা-খানায় আমরা এসে হাজির হই, তিনি আমাদের দিকে খুব তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। শ্বেতাঙ্গীনী হলেণের গাত্র বর্ণই বুঝি তাঁর অবাক হওয়ার কারণ। কপালে ভাঁজ ফেলে তিনি আমার নাম জানতে চেয়েছিলেন। আমি জবাবে ‘মঈনুস সুলতান’ বললে তিনি আমাকে শুধরে দিয়ে বলেন, ‘মোহাম্মদ মঈনুস সুলতান বলো বেটা।’ নামে মোহাম্মদ সংযোজনের তাঁর প্রস্তাব আমি বিনা বাক্যব্যয়ে কবুল করে নিলে—তিনি ভুরু কুঁচকে হলেণকে দেখিয়ে জানতে চান, ‘কৌণ হ্যায় উ হাসিন আওরত?’ জবাবে আমি কনফিডেন্টলি তাকে শাদি করা বেগম জানালে, তিনি শিক-ভাঙ্গা জানালা খোলার অভিব্যক্তিতে হো হো করে হেসে বলেন,  ‘তুমকো জরুর মীর ছাহেব ক্যা শ্যার শুনানো হোগা।’ তারপর তিনি বস্তনী বিছরিয়ে তকী মীরের দিওয়ান খোলেন। কিতাবখানার বয়স দেখে হলেণ রীতিমতো অবাক হয়। একটি হলুদ হয়ে আসা পৃষ্ঠা দেখিয়ে কাকা-হুজুর পড়েন, “মুহব্বৎসে হ্যায় ইন্তেজাম-এ জহাঁ/ মুহব্বৎসে গর্দিসমেঁ হ্যায় আসমাঁ।” অর্থাৎ “ভালোবাসার জন্যই তো সবকিছু/ আশমান ও তো চরকির মতো ঘুরছে তার টানে।” আচমকা শায়েরবাজিতে খানিক বিব্রত হলে কাকা-হুজুর কিতাব বন্ধ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলেন, “ভুখা হ্যায় তুম দুনো, ঠিক হ্যায়, পয়লা আল্লাকা নাম লাও, ইসকা বাদ হালওয়া রুটি খিলাও। ইয়ে খানে কা লিয়ে কই পয়সা উইসা দেনে কা জরুরত নেহি।”


কায়সারবাগে আদি কাঠের বাড়ি

ব্যাস্, মুফতে পয়লা দিন হালওয়া রুটি খিলানোর পর থেকে তাঁর সাথে আমাদের চাচা-ভাতিজার জানপহচান সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যায়। সেন্ট্রাল রেঙুনে আসলেই আমরা একবার করে কায়সারবাগে হাজিরা দিই। কিন্তু আজ কেন জানি কাকা-হুজুর নীরব হয়ে আছেন। হলেণ কায়সারবাগের দেয়ালে লটকানো একটি বড়সড় পিকচার ফ্রেমের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ ফটোগ্রাফ আগে আমরা খেয়াল করে দেখিনি। ছবিতে বর্মী কেতায় চমৎকার একটি কাঠের বাড়ির নিচে বড়বড় হরফে ইংরেজিতে হাতে লেখা ‘কায়সারবাগ’। আমি কৌতূহলী হয়ে ছবিটি কিসের তা জানতে চাইলে তিনি দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে যা বলেন, তার সারমর্ম হচ্ছে—মন্দিরের মতো চূড়োওলা টালির ছাদের প্রান্তে কাঠের ঝালর লাগানো সুদর্শন এ বাড়িটি তাঁর পরদাদা তৈরি করিয়েছিলেন পারিবারিক বাসস্থান হিসাবে। ওখানে একান্নবর্তী পরিবারের তিন প্রজন্ম একসাথে বাস করত। বাড়িটির নিচ তলার হলঘরে তেতাল্লিশ বছর আগে কাকা-হুজুর চালু করেছিলেন টি-স্টল কাম রেস্তোরাঁ। বর্মায় গোপনভাবে পরিচালিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত কিছু মুসলমান ছেলেপিলে এ চা-খানায় এসে বসত। পুলিশ তাড়া করলে তিনি তাদের কায়সারবাগের ছাদের কুঠুরিতে লুকিয়ে রাখতেন। বিষয়টি জানাজানি হলে পুলিশ তাঁর পিতামহের হাতে তৈরি কাঠের সুন্দর বাড়িটি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়। আজকাল সে ধরনের বাড়ি আবার তৈরি করা খুবই মুশকিল। বর্মাটিক কাঠ বাজারে পাওয়া যায় না, অলঙ্কৃত ছাদ তৈরি করার হাতযশওলা করিগররাও বিগত হয়েছেন। এ রকমের একটি ঘর তৈরির রসদপত্রও দারুণভাবে এক্সপেনসিভ। কাকা-হুজুরের সে কিমত নেই। তাই তিনি সাদামাটা কাঠ ও টিন দিয়ে নতুন ঘর বানিয়ে আবার কায়সারবাগ রেস্তোরাঁটি চালু করেছেন। ঘটনা শুনে আমি ও হলেণ তাকে হামদর্দির সাথে সহানুভূতি জানাই। তিনি ম্লান হেসে—সব আল্লাতালার ইচ্ছা বলে তকী মীরের আরেকটি শের আবৃত্তি করে শোনান, “জফায়েঁ দেখ লিয়ে, বেবফাইয়া দেখি/ ভলা হুয়া কেহ্ তেরি সব বুরাইয়াঁ দেখি।” অর্থাৎ “প্রভু তোমার অসীম দয়ার সাথে আশা দিয়ে আশহত করার নির্মমতাও দেখলাম/ তোমার খারাপ দিকটা দেখতে পেয়ে কিন্তু ভালোই হলো।”

এ শের শুনে অবশেষে বিষণ্ণ মনে কাকা-হুজুরের কাছ থেকে বিদায় নিতে যাই। তিনি হাত নেড়ে বলেন, “বয়ঠো বাচ্চালোক, জেরা বয়ঠো, আভি আরেক দফা পরওয়াদেগার কি নাম লাও, ইস কা বাদ থোড়া আখনি খিলাও।

এ সম্পর্কিত আরও খবর