মন এক অদ্ভুত দেশের রাজ্য, যাকে বোঝা বা নিয়ন্ত্রণ করা খুব মুশকিল। তাই এর খেই না বুঝে আমরা আলেয়া নিয়ে চলি। বিজ্ঞানের কথা কতখানি আমরা সুস্পষ্ট বুঝতে পারি। তাই তো আমাদের কাছে উজ্জ্বল নয় যাদের মস্তিষ্ক, বোধ নিয়ে আমরা উচ্ছ্বসিত তাদের মনের গঠন কি খুব বৈজ্ঞানিকভাবে আমাদের কাছে সহজভাবে প্রকাশিত? আসলে মন বিষয়টা এরকম যেন এক গ্যালাক্সির মধ্যে কী এক খেলা। পৃথিবীর অসাধারণ সব চিত্রশিল্পী যাদের আঁকা শুধু আঁকা নয় ইতিহাসের মর্মবস্তু। আমাদের মন কখনো আমাদের আয়ত্তে কখনো আয়ত্তে থেকেও আয়ত্তে নয় অর্থাৎ যখন দ্বৈত রূপে কাজ করে। MICHELANGELO- যার নাম শোনেনি এমন মানুষ বোধহয় কম; সিস্টিন চ্যাপেলের সেই ঐতিহাসিক কর্ম যা বিশ্ববন্দিত। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. পল উলফের বিচারে তাঁর অজস্র কর্মের ভেতরে সুস্পষ্ট মস্তিষ্কজনিত বাইপোলার রোগের সংকেত পাওয়া গেছে।
পল গৌগিন- যাঁর বিশেষ বন্ধু ছিলেন ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ, মূলত সেরামিকস, স্কাল্পচারের কাজ করতেন। একটা লুকোনো হতাশায় তিনি ভরপুর থাকতেন। আত্মহত্যার চেষ্টাও তিনি করেছিলেন। ভিনসেন্ট ভ্যান গঘকে নিয়ে বহু কাহিনী আছে, তাঁর নিজের কানের কাহিনী সকলেই জানেন; তিনি ৩৭ বছর বয়সে নিজের বুকে নিজে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। জীবনের একটা বৃহত্তর সময় প্রবল এপিলেপটিক রোগগ্রস্ত ছিলেন, হতাশায় ভুগতেন। শিল্পী ফ্যান্সিসকো গোয়া যিনি প্যারানয়েড ডিমেনশিয়ার শিকার হয়েছিলেন। নিয়মিত জৈবিক, মানসিক পতনের মধ্যে দিয়ে তিনি বয়ে যাচ্ছিলেন। অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টকে সেইসময় অন্যমাত্রা দিয়েছিলেন নিউ ইয়র্কের মার্ক রথকো। হতাশার জর্জরিত জীবনে মৃত্যু তাকে আক্রান্ত করে তুলেছিল, নিজের ডান হাতের শিরা কেটে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন মানসিকতার সঙ্গে যুঝতে না পেরে।
রিচার্ড ড্যাড, ১৮১৭ থেকে ১৮৮৬- এই যাপনের সময়টুকুতে প্যারানয়েড স্কিজোফ্রেনিয়াতে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। অতিপ্রাকৃত ছবি তাঁর সৃষ্টির অন্যতম কাজ। তিনি মনে করতেন তিনি মানসিকভাবে ইজিপ্টের দেবতা অসিরিসের অধিকৃত এবং তাঁর পিতা ছিলেন একজন দানব (শয়তান)। তিনি খুন করতেও উদ্যত হয়েছিলেন একটা সময়ে। মানসিক হাসপাতালে থাকাকালীন অবশ্য তিনি তাঁর সৃষ্টির অনবদ্য রহস্যময় পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন। জীবনের যাপন ও বোধ, শিক্ষা, অভিজ্ঞতার এক অপূর্ব পরিস্রুতকরণে দার্শনিকদের আগমন বলে আমরা ভাবি। তাঁদের চিন্তায় মনন ও মস্তিষ্কের এক সাযুজ্যপূর্ণ মিল আছে। মন জিনিসটা যে এক প্রহেলিকা তা বলতেই হয় যখন জানতে পারি এইসমস্ত দার্শনিকরা কী ভীষণভাবে নিজস্ব জীবনে জর্জরিত! দার্শনিক ডেভিড হিউম যিনি স্কটিশ এনলাইটমেন্টের এক সক্রিয় সদস্য, যিনি ‘সায়েন্স অব ম্যান’ সূত্রের মাধ্যমে মানুষের ভেতরের অনুরণনকে বুঝতে চেয়েছিলেন, যিনি নিজেই ‘A SCENE OF THOUGHT’-এর প্রণেতা, তিনি নিজের অজান্তেই কখন নার্ভাস ব্রেকডাউনের আওতায় পড়তে শুরু করলেন বুঝলেন না।
মডার্ন ইকোনমিকসের লেখক যাঁর ‘weath of nations’ যুগান্তকারী বই, সেই দার্শনিক অ্যাডাম স্মিথও নার্ভাস ব্রেকডাউনের এমন আওতায় পড়লেন যে জীবনের বাকি অংশে নিজের সঙ্গে একা কথা বলা মানুষ হিসেবে পরিচিত হতে থাকলেন। শোনা যায় নাইটগাউন পরে একা একা রাতেরবেলা তিনি ১৫ মাইলও হেঁটে ফেলতেন কী এক অজানা ঘোরে। সেরা প্রাচীন দার্শনিকদের মধ্যে যাঁর নাম আসে, সেই সক্রেটিসের মানসিক অবস্থাজনিত ত্রুটি ছিল বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করতেন। আর অপূর্ব গল্প, উপন্যাস, কবিতা লেখা লেখকরা তো তুলনামূলক আরো বেশি সংখ্যায় মানসিক ত্রুটির সম্মুখীন হয়ে বেঁচে থেকেছেন, যাঁদের নাম বলে শেষ করা যায় না। লিও টলস্টয়, জনাথন সুইফট, ফিলিপ কে ডিক, এইচ পি লাভক্র্যাফট, হেমিংওয়ে, সিলভিয়া প্লাথ, ভার্জিনিয়া উলফ, এডগার এল্যান পো- এরা সকলেই জীবনের মধ্যে দ্বন্দ্বগ্রস্ত অবস্থায় বেঁচেছিলেন। কখনো হতাশায়, কখনো ভুলে জর্জরিত হয়ে, একাকীত্বে, অসহায়তায় জর্জরিত হয়ে বেঁচে থেকেছেন আবার সেই মানুষগুলোই অন্যদিকে বিশ্বের অন্যতম সব মাস্টারপিস রচনা করেছেন। একদিকে অতি সক্রিয়তা, একদিকে অসহায়তা এই দুয়ের মিলনে কী যে আলো জ্বলে উঠত আমরা তার কী বা বুঝি!
ভার্জিনিয়া উলফের শৈশবে তার নিজের পরিবারে যৌনতার অবৈধ, অস্বীকৃত অনুভূতি পাওয়া কোথাও তার মনের সহজ বৃদ্ধিকে নষ্ট করে দিয়েছিল। ওভারকোটের পকেট ভর্তি নুড়ি সমেত সাহিত্যের এক বিস্ময় নদীতে হারিয়ে গেল চিরকালের মতো স্বেচ্ছায়; কী যন্ত্রণা, কী অনুভূতি তার স্বাভাবিক যুদ্ধের ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল তা তার মনই জানে। আমেরিকান সাহিত্যের তারা হেমিংওয়ে, মদ্যপানের ক্রমাগত নির্ভরতায় মস্তিষ্ককে হারিয়ে ফেলছিলেন, নার্সিসিস্টিক মনোভাবের এক চূড়ান্ত পর্যায়ে বাইপোলারে রোগে আক্রান্ত হলেন, ইলেক্ট্রোকনভালসিভ (শক থেরাপি) থেরাপির একটা নির্দিষ্ট পর্বে যখন হয়তো তিনি সুস্থতার দিকে যাচ্ছিলেন বলে ভাবা হচ্ছিল তখনই এক ভোরে নিজের রিভলবার দিয়ে নিজের মাথায় গুলি করলেন। সিলভিয়া প্লাথের কবিতা পড়লে মুহূর্তরা আচ্ছন্নতায় ভরে যায়। সেই সিলভিয়া প্লাথের গ্যাসআভেনে মাথা রেখে মর্মান্তিক মৃত্যু বিশ্ববাসীর জানা কিন্তু কোথায় আমরা এর কারণ বুঝলাম! বুঝলাম না কারণ মন বস্তুটি নিজেই অবুঝ তাই আমাদের বোঝারও অতীত সে। তবে মস্তিষ্কের সমতা যা আমাদের বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন করে তাকে একটুখানি নিয়ন্ত্রণ করলে বোধহয় মানসিক স্বাস্থ্যের হালচালকে ধরার চেষ্টা করা যেতে পারে...