'প্রেমে পড়া বারণ, কারণে অকারণ,
আঙুলে আঙুল রাখলেও হাত ধরা বারণ'
আমার একুশে পা দিতে চলা প্রবাসী কন্যা দিনরাত এই গান গুনগুন করে চলেছে। এবং লিফটে দেখা হলেও প্রতিবেশী প্যালেস্টাইনের যুবককে জেরুজালেমের অরাজনৈতিক-অস্পর্শকারত ইস্যু আবহাওয়া শুধোচ্ছে না। সমুদ্রের ধারের কফিশপে তরুণ তুর্কীকে দেখেও তাঁর কোনো উত্তেজনা নেই। এই অতিমারির সময়ে মাইক্রোবায়োলজি ছাড়া তাঁর ভাবনায় কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে না!
কিন্তু এটা তো আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। স্টার্টআপ আর ইউনিকর্ন নিয়ে ব্যস্ত থাকা তরুণ প্রজন্মের একটা ভীষণ ফোকাসড অংশকে কাছ থেকে দেখা।
কিন্তু বর্ষায় প্রথম কদম ফুল দেখলেই যাঁদের হৃদয়ের একূল ওকূল ছাপিয়ে যায়, তাঁরাও তো আছেন। হাফ সেঞ্চুরির দোরগোড়ায় দাঁড়ানো আমার যে বন্ধু স্কুলের যে 'ক্রাশ'কে আবার দেখে ফোনে বলল, একদম একরকম দেখতে আছেন, জানিস! তাঁকে তো কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না, ক্লাস সেভেনে যাঁকে তুই স্কুলের সামনে কলেজ স্ট্রিটে রোজ দেখতিস, রাতে বাড়ি ফিরে স্বপ্নেও যাঁর কথা ভাবতিস, ৩৬ বছরের ব্যবধানে তিনি, সেদিনের সেই তরুণী একরকম থাকতে পারেন না! চুলের ছাঁট আর শাড়ির রং এক থাকলেও মানুষটা যদি এক থাকতো তাহলে যযাতির নাম নিয়েও আলোচনা হতো না, 'অ্যান্টি এজিং ক্রিম' নিয়ে মাতামাতিও থাকতো না।
কিন্তু হৃদয় বায়োলজির জ্ঞান শুনতে চায় না। অন্তত এই বর্ষায় এই বা ওই বঙ্গে তো নয়ই। চারপাশে সবাই প্রেম, পরকীয়ায় এক্কেবারে হাবুডুবু খাচ্ছে। অবশ্য আমার এক কালের সিনিয়র সহকর্মী, সম্পর্ক নিয়ে বিশেষজ্ঞ রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক কাল আগে রাতে বাড়ি ফেরার সময় বলেছিলেন, শোনো, পরকীয়া বা অবৈধ বলে কিছু হয় না, আসলে সবই প্রেম। তখনও অবশ্য আমি জানতাম না, রাতে বাড়ি ফেরার সময় সবাই দার্শনিক হয়ে যায় আর সকালে উঠে সংসারী এবং শেয়ার বিশেষজ্ঞ!
যাই হোক, কলকাতায় ভোটের আবিরের রং গা থেকে মুছতে না মুছতে এ বঙ্গে প্রেমের আবির সবাইকে রাঙিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। চাটুজ্যে মশাই ইংল্যান্ডের রাজাকে টেক্কা দিয়ে পদ এবং পত্নীকে ছাড়ার পর অন্যের পত্নীকে যা যা দিয়ে দিলেন বলে শোনা যাচ্ছে, তারপরে বাবু শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বেঁচে থাকলে 'চরিত্রহীন' উপন্যাস নিশ্চয়ই নতুন করে লিখতেন। অনুগত স্বামীরা ভয়ের চোটে উত্তম-সুপ্রিয়ার সেই কালজয়ী গান, 'এক বৈশাখে দেখা হল দুজনায়'....পর্যন্ত শুনছেন না, কারণ আষাঢ় বা শ্রাবণে কি হয়, হয়, তা এখন আমরা সকলে জানি।
রিমেক এ অভ্যস্ত টলিউডও আর ১৯৫৪ সালে জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী ছবি 'ছেলে কার'-এর আধুনিক ভার্সন 'সন্তান কার' বানাবে না। স্বাধীনতার পর প্রথম দশকে যে গুলো নিয়ে আলোচনা হতো, যে ধরনের চিত্রনাট্যে অভিনয় করে বিকাশ রায় কিংবা অরুন্ধতী দেবী কিংবদন্তী হয়েছিলেন, সেইগুলো আর প্রাসঙ্গিক নয়। ভারত নামক দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর যত এগিয়ে আসছে তত নজরটানা স্লোগান হচ্ছে, টাকা কার? এখন তাই সম্পর্কের টানাপোড়েনে কে কত প্রেমপত্র লিখেছে, সেই নিয়ে বাদানুবাদ হয় না, বরং ব্যাঙ্ক আর ক্রেডিট কার্ডের স্টেটমেন্ট নিয়ে কাঁটাছেড়া হয়। এ নিখিল ভুবনে যশপ্রাপ্তির সংজ্ঞা আর রোডম্যাপ বদলে গেছে!
প্রেম, সম্পর্ক আর দাম্পত্যের এই জার্নিতে প্রতিনিয়ত যে ঝাঁকুনিগুলো আসছে,তাতে বর্ষায় ভরাগঙ্গার চোরা স্রোতও হার মেনে যাবে। এই সেদিন পর্যন্ত যাঁকে কমেডিয়ান হিসেবে উপহাসের কিংবা বডিশেমিং এর মোকাবিলা করতে হতো, তিনি যেই জনপ্রতিনিধি হলেন, তাঁর সমস্ত কিছু আতসকাঁচের তলায়। কোন মলে কোন সহঅভিনেত্রীর সঙ্গে তিনি কফি খেয়েছেন কিংবা কোথায় সিনেমা দেখতে গিয়েছেন, তাই নিয়েও তাঁকে জবাবদিহি করতে হচ্ছে। এই যে আধুনিক অগ্নিপরীক্ষা, যেটার ভিতর দিয়ে প্রতিমূহূর্তে যাওয়া, তার অন্তরালেও কিন্তু ক্যাচলাইন টা এক। টাকা কার?
টাকা কার?
সত্যিই তো, প্রেমে,পরকীয়ায়, সম্পর্কে এবং দাম্পত্যে এখন তাহলে সবচয়ে জরুরি প্রশ্ন টাকা কার?
আবার শরণাপন্ন হলাম তরুণ প্রজন্মের কাছে। আমার তরুণী কন্যা প্রবাসে রীতিমতো বিরক্ত হল প্রশ্নটা শুনে। উফফ...আরেকবার ঘরে বাইরে টা দেখো। বিমলার খোঁপার কাঁটা কেন সন্দীপ রেখে দিয়েছিল, ভেবে দেখ! নিখিলেশ এর জমিদারিটাই লক্ষ্য ছিল সন্দীপের।
সত্যিই তো! কে বলল দেবদাস ই চিরকাল বাঙালির রোল মডেল থাকবেন? অপর্ণা সেনের ঘরে বাইরের রিমেক এ সন্দীপের মতো চরিত্র যেমন ফিরে এসেছিলেন আদর্শের নতুন চাদর গায়ে দিয়ে, তেমনই বিমলার খোঁপার কাঁটা দিয়ে হৃদয়কে এফোঁড় ওফোঁড় করার প্রবণতাও থাকবে। তাই কফিশপের সেলফি আর ক্রেডিট কার্ডের বিল টা সামলে রাখাই এখন দস্তুর!
সুমন ভট্টাচার্য, কলকাতার বিশিষ্ট সাংবাদিক। কবি, কথাশিল্পী, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।