রবীন্দ্রনাথ, পদ-পদবি-বিশেষণ ছাড়াই শনাক্ত-যোগ্য এক মহীরুহ। শুধুই 'রবীন্দ্রনাথ' যথেষ্ট, অনন্য, অসাধারণ, বহুমাত্রিক ও জ্যোতির্ময় রবীন্দ্রনাথের জন্য।
বিরূপ পরিস্থিতিতে, আশানুরূপ পরিস্থিতিতে, এমনকি করোনাকালের প্রায়-অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে শনিবার (৮ মে) মোতাবেক পঁচিশে বৈশাখ (১৪২৮ বঙ্গাব্দ) ১৬০-তম রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিনেও কথাটি সত্য। প্রায়-অর্ধ শতাধিক বছর পূর্বে পাকিস্তানি দুঃশাসনের দুঃসহ-বিরূপ পরিস্থিতিতেও কথাটি ছিল সত্য। কারণ, তখন 'রবীন্দ্রনাথ' নামটি উচ্চারণে যেমন বিপদ নেমে এসেছিল, তেমনি বর্তমানের মুক্ত আবহে 'রবীন্দ্রনাথ' উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার ও বাঙালির অসীমান্তিক সাহিত্য-দিগন্ত উন্মোচিত হয়।
আসলেই, রবীন্দ্রনাথ, পদ-পদবি-বিশেষণ ছাড়াই শনাক্ত-যোগ্য এক মহীরুহ। অথচ পাকিস্তানের স্বৈরশাসনে রবীন্দ্রনাথের নাম উচ্চারণ ছিল প্রায়-নিষিদ্ধ এবং বিপজ্জনক। তখন সেই ভয়ের প্রহর ভেঙে 'রবীন্দ্রনাথ' প্রকাশিত হয়েছিলেন 'স্টুডেন্ট ওয়েজ' থেকে আনিসুজ্জামানের সম্পাদনায়।
পাকিস্তান আমলে, ১৩৭৫ বঙ্গাব্দে কেবলমাত্র 'রবীন্দ্রনাথ' নামাঙ্কিত সেই গ্রন্থ বর্তমানে একটি ধ্রুপদী ও ঐতিহাসিক প্রকাশনায় পরিণত হয়েছে। বস্তুতপক্ষে পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রচর্চা যখন নিষেধের খড়গে আটকা পড়েছিল, তখন ১৯৫০ সালে মোহাম্মদ হাবিবউল্লাহ প্রতিষ্ঠিত 'স্টুডেন্ট ওয়েজ' অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের সম্পাদনায় প্রকাশ করে এই বাংলার কবি-লেখকদের রবীন্দ্র-শ্রদ্ধার্ঘ্য স্মারক'রবীন্দ্রনাথ'।
গ্রন্থের জন্য রবীন্দ্রনাথের একটি অসাধারণ প্রতিকৃতি অঙ্কণ করেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। অলঙ্করণ করেছিলেন শিল্পী কালাম মাহমুদ। প্রকাশক ছিলেন 'স্টুডেন্ট ওয়েজ'-এর প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ হাবিবউল্লাহর জেষ্ঠ্যপুত্র মোহাম্মদ ওহিদউল্লাহ।
ড. আনিসুজ্জামান পরে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। যেমন ২০১৬ সালে বেঙ্গল পাবলিকেশন্স লিমিটেড ঢাকা থেকে রফিকুন নবী প্রণীত প্রচ্ছদে প্রকাশ পায় আনিসুজ্জামানের রবীন্দ্র বিষয়ক গ্রন্থ 'তাঁর সৃষ্টির পথ'। কিন্তু ষাটের দশকে 'স্টুডেন্ট ওয়েজ' কর্তৃক প্রকাশিত আনিসুজ্জামান সম্পাদিত 'রবীন্দ্রনাথ' শিরোনামের গ্রন্থটির ঐতিহাসিক প্রাসঙ্গিকতা ও নান্দনিক মর্যাদা অপরিসীম। বাংলাদেশের রবীন্দ্রচর্চার ইতিহাসে এবং সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ আন্দোলনের পথ-পরিক্রমায় গ্রন্থটি দালিলিক প্রমাণ রূপে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
আনিসুজ্জামান সম্পাদিত ঐতিহাসিক গ্রন্থ 'রবীন্দ্রনাথ' ছাড়াও 'স্টুডেন্ট ওয়েজ' প্রকাশ করেছে আনোয়ার পাশার 'রবীন্দ্র ছোটগল্প সমীক্ষা', সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর 'সামন্তবাদের মুখোমুখি: বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র', মোহাম্মাদ আবদুল হাই সম্পাদিত ও সংকলিত 'রবীন্দ্র সুভাষণ'-এর মতো গবেষণাধর্মী, তাৎপর্যবাহী গ্রন্থ, যা প্রকাশনা গুণ ও মানগত উৎকর্ষতার প্রমাণবহ।
'রবীন্দ্রনাথ' শিরোনামের ও বিষয়ক গ্রন্থসমূহ ছাড়াও ৭০ বছরের অভিজ্ঞতা-লব্ধ প্রাচীনতম প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান 'স্টুডেন্ট ওয়েজ' এমন বহু গ্রন্থের প্রকাশক, যেগুলো কালের বিচারে উত্তীর্ণ হয়ে ক্লাসিকের মর্যাদা লাভ করেছে। যে তালিকায় মোহাম্মদ আবদুল হাই, আনোয়ার পাশা,আনিস সিদ্দিকী, মোবাশ্বের আলী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখের মতো বহু লেখকের অনেকগুলো বই রয়েছে।
'স্টুডেন্ট ওয়েজ'-প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ হাবিবউল্লাহ ছিলেন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের অন্যতম পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব। মননশীল ও সৃজনশীল গ্রন্থের প্রকাশনাকে বেগবান করে তিনি বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চা ও সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন। তার চার পুত্রের মধ্যে পরবর্তীতে দীর্ঘকাল পরিচালকের দায়িত্ব পালনকালে মোহাম্মদ লিয়াকতউল্লাহ প্রতিষ্ঠানের অভীষ্ট লক্ষ্যের প্রতি ছিলেন অবিচল।
'স্টুডেন্ট ওয়েজ'-এর তৃতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধি ও বর্তমান পরিচালক মোহাম্মদ মাশফিকউল্লাহ তন্ময় বলেন, 'আমাদের প্রকাশিত প্রতিটি বই-ই আমাদের কাছে অতীব মূল্যবান ও সংরক্ষণ যোগ্য। বই ছাপিয়ে ব্যবসা করার পর সেই বইয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করাকে প্রকাশনা নীতি ও নৈতিকতার সঙ্গে সম্পূর্ণ পরিপন্থী বলে আমরা মনে করি। স্টুডেন্ট ওয়েজ তার ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে প্রকাশিত প্রতিটি বইয়ের প্রতি যত্নশীল ও মনোযোগী। '
তিনি বলেন, 'এজন্যই আমরা ঐতিহাসিক প্রয়োজনীতায় 'রবীন্দ্রনাথ' শিরোনামের বইটিকে নতুনভাবে আলোচনায় নিয়ে এসেছি। যেমনভাবে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশা রচিত 'রাইফেল রোটি আওরাত' গ্রন্থটি প্রকাশেরও সুর্বণজয়ন্তী পালন করছি।'
স্টুডেন্ট ওয়েজ'-এর বর্তমান পরিচালক এবং বর্ষাদুপুর প্রকাশনীর নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ মাশফিকউল্লাহ তন্ময় বলেন, '১৬০ তম রবীন্দ্রজয়ন্তীতে আমরা ঐতিহাসিক প্রকাশনা 'রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে স্মরণ করি বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায়। কারণ, আমরা দৃৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করি যে, রবীন্দ্রনাথ' নামের বইটি নিছক একটি বই-মাত্র ছিল না, ছিল স্বাধীনতাকামী পূর্ববাংলা তথা বাাংলাদেশের মানুষের রবীন্দ্রচর্চার সপক্ষে ও সাাংস্কৃতিক অধিকারবোধের নিরিখে এক বলিষ্ঠ বুদ্ধিবৃত্তিক পদক্ষেপ ও সাংস্কৃতিক স্মারক।'