মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খানদানি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় সর্বাগ্রে এগিয়ে এসেছে করোনা প্রকটিত ২০২০ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী লুইজ় গ্লিক'কে নিয়ে সবিস্তারে কথা বলার জন্য। আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে ও তার গীতল কবিতাকে উপস্থাপনের সঙ্গত কারণ এই যে, তিনি বহুপঠিত হতে চাননি। কয়েকজন মাত্র পাঠকের মধ্যেই থাকতে চেয়েছেন তিনি।
তথ্যপ্রবাহ ও মিডিয়া প্রাবল্যজনিত বৈশ্বিক ব্যবস্থায় অতীব আশ্চর্যজনক দৃষ্টান্ত তিনি। মার্কিনমুলুকের মতো দ্রুতলয় সমাজেও তিনি থাকতে চান আড়ালে। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তার দিকে সবার নজর যাবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি তো গোড়া থেকেই নিভৃতচারী। অতএব তাকে বিশদে জানানোর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজন সেই বাস্তবতারই বহিঃপ্রকাশ। উপরন্তু তিনি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের একজন ফ্যাকাল্টির কৃতিত্বের সুবাদে নিজেদের আত্মপ্রসাদ ছাড়বে কেন!
তার নিভৃতপ্রিয়তা সর্বজনবিদিত। একটি তাজা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে তার নিভৃতি সম্পর্কে। গ্লিক এতটাই আড়ালকামী যে, নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর সুইডিশ অ্যাকাডেমির পক্ষ থেকে তাদের রীতি অনুযায়ী যখন তাকে ফোনে যোগাযোগ করে প্রতিক্রিয়া চাওয়া হল, তখন শোনা গেল, কবি যথেষ্ট বিরক্ত। তার ফোন বেজে চলেছে। তিনি তার প্রাতঃ কফিসেবন করতে পারছেন না, এই বিরক্তি নিয়ে ফোন ধরলেন এবং বেশ রুক্ষ স্বরেই বললেন, দু’মিনিটের বেশি তিনি কথা বলতে পারবেন না। নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ায় তিনি ফোন রেখে দিলেন এই বলে যে, দু’মিনিট হয়ে গেছে, তাই তিনি আর কথা বলতে অপারগ!
এহেন চরিত্র প্রচারের দিকে কস্মিনকালেও তাকাবেন না। তথাপি প্রচার-প্রচারণায় না থেকেও আধুনিক আমেরিকান সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি লুইজ় গ্লিক (জ. ১৯৪৩)। প্রচারের আলোয় ছিলেন না কখনওই কিন্তু ছিলেন সাহিত্য বোদ্ধাদের নিবিড় পাঠের সীমানায়। তার কৃতিত্বের স্বীকৃতি সর্বদা তাকে পিছু করেছে। তিনি পুলিটসার পেয়েছেন, ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, ন্যাশনাল বুক ক্রিটিক সার্কেল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, ২০০৩-২০০৪ সময়কালে ছিলেন ইউএসএ-র পোয়েট লরিয়েট। ওবামা প্রশাসন গ্লিক-কে সম্মানিত করেছিল ন্যাশনাল হিউম্যানিটিজ় মেডল-এ। ওবামার সঙ্গে তার আন্তরিক ছবিটি এখন হট মিডিয়া আইটেম।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক এবং রাইটার-ইন-রেসিডেন্স গ্লিক এবার পেলেন ২০২০ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। নোবেল কমিটির সাইটেশন জানাচ্ছে, লুইজ় গ্লিক-কে এই পুরস্কার দেওয়া হল ‘for her unmistakable poetic voice that with austere beauty makes individual existence universal.’ উল্লেখ করা আবশ্যক, 'বিলাভেড' উপন্যাস খ্যাত কৃষ্ণ-মার্কিন লেখিকা টোনি মরিসনের (নোবেল পেয়েছিলেন ১৯৯৩ সালে) পর গ্লিক-ই প্রথম মহিলা আমেরিকান সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব, যিনি নোবেল পেলেন। তার বিজয়, প্রায়-তিরিশ বছর পর মার্কিন নারীশক্তির বিজয় কেতন রূপে উদ্ভাসিত।
গ্লিকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ফার্স্টবর্ন প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৮ সালে। তার সাম্প্রতিক তথা ত্রয়োদশ কাব্যগ্রন্থ ফেথফুল অ্যান্ড ভার্চুয়াস নাইট প্রকাশিত হয়েছে ২০১৪ সালে। নিভৃতচারী এই কবি প্রথমজীবনে বেশকিছু সময়ে মানসিক অসুস্থতার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন, সাইকোঅ্যানালিটিক ট্রিটমেন্ট করিয়েছেন। যেমন, কবি সিলভিয়া প্লাথ কিংবা টি. এস. এলিয়টের প্রথম স্ত্রী ভিভিয়েনও সম্মুখীন হয়েছিলেন।
কিন্তু সে-সবকিছু অবলীলায় অতিক্রম করে তিনি লিখেছেন এমন স্বতন্ত্র এক ভাষায় যা তাকে শুরু থেকেই আলাদা করে চিহ্নিত করে দিতে পেরেছিল।
তার কবিতায় যেমন গ্রিক পুরাণের পুনর্নির্মাণ আছে, তেমনই আছে অভিজ্ঞাত জীবনের বাস্তবতাজাত প্রতিধ্বনি:
My soul has been so fearful, so violent:
forgive its brutality.
As though it were that soul, my hand moves over you cautiously,
not wishing to give offense
but eager, finally, to achieve expression as substance...
(‘ক্রসরোডস’, আ ভিলেজ লাইফ)
লুইজ় গ্লিক এমন সময় নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হলেন, যখন পুরো পৃথিবী এবং বিশেষ করে বিশ্বের নারী সমাজ সঙ্কটের ক্রসরোডে। তার সম্মাননা আশা জাগাবে অবদমিত নারী জনগোষ্ঠীকে। নারীশক্তির জাগরণে সাহসের ঝিলিক হয়ে অন্ধকারে সিলভার লাইনিং রূপে বরাভয় জাগাবেন নিভৃতচারী অথচ প্রবল ব্যক্তিত্বময়ী লুইজ় গ্লিক।