তখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা যেতো না। চারদিকে চলছিল স্বাধীনতা বিরোধিতার মচ্ছব। পরাজিত শত্রুদল শকুনি-থাবায় ক্ষত-বিক্ষত-রক্তাক্ত করছিল বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সুমহান চেতনা। ঠিক তখন, প্রচলিত ঘরানার বাইরে কোনো এক ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় মুক্তিযোদ্ধা-সাংবাদিক হারুন হাবীবের অনন্য উপন্যাস 'প্রিয়যোদ্ধা প্রিয়তম'।
মনে আছে, পাঠের প্রাথমিক প্রতিক্রয়ায় কয়েকদিন আচ্ছন্ন হয়েছিলাম। এতো বছর পরেও দিব্যি মনে আছে উপন্যাসের মূল কাঠামোর কথা, সাহসী আখ্যান, অকপট উচ্চারণ, রণাঙ্গন থেকে পূর্ব ইউরোপের আড্রিয়াটিক সাগরের তটরেখায় সঞ্চারিত বিপ্লব স্পন্দিত আবহ। যুদ্ধ, প্রেম ও সংগ্রামশীলতার প্রবহমান বৈশ্বিক ধারায় হারুন হাবীব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথাশিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন নান্দনিক বিন্যাসে এবং সাহসিক প্রত্যয়ে। মনে পড়ে উপন্যাসের নায়িকা ইয়াসমিনকার কণ্ঠে ধ্বনিত প্রত্যয়দীপ্ত উচ্চারণ: 'আমাদের যা কাজ তা আমরা করবোই। যেমনি করে তুমি করেছিলে তোমার দেশে, ১৯৭১-এ। আমার পূর্ব পুরুষেরা করেছিলো যুগোশ্লাভিয়াতে, চল্লিশের দশকের শুরুতে। যুগে যুগে বছরে বছরে, মুহূর্তে মুহূর্তে, স্থান থেকে স্থানান্তরে বিরুদ্ধবাদী সময় আসছে, আর আমরা চেষ্টা করছি তাকে পেরিয়ে যেতে।'
মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের কথাসাহিত্য সম্পর্কে যারা খোঁজ-খবর রাখেন, তারা জানেন, সত্তর ও আশি দশকের উপন্যাসে একাত্তরের বীরত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ ছিল উপেক্ষিত। আনোয়ার পাশা (রাইফেল রোটি আওরাত), আহমদ ছফা (ওঙ্কার), আমজাদ হোসেন (অস্থির পাখিরা, অবেলায় অসময়), মাহমুদুল হক (জীবন আমার বোন), রশীদ করিম (আমার যত গ্লানি), রাবেয়া খাতুন (ফেরারী সূর্য), রিজিয়া রহমান (রক্তের অক্ষর), রশীদ হায়দার (খাঁচায়, অন্ধকথামালা), শওকত ওসমান (জাহান্নাম হইতে বিদায়, দুই সৈনিক, নেকড়ে অরণ্য, জলাঙ্গী), শওকত আলী (যাত্রা), সেলিনা হোসেন (হাঙর নদী গ্রেনেড), হুমায়ূন আহমেদ (শ্যামল ছায়া), আবু জাফর শামসুদ্দিন (দেয়াল), মিরজা আবদুল হাই (ফিরে চলো, তোমার পতাকা), সৈয়দ শামসুল হক (নীল দংশন, নিষিদ্ধ লোবান, মৃগয়ায় কালক্ষেপ), হারুন হাবীব (প্রিয়যোদ্ধা প্রিয়তম) ছিলেন সেই বিরূপ পরিস্থিতিতে অগ্রণী কথাশিল্পী। যে তালিকায় পরে যুক্ত হন মাহবুব তালুকদার (বধ্যভূমি), আবুবকর সিদ্দিক (একাত্তরের হৃদয়ভষ্ম), হাসনাত আবদুল হাই (সাতজন), শহীদুল জহির (জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা), ইমদাদুল হক মিলন (ঘেরাও, কালোঘোড়া, মহাযুদ্ধ), মঈনুল আহসান সাবের (পাথর সময়, সতের বছর পর, ফিরে আসা)।
এইসব উপন্যাসসমূহের মধ্যে স্লাভ তরুণী ইয়াসমিনকা ও বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা হাসানের প্রেম কাহিনির সমান্তরালে মুক্তিযুদ্ধের আবেগ ও চেতনাকে মর্মস্পর্শী ভাষায় তুলে ধরেছিল 'প্রিয়যোদ্ধা প্রিয়তম'। শরীরে বুলেটের স্মৃতি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বেগবতী করেছিলেন এই উপন্যাসের সাহসী নায়ক। রণাঙ্গনের প্রত্যক্ষ মুক্তিযোদ্ধা, কথাশিল্পী ও সাংবাদিক হারুন হাবীব তার 'প্রিয়যোদ্ধা প্রিয়তম' উপন্যাসে নবতর বীক্ষণে, আন্তর্জাতিক আঙিকে ও গতিশীল আখ্যানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপ্রবাহকে স্ফুলিঙ্গের তেজে পাঠকের রক্তে প্রতিস্থাপিত করেছিলেন তৎকালীন স্তব্ধ বিরূপতাকে তছনছ করে। হারুন হাবীব নিজেই জানিয়েছেন, 'প্রথম উপন্যাস প্রকাশের আবেগ ছিল আলাদা, প্রথম যৌবনের অবাধ্য প্রেমের মতো। স্বাধীনতার ১০ বছরের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছিল 'প্রিয়যোদ্ধা প্রিয়তম'।'
উপন্যাসের বেশ কয়েকটি সংস্করণও হয়েছিল। এবার ২০২১ সালে নতুন মোড়কে 'অধুনা প্রকাশ' নিয়ে এলো স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী সংস্করণ। প্রচ্ছদ শিল্পী নাজিব তারেক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস চর্চায় এ ঘটনা তাৎপর্যবাহী এবং 'প্রিয়যোদ্ধা প্রিয়তম'র পাঠকপ্রিয়তার ঐতিহাসিক স্বীকৃতি স্বরূপ।