রান্নার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি বোধহয় মেয়েদের সম্পর্ক। হ্যাঁ, এখনো আমরা বেরোতে পারলাম না এই ধারণার বেড়াজাল থেকে। একইসময়ে একদিকে জানছি ব্যাডমিন্টনে ক্যারোলিনা মারিনের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জেতার কথা অন্যদিকে জানছি রান্না নিয়ে মানসিক নির্যাতনে একটি মেয়ের আত্মহত্যার কথা। মুম্বই হাইকোর্টের একটি মামলায় জানা যায় একটি মেয়ে রান্না নিয়ে পারিবারিক অশান্তির কারণে অপমানে আত্মঘাতী হয়েছেন। আসলে আমরা উন্নয়নশীল শক্তিশালী মেয়েদের “মেয়ে” ভাবি না, ভাবি মেয়েজাতির ব্যতিক্রম। ফলে সেইসব মেয়েরা আমাদের কাছে সুপারহিরোইন। সাধারণ ঘরে সাধারণ মেয়েরাই যে এই সুপারহিরোইন তা আমাদের ভাবনায় কুলোয় না।
গণতান্ত্রিক এই দেশের আদমশুমারিতে শুধু তো পুরুষ ও বাচ্চার গণনা হয় না! স্বাভাবিকভাবে নারীও থাকে সেই গণনায়। ফলে একটা দেশের ছেলে, মেয়ে সকলের শিক্ষা ও জীবিকা থাকলে গোটা আর্থসামাজিক কাঠামোটাই বদলে যায় সেটাও ভাবতে পারি না! মেয়ে সন্তান জন্মালো অতএব তাকে সাবধানে রাখো, সে কোথায় গেল, অনেক পড়ে চাকরি করেই বা তার কী হবে, তাকেও তো রান্না করতেই হবে ইত্যাদি ভাবনা শিক্ষিত ঘরের আনাচে-কানাচেই জমে আছে। শুধু যে ভাবনার গাঁথুনিতে ভাবনা ঢুকে বসেছে তা নয়! বাবা-মা, পরিবেশ, এমনকি মেয়েরা নিজেরাও খারাপ শুনতে শুনতে নিজেকে বড় করার যাবতীয় সাহসটুকু বিসর্জন দেয়। শুধু কী এক অলীক নিরাপত্তাবোধের জন্য স্থানান্তরিত হয়ে বাধ্যতামূলক গৃহকর্মে নিপুণা হওয়ার চেষ্টা করতে থাকে।
ভাবতে ভালো লাগছিল ইন্দ্রা নুয়ির কথা। এরকম মেধাবী এক মহিলা যিনি পেপসির সিইও পদে দীর্ঘদিন থেকে কর্পোরেট জগতে নারী-পুরুষের প্রাধান্যের হিসেবকেই বদলে দিয়েছেন। সেই ভাবনার ছন্দে এসে ঘোর কাটল যখন জানলাম তাঁর মাও তাকে বলেছেন চাকরির কথা গ্যারেজেই ফেলে এসে মনে রাখতে তিনি এক স্ত্রী, মা, পুত্রবধূ। তবুও নুয়ি এগিয়ে এসেছেন। মেয়েরা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, বিখ্যাত হয়েছে, স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে এরকম উদাহরণ অবশ্যই আছে। কিন্তু তাতে কী? আমদের স্মৃতিতে পুরনো উদাহরণ দূরে থাক, সমসাময়িক উদাহরণগুলোই ক্রমাগত এড়িয়ে চলেছি। সাধারণ ঘরের ডাল-ভাত খাওয়া মেয়েগুলোকে যতদিন সুপারহিরোইন হওয়ার কথা ভাবাতে পারব না ততদিন আমাদের ভয়েই থাকতে হবে।
বধূহত্যার ভয়, ধর্ষণের ভয়, বদনামের ভয়, বিয়ে ভাঙার ভয় এইসমস্ত ভয় ছাড়িয়ে যে পি ভি সিন্ধু, ইন্দ্রা নুয়ি, ইন্দিরা ব্যানার্জির মতো সাহসীরা আছেন তা যতদিন না মনে ঢুকবে ততদিন মেয়েদের রান্নার হলুদে, নুনে সেদ্ধই হতে হবে। যত বেশি নারীজীবনের আতঙ্কের কথা ভাবা হবে ততই দেখতে পাওয়া যাবে না নারীজীবনের সাফল্য। যে পরিমাণে ধর্ষণের আতঙ্ক, রান্নাবান্নার সতর্কতা মেয়েদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তার অর্ধেকও যদি শিক্ষা ও সাফল্যের কথা তাদের বোঝানো যেত, পরিস্থিতি আলাদা হতো। ১৯৪৯ সালে “THE SECOND SEX” নামক বিখ্যাত বইটির লেখিকা সিমোন দ্য বোভেয়ার ছোটবেলা থেকে তাঁর মাকে (ফ্রাঁসোয়া ব্রাসেয়ো) দেখে মেয়েদের জীবনকে ভয় পেয়েছিলেন। মায়ের প্রতিদিনের ক্লান্তিকর অর্থহীন ঘরের কাজ দেখে তিনি ছোটবয়সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কখনো মা কিম্বা গৃহিণী হবেন না। এখন প্রশ্ন জাগে এটাই, ঘরের কাজ, রান্নাবান্নার সঙ্গে উন্নত শিক্ষিত জীবনের বিরোধ কোথায়? বিরোধ কেবল লিঙ্গভিত্তিক বাধ্যতামূলক চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে যখন এটা চাপিয়ে দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে আরো মনে আসে মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের ১৭৯২ সালে প্রকাশিত “VINDICATION OF THE RIGHTS OF WOMAN” নামক যুগান্তকারী বইয়ের কথা। দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মানো একটি মেয়ে প্রচলিত ভাবনার উল্টদিকে গিয়ে মেয়েদের জন্য এই বই লিখেছিলেন। এই লেখার জন্য তাঁকে হায়েনা বলেও সম্বোধন করা হয়েছিল তবু তিনি ক্রমাগত লড়ে গেছেন।
সেই ১৭৯২ সাল থেকেই যদি ধরি, আজ ২০১৮ সাল অবধি আমাদের ভাবনার ভিত্তি এত দুর্বল হয়ে থাকা কি আমাদের নিজেদের বোধের অপমান নয়? ১৯৮৯ সালে ফতিমা বিবি সুপ্রিম কোর্টের প্রথম মহিলা বিচারপতি হন। ১৯৫০ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে ৮ জন মাত্র মহিলা বিচারপতি হয়ে এসেছেন। সংখ্যাটা খুব সৌভাগ্যজনক তা বলছি না কিন্তু মেয়েদের বাবা-মা, বন্ধু সকলেই যদি ভাবেন “কটা মেয়ে আর ওরকম হয়”, সেখানেই মেয়েজন্ম কেবলই রান্নাবান্নাকে স্বীকৃতি দিয়ে দেয়।
ভাগ্যিস এরকম ভাবনাকে প্রশ্রয় দেননি ইন্দিরা ব্যানার্জির মতো মেয়েরা, তাই আজ ২০১৮-তেও তিনি সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি। জীবনের আর সমস্ত কাজের মতো রান্নাও একটা কাজ, এর মধ্যে লিঙ্গ ভাবনাকে জড়িয়ে আমরাই নিজেদের প্রহসন বানাই এবং ভয়ঙ্কর গোলমালের পথ চওড়া করি। বড় বড় শেফ তারা তো পুরুষ, সেক্ষত্রে “মেয়েসম্পর্কিত রান্নার” বাগধারা কিভাবে বজায় রাখি ভাবতে আশ্চর্য লাগে! কাজের ক্ষেত্রে রান্নাও যেমন কোনো লিঙ্গভিত্তিক কাজ নয়, জীবনের ক্ষেত্রে মেয়েরাও আসলে মানুষ ছাড়া কিছু নয়!