সেলিনা হোসেন। বাংলা ভাষাভাষিই শুধু নয়,বিভিন্ন ভাষার পাঠকের কাছে অতিপ্রিয় একটি নাম। প্রিয় সাহিত্যিক। কালোত্তীর্ণ নানা উপন্যাসে কিংবা গল্প লিখে জয় করেছেন অগণিত পাঠকের হৃদয়। মানুষের মণিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছেন অনেক আগেই। অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেছে তাঁর লেখক জীবনের। কথাশিল্পী সেলিনা হোসেনের হৃদপিণ্ডে বহুকাল ধরেই ঘটে চলছে নিরন্তর রক্তক্ষরণ। কিন্ত এই রক্তক্ষরণও তাঁকে দমাতে পারেনি সৃষ্টিশীলতা থেকে। দ্বিতীয় সন্তান প্রশিক্ষণরত বৈমানিক ফারিয়া লারা মৃত্যু বরণ করলে সেলিনা হোসেন ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু কন্যা হারানোর সেই শোককে শক্তিতে পরিণত করে সৃষ্টিশীলতার উর্বর ভূমিতে চষে সাহিত্যের সোনালি ফসল ফলাতে আবার ফিরে আসেন লেখার টেবিলে। সৃষ্টি করতে থাকেন একের পর এক সাহিত্যকর্ম।
সোমবার (১৪ জুন) পাঠক নন্দিত কথাকার সেলিনা হোসেন ৭৫ বছরে পা রাখবেন। জন্মদিনকে উপলক্ষ করে যাপিত জীবন, সাহিত্য সাধনা ও সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে সেলিনা হোসেনের মুখোমুখি হয়েছিলেন- সাহিত্যিক ও সাংবাদিক ইজাজ আহমেদ মিলন -
ইজাজ আহমেদ মিলন: আপনার কাছে জীবন মানে আসলে কী?
সেলিনা হোসেন: জীবনের সংজ্ঞা হলো অধিকারের মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার সত্যকে আলিঙ্গন করা। জীবনের সংজ্ঞা মানের অধিকারের সবটুকু অর্জন। আমার অধিকারের জায়গাটা পূর্ণ করার অর্থই হচ্ছে জীবন। মনুষ্যত্ব বোধের জায়গাটাকে বড় করে দেখাই হচ্ছে জীবন।
ইজাজ আহমেদ মিলন: সুখ-দুঃখ, আনন্দ বেদনার মধ্য দিয়েই তো বেড়ে উঠেছেন, সাহিত্য কর্ম অব্যাহত রেখেছেন। চলার পথটি নিশ্চয়ই মসৃণ ছিল না !
সেলিনা হোসেন: না, আমার চলার পথটা তেমন অমসৃণও ছিল না। জীবনে আমার হৈহুল্লুড় করার বড় একটা জায়গা ছিল। জীবনের চলার পথটি আমার মোটেও বন্ধুর ছিল না। তবে ব্যক্তিগত জীবনে আমার কিছু শোক আছে, দুঃখ আছে। আমার মায়ের মৃত্যু হয়েছে আমার হাতের ওপরে। আস্তে করে তিনি চলে গেলেন। আমি মেনেই নিয়েছিলাম মৃত্যু একটি অনিবার্য সত্য। যাপিত জীবনে কোনো দুঃখবোধই আমি বিশাল করে দেখিনি। মেয়ে হিসেবে আমি কখনো সামাজিক কোনো বিরোধিতার মুখে পড়িনি। পারিবারিক তো নয়-ই। আমার মা বাবা খুবই উদার মনের মানুষ ছিলেন।
ইজাজ আহমেদ মিলন: নানা রকম বাঁধা উপেক্ষা করে এ পর্যন্ত এসেছেন। এ ক্ষেত্রে আপনার জীবনসঙ্গী বীরযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন খানের ভূমিকা সম্পর্কে কিছু বলবেন ?
সেলিনা হোসেন: আমি একজন ভাগ্যবান মানুষ। আমি একজন ভালো মনের মানুষের সঙ্গে জীবনটা কাটালাম। আনোয়ার হোসেন কখনো আমাকে বলেনি রান্না করতে হবে, রান্না করছো না কেন? বরং ও ওল্টো বলতো- বলতো, তুমি লেখার টেবিলেই থাকো। রান্না ঘরে ঢুকে তোমাকে সময় নষ্ট করতে হবে না। সুতরাং আমি একটি স্বাধীন জীবন অতিবাহিত করলাম। আনোয়ারের কাছে অবশ্য এ জন্য আমার কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই।
ইজাজ আহমেদ মিলন: সাহিত্য সাধনার বাইরেও তো আপনার একটা বড় জগৎ আছে!
সেলিনা হোসেন: লেখালেখির বাইরেও আমি নানা রকম সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছি। এসব কাজকর্মে অংশ নিয়ে মানুষের মাঝে থেকেছি বলেই অভিজ্ঞতা পেয়েছি। শুধু ঘরের মধ্যে বসে আমি কী করতে পারতাম? সামাজিক দায়িত্ব পালন না করে যদি কেবল লেখালেখি করতাম, মনে হয় পারতামই না। মানুষের মধ্যে না গেলে আমি নিজেকেও বুঝতাম না। আমার শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল হাফিজ বলেছিলেন, মেয়ে হয়েছ বলে নিজেকে চার দেয়ালে বন্দী রেখো না, বিশ্বটাকে দেখো। খুব যত্ন করে স্যারের কথাটা মনে রেখেছি। লেখালেখির শুরুর পর থেকে অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় এক হাতে লেখালেখি, অন্য হাতে নানা বিষয়-আশয় সামলেছি। শত ঝড় ঝাপটাও লেখালেখি থেকে কখনো নিজেকে বিচ্ছিন্ন করিনি।
ইজাজ আহমেদ মিলন : ইদানিং একটা প্রসঙ্গ তরুণ লেখকদের মধ্যে আলোচিত হয়, সেটা হলো অনুবাদ। আমাদের অনেক দাপুটে লেখক ও লেখা থাকার পরও শুধুমাত্র ভাষার কারণে বিশ্ব পরিমন্ডলে আমাদের লেখাগুলো পৌঁছাতে ব্যর্থ। এক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান উদ্যোগী ভূমিকা নিতে পারে, নিশ্চয়ই...
সেলিনা হোসেন: তরুণ লেখকদের সঙ্গে আমি একমত। বাংলা একাডেমি অনুবাদের ব্যাপারে বড় দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে। কিংবা অনুবাদ কর্মের জন্য অন্য একটি প্রতিষ্ঠান করতে পারে সরকার। তরুণেরা যা ভাবছে তা নিয়ে ওরা সামনে এগিয়ে যাক।
ইজাজ আহমেদ মিলন: ছোট গল্প, উপন্যাস কিংবা নানা প্রবন্ধ নিবন্ধে আপনি সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। স্বপ্ন দেখেছেন। লেখার মধ্যে যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন এবং নিজে দেখেছেন তার কতটুকু পূরণ হয়েছে বলে মনে করেন ?
সেলিনা হোসেন: সামাজিকভাবে অবকাঠামোগত দিক থেকে কিছুটা পূরণ হয়েছে। যেমন মেয়েরা এখন অনেকেই স্কুলে যাচ্ছে, চাকুরিতে জায়গা হচ্ছে, তাদের উপার্জনের ক্ষেত্র হয়েছে। সেটা কিন্তু আগে একদমই ছিল না। কিন্তু মূল্যবোধের জায়গা থেকে, সামাজিক অবক্ষয়ের জায়গা থেকে আরো দমে যাচ্ছে বলে মনে হয়। এতো নির্যাতন, এতো অপরাধ, ধর্ষণ হচ্ছে। একটা জনজীবন কিভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় বারবার সে কথাই বলার চেষ্টা করি। কিন্তু সেটা কি সম্ভব হচ্ছে? প্রতিদিনই ধর্ষণের খবর পাচ্ছি, নির্যাতনের খবর পাচ্ছি। নানা অপরাধের খবর আসছে। জনজীবন মানেই তো শুধু পুরুষ না। জনজীবন মানে নারী শিশু কিংবা পুরুষ সব মিলিয়েই। সব কিছু মিলিয়ে জীবনের সমগ্রতা। এই সমগ্রতার একটা পিছুটান আছে। এটাকে অতিক্রম করতে হবে আমাদের।
ইজাজ আহমেদ মিলন: ‘ হাঙর নদী গ্রেনেড ’ আপনার তুমুল পাঠক প্রিয় উপন্যাস। পরবর্তী সময় এ উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। লেখার পেছনের গল্পটা শুনতে চাই।
সেলিনা হোসেন: আমি ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে, একটি বাসায় থাকি। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে রেসকোর্সে যাওয়ার সময় আমি কেমন আছি জানতে স্যার এলেন আমার সায়েন্স ল্যাবরেটরি কলোনির বাসায়। তার সাথে ছিলেন আমার খালাতো ভাই আবু ইউসুফ। কর্নেল তাহেরের বড় ভাই ছিলেন। তারা দুজনই আমাকে যুদ্ধের দুটি বাস্তব ঘটনা বললেন। স্যারের কাছ থেকে এক মায়ের গল্প শুনলাম, যিনি দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচানোর জন্য নিজের প্রতিবন্ধী সন্তানকে তুলে দিয়েছিলেন পাকিস্তনি সৈন্যদের হাতে। ঘটনাটি যশোরের কালীগঞ্জের। হাঙর নদী গ্রেনেডের এই ঘটনা বললেন এবং ওই মাকে নিয়ে স্যার আমাকে একটি গল্প লিখতে বললেন। ইউসুফ ভাই বললেন কর্নেল তাহেরের বাম পায়ের হাটুঁর ওপর কিভাবে এসে শেল পড়ে পা টি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায। রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমপর্ণ অনুষ্ঠানটি আমি দেখতে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওই দুটি ঘটনা শোনার পর আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি। আর যেতে পারিনি। প্রথমে ভেবেছিলাম, ছোটগল্পই লিখব। পরে মনে হলো, না, এই কাহিনীর যে ব্যাপ্তি সেটি উপন্যাসের। হাঙর নদী গ্রেনেড শুরু করেছি বুড়ির শৈশব থেকে। বারো ভাইবোনের মধ্যে একটি মেয়ে সচেতনভাবে তার বাবাকে বলছে তার নামটি বদলে দিতে। বুড়ির প্রতিবাদের এই জায়গা থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে নিজের সন্তানকে তুলে দেওয়া পর্যন্ত উপন্যাসটির পরিসর। একজন মা ভাবছেন, তাঁর নিজের সন্তানের বিনিময়ে দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচিয়ে দিলে তিনি স্বাধীনতা পাবেন। এই যে উৎসর্গ তিনি করলেন, এমন অসংখ্য উৎসর্গের বিনিময়ে তো আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের বিজয়। ১৯৭৪ সালের উপন্যাসটি প্রথম বের হয়।
ইজাজ আহমেদ মিলন: আগস্টের একরাত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা একটি উপন্যাস। বঙ্গবন্ধু আপনার লেখাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে ?
সেলিনা হোসেন: বঙ্গবন্ধু একজন মানুষ যাকে নিয়ে একটা পুরো সাহিত্য জগৎ তৈরি করা যাবে। শুধু আমার লেখায় কেন, বঙ্গবন্ধু একটি জাতির জীবনকে প্রভাবিত করেছে।
ইজাজ আহমেদ মিলন: বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো আপনার বৈমানিক কন্যা ফারিয়া লারা সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।
সেলিনা হোসেন: ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরের ঘটনা। ফারিয়া লারার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। আকাশে উড়তে উড়তেই এক সময় ওর বিমানটা নেমে এল মাটির দিকে। কিছু বোঝার আগেই লারা হয়ে গেল অতীতের একটি নাম। দু’জন ছিল এয়ার পারাবতের বিমানটিতে। দুই আসনবিশিষ্ট সেসনা প্রশিক্ষণ বিমানটি পোস্তগোলা শ্মশানঘাটের কাছে এলে ইঞ্জিনে আগুন লেগে যায়। সেখানেই জ্বলন্ত বিমানটি আকাশে ডিগবাজি খেয়ে নেমে আসে মাটিতে। ফারিয়া লারা শেষবারের মতো দেখেছিলেন নিঃসীম নীলাকাশ। এরপর ...। আর বলতে পারছি না। চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসছে।