দিল্লির পাশেই ভারতের হরিয়ানা রাজ্য। সেখানে পানিপথ নামক স্থানে তিনটি বিখ্যাত যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। যে যুদ্ধগুলো উপমহাদেশের ইতিহাসে বদলে দিয়েছিল। পানিপথ শহরটি এজন্য 'উইভিং সিটি অফ ইণ্ডিয়া ' নামে পরিচিত। ২১ এপ্রিল ১৫২৬ সালে পানিপথের প্রথম যুদ্ধ জিতে ১৫২৬ সালে মধ্য এশিয়ার মুঘলরা অধিষ্ঠিত হয়েছিল ভারতবর্ষের ক্ষমতায়, যার নেতৃত্বে ছিলেন জহিরউদ্দিন মোহাম্মদ বাবর।
যুদ্ধটি হয়েছিল মধ্য এশিয়া থেকে আগত বাবরের সঙ্গে দিল্লির তৎকালীন সুলতান ইব্রাহিম লোদীর। ফলাফল মুঘল বিজয়। উল্লেখ থাকে যে এই যুদ্ধে বাবর প্রথম ভারতে কামানের ব্যবহার করেন। যে কারণে বাবর ইব্রাহিম লোদীর লক্ষাধিক সৈন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেও জয়লাভ করেন।
মুঘল সম্রাটরা ছিলেন মধ্য এশিয়ার টার্কো-মঙ্গোল বংশোদ্ভূত। তারা চাগতাই খান ও তৈমুরের মাধ্যমে চেঙ্গিস খানের বংশধর। ১৫৫৬ সালে আকবরের ক্ষমতারোহণের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্রূপদী যুগ শুরু হয়। আকবর ও তার ছেলে জাহাঙ্গীরের শাসনামলে ভারতে অর্থনৈতিক প্রগতি বহুদূর অগ্রসর হয়। আকবর অনেক হিন্দু রাজপুত রাজ্যের সাথে মিত্রতা করেন। কিছু রাজপুত রাজ্য উত্তর পশ্চিম ভারতে মুঘলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জারি রাখে কিন্তু আকবর তাদের বশীভূত করতে সক্ষম হন।
মুঘলদের শক্তিশালী সাম্রাজ্যিক কাঠামো ১৭২০ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়, শেষ প্রধান সম্রাট আলমগীর-আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। তার রাজত্বকালে সাম্রাজ্যতার সর্বোচ্চ ভৌগোলিক ব্যাপ্তি অর্জন করে। পরবর্তীতে হ্রাস, বিশেষ করে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসনামলে, পুরাতন দিল্লি এবং তার আশেপাশের অঞ্চলে, ১৮৫৭ সালের ভারতীয় বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ রাজ দ্বারা আনুষ্ঠানিকভাবে সাম্রাজ্য ভেঙে যায়।
মুঘল সাম্রাজ্য স্থানীয় সমাজে হস্তক্ষেপ করত না তবে প্রশাসনিকভাবে এসবের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা হত। অনেক বেশি কাঠামোগত, কেন্দ্রীভূত শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়। সম্রাট শাহজাহানের যুগে মুঘল স্থাপত্য স্বর্ণযুগে প্রবেশ করে। তিনি অনেক স্মৃতিসৌধ, মাসজিদ, দুর্গ নির্মাণ করেন যার মধ্যে রয়েছে আগ্রার তাজমহল, দুর্গ, মোতি মসজিদ, লালকেল্লা, জামা মসজিদ অন্যতম। তবে, আওরঙ্গজেবের শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্যের সীমানা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছায়। শিবাজির নেতৃত্বে মারাঠাদের আক্রমণের ফলে সাম্রাজ্যের অবনতি শুরু হয়। আওরঙ্গজেবের সময় দক্ষিণ ভারত জয়ের মাধ্যমে ৩.২ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটারের বেশি অঞ্চল মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হয়। এসময় সাম্রাজ্যের জনসংখ্যা ছিল ১৫০ মিলিয়নের বেশি যা তৎকালীন পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ এবং জিডিপি ছিল ৯০ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
১৮শ শতাব্দীর মধ্যভাগ নাগাদ মারাঠারা মুঘল সেনাবাহিনীর বিপক্ষে সফলতা লাভ করে এবং দক্ষিণাত্য থেকে বাংলা পর্যন্ত বেশ কিছু মুঘল প্রদেশে বিজয়ী হয়। সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার দুর্বলতার কারণে অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ সৃষ্টি হয় যার ফলে বিভিন্ন প্রদেশ কার্যত স্বাধীন হয়ে পড়ে। ১৭৩৯ সালে কারনালের যুদ্ধে পার্শিয়ান নৃপতি নাদির শাহের বাহিনীর কাছে মুঘলরা পরাজিত হয়। এসময় দিল্লি লুন্ঠিত হয়।
পরের শতাব্দীতে মুঘল শক্তি ক্রমান্বয়ে সীমিত হয়ে পড়ে এবং শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের কর্তৃত্ব শুধু দিল্লি শহরে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সমর্থনে তিনি একটি ফরমান জারি করেছিলেন। সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে ইংরেজরা তার বিরুদ্ধে রাজদ্রোহীতার অভিযোগ এনে কারাবন্দী করে। শেষে তিনি বার্মার রাজধানী রেঙ্গুনে নির্বাসিত হন এবং সেখানেই মারা যান। এভাবেই অস্তমিত হয় কয়েক শত বছরের মুঘল ঐতিহ্য।