শিশু-কিশোরদের জন্য কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ছড়া, কবিতা নজরুলপ্রেমীদের সামনে উপস্থাপন করার লক্ষ্যে নজরুলের কনিষ্ঠ পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর কণ্ঠে তা ধারণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে ছায়ানট (কলকাতা)। মহৎ এই উদ্যোগটির পরিকল্পনা ও পরিচালনা করেন ছায়ানটের (কলকাতা) প্রেসিডেন্ট সোমঋতা মল্লিক।
কাজটি করতে গিয়ে কল্যাণী কাজী প্রথিতযশা নজরুলকে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে-“নজরুল বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তাঁর অগ্নিদীপ্ত কবিতাগুলির পাশাপাশি, শিশুদের জন্যে লেখা কবিতাগুলিও শিশুসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। নজরুল ছোটদের ভীষণ ভালোবাসতেন। তাদের সঙ্গে সহজেই একাত্ম হয়ে পড়তেন। ছোটদের সঙ্গে এই অন্তরঙ্গতার জন্যে নজরুল তাদের মনটি সঠিকভাবে চিনতে পেরেছিলেন। তাদের মনের খবর নির্ভুলবাবে জানা ছিল বলেই শিশুসাহিত্যে তাঁর এত সাফল্য। শিশু-কিশোরদের জন্য নজরুলের প্রথম কবিতার বই ‘ঝিঙে ফুল’ ওনার যৌবন বয়সে লেখা। এই বইয়ের কবিতাগুলোতে শিশুদের সম্পর্কে নজরুলের কৌতুক, আনন্দ ও স্বপ্নের কথা, ভাষা ও ছন্দের ব্যঞ্জনায় এবং উপমা ও চিত্রকল্পের অসাধারণ প্রয়োগে হয়ে উঠেছে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এক্ষেত্রে তিনি এককথায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী বললে অত্যুক্তি হবে না। ছায়ানট (কলকাতা)-র উদ্যোগে, সোমঋতা মল্লিকের পরিকল্পনা ও পরিচালনায় ২৫টি ছড়া, কবিতা নিয়ে এই সামগ্রিক উপস্থাপনা। এই ঐকান্তিক প্রয়াস আপামর নজরুলপ্রেমী ও শিশুদের পাশাপাশি বড়োদেরও ভালো লাগবে, এই আশা রাখি।”
বাংলা সাহিত্যে বৈচিত্র্যময় এই বিরল প্রতিভার অধিকারী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি একাধারে জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি, প্রেমের কবি এবং মানবতার কবি। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কবি বহু উপাধিতে ভূষিত হলেও বিদ্রোহী কবি হিসেবে মানুষের শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে আত্মজাগরণ এবং অধিকার-মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরক হিসেবে তিনি সমধিক খ্যাতি অর্জন করেছেন।
উল্লেখ্য যে, সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তাঁর পদচারণা নেই। বীর রস, করুণ রস, হাস্য রস সবই বিদ্যমান তাঁর সৃষ্টিতে। তাঁর সৃষ্টির এক অনবদ্য সৃষ্টকর্ম শিশুসাহিত্য। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ইংরেজি বা য়ুরোপীয় সাহিত্যে শিশুকে যেভাবে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে, সে তুলনায় বাংলায় শিশু সাহিত্য তেমন সৃমদ্ধ নয়। তবে এক্ষেত্রে যারা অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন তাঁদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম অন্যতম। তিনি সাহিত্যের সকল শাখায় বিচরণ করার পাশাপাশি শিশুদের জন্য অসংখ্য ছড়া, কবিতা লিখেছেন। এসব ছড়া, কবিতা লিখতে গিয়ে তিনি অত্যন্ত চমৎকারভাবে শিশুদের উপলব্ধি করেছেন। তিনি বলেছেন- ‘আমি শিশু, আমি কিশোর।’
কবি নিজেকে শিশু-কিশোর ভেবেছেন বলেই শিশুসাহিত্য রচনা করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি উপলব্ধি করেছেন, শিশু মন অতিমাত্রায় খেয়ালি, স্বপ্নময় এবং কল্পনাপ্রবণ। শিশুর মনের সাথে একাত্ম হতে না পারলে, শিশু-ভাবে ভাবিত না হলে শিশুসাহিত্য রচনা একেবারেই অসম্ভব। শুধু তাই নয়, তাঁর মন ছিলো শিশুর প্রতি আশ্চর্য রকম সংবেদনশীল। এজন্যই হয়তোবা তিনি খুব সহজে শিশুদের সাথে একাত্ম হতে পেরেছেন এবং শিশুদের মনঃস্তত্ব বুঝতে সক্ষম হয়েছেন। এরই প্রমাণ মেলে কবির নিজ পুত্র কাজী অনিরুদ্ধকে লেখা চিঠিতে। তিনি পুত্রকে লিখেছেন- ‘
বাবা নিনামণি,
তোমারও চিঠি পেয়েছি- চমৎকার লেখা তোমার। তোমাকে এইবার সাহেব বাড়িতে চাকরি করে দেব। তোমার ফুল পেয়েছি। চমৎকার ফুল- সুন্দর গন্ধ। ভগবানকে দিয়েছি তোমার ফুল। তিনি তোমার ফুল পেয়ে খুশি হয়েছেন। তোমাকে চুমু দিয়েছেন তিনি। কালি ফুরিয়ে গেল তাই পেন্সিলে লিখছি, তোমরা বীর ছেলে হয়ে উঠবে, দুষ্টুমি করো না, কেঁদো না, জল ঘেঁটোনা। আমি রোজ তোমাদের দেখে আসি, চুমু খাই, তোমরা যখন ঘুমোও। চণ্ডীর সঙ্গে খেলা করবে। ঘুমোলে আমায় দেখতে পাবে। তখন আমি কোলে নিব। আরো ফুল পাঠিয়ো, তোমাদের ভগবানকে দেবো। এতগুলো চুমু নাও।’ ইতি- তোমার বাবা।
শিশুর মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা নির্ণয়ে নজরুলের উদ্ধৃত চিঠিটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এখানে কবি শিশুর অন্তরে প্রবেশ করে তথা শিশুর সাথে একাত্ম হয়ে নিজেই শিশুর পরিচয় দিয়েছেন। তাইতো তিনি শিশুর সাধ-স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা, হাসি-তামাশা, অনুকরণ প্রিয়তা, স্কুল জীবনের অভিজ্ঞতা, বাবা-মায়ের সাথে মান-অভিমান, বুড়ো দাদুকে নিয়ে হাস্যালাপ, অচিনপুরে দুঃসাহসিক অভিযান প্রভৃতি গভীরভাবে অনুধাবন করে সাহিত্যে রূপদান করেছেন। এছাড়াও তিনি অনুভব করেছেন, শিশুর জগৎ মাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। তাই শিশুর সকল চাওয়া-পাওয়া, মান-অভিমান মার কাছেই। শিশু অবাক বিস্ময়ে মাকে প্রশ্ন করে-
মাগো! আমায় বলতে পারিস
কোথায় ছিলাম আমি
কোন না জানা দেশ থেকে তোর
কোলে এলাম নামি ?
মাও শিশুকে ভালোবেসে উত্তর দেয়
তুই যে আমার, এই ত সেদিন
আমার বুকে ছিলি!
মা ও সন্তানের মধ্যে যে মধুর সম্পর্ক তারই চমৎকার বর্ণনা ফুটে উঠেছে উদ্ধৃত কবিতায়। এখানে বাৎসল্য রসের চরম সমন্বয় অনুসৃত হয়েছে। কবি শিশুকে ঘুম পাড়াবার জন্য যেমন ঘুম পাড়ানী গান লিখেছেন, তেমনি জাগরণী গীতও লিখেছেন -
ভোর হলো
দোর খোলো
খুকুমনি ওঠ রে!
ঐ ডাকে
জুঁই-শাখে
ফুল-খুকী ছোট রে!
খুকুমণি ওঠ রে!
নজরুল উপলব্ধি করেছেন, শিশু মন আশ্চর্য রকম কল্পনাপ্রবণ। কল্পনায় সে রথে চড়ে সূর্যিমামার আগে যেতে যায়। এই বিষয়টি কবি তাঁর অমর কবিতায় ফুটে তুলে ধরেছেন এভাবে-
আমি হবো সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুম বাগে
উঠবো আমি ডাকি।
শিশুসাহিত্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম অনেক ছড়া-কবিতা রচনা করেছেন। শিশু-কিশোরদের নিয়ে লেখা নজরুলের কবিতা তাঁরই কনিষ্ঠ পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর কণ্ঠে আবৃত্তি করে অডিও রেকর্ডিং-এর মাধ্যমে ধারণ করার মহতী উদ্যোগ গ্রহণ করে ছায়ানট (কলকাতা)। কবিতাগুলোর রেকর্ডিং প্রসঙ্গে কল্যাণী কাজী বলেন- ‘এই কবিতার কাজটা যে করলাম, এটা আমার কাছে ফিরে পাওয়া। ছোটবেলায় আমার প্রভাতী কবিতার মাধ্যমেই বাবাকে (কবি) চেনা। তিনি ছিলেন আমার প্রিয় কবি। আজ সেই প্রিয় কবির কবিতা, ছড়া নিজ কণ্ঠে আবৃত্তি করতে পেরে সত্যিই আমি আনন্দিত ও গর্বিত। এ কাজের মাধ্যমে আমি যেন আবার বাবাকে (কবি) ফিরে পেলাম। সর্বোপরি আমার এ কাজ তখনই সার্থক হবে যখন ভবিষ্যত প্রজন্ম এটাকে গ্রহণ করবে। আমি এ কাজের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের সকল নাতি-নাতনিদের মাঝে বেঁচে থাকতে চাই।'
মহৎ এই কাজটির পরিকল্পনা ও পরিচালনা করেন সোমঋতা মল্লিক। সোমঋতা মল্লিকের পরিকল্পনা আর পরিচালনায় মোট ২৫টি ছড়া, কবিতা ধারণ করা হয়। এগুলোর মধ্যে -চিঠি, ঘুম পাড়ানী গান, প্রভাতী, কালো জামরে ভাই, শিশু সওগাত, প্রার্থনা, বাংলা মা, খুকুমণি, আঁধারে, ভাই, আর্শীবাদ, পুতুল খেলা, মাতৃ-বন্দনা, প্রজাপতি, ক্ষমা কর হজরত্, আমি যদি বাব হতাম, নতুন পথিক, ঘুম জাগানো পাখি উল্লেখযোগ্য।
ভবিষ্যতে ছায়ানটের (কলকাতার) এ কাজ শিশুসাহিত্য নিয়ে অনুসন্ধিৎসু গবেষকদের গবেষণায় অনেকটাই সহায়ক হবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস। এছাড়াও কাজী নজরুল ইসলামকে শিশু সাহিত্যিক হিসেবে বিচার্যের ক্ষেত্রে কাজটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক