প্রায় একশ বছর পূর্বে সিন্ধু অববাহিকার প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এক সুপ্রাচীন সভ্যতার সন্ধান দিয়েছিল। তাম্র-ব্রোঞ্জ যুগের হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর এই সভ্যতা নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান, ঐতিহাসিক গবেষণা ও তর্ক-বিতর্কের ধারাবাহিকতা পাকিস্তান ও ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের পুনঃনির্মাণের সহায়ক হয়েছে। এই ধারাবাহিকতার ফলে সিন্ধু, বালুচিস্তান, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান ও গুজরাটে আবিষ্কৃত হয়েছে বহু প্রত্নক্ষেত্রের। পরিত্যক্ত ঢিবি ও ঝোপ-জঙ্গলে আচ্ছাদিত ধ্বংসস্তূপের খননকার্য যে প্রাচীন সভ্যতার ও সংস্কৃতির ইতিহাস নির্মাণের সহায়ক হবে, সে বিষয়ে গবেষকদের মনে সন্দেহ নেই।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশ তাদের প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান সংস্থা স্থাপন, প্রত্নসমীক্ষা ও খননকার্য চালানোর সঙ্গে সঙ্গে এই দেশগুলি তাদের প্রত্নসামগ্রী ও প্রত্নক্ষেত্রগুলিকে রক্ষা করার জন্যও বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়ম বা মানুষের অজ্ঞতা, অসচেতনতা ও অদূরদর্শিতায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বহু সম্ভাবনাময় প্রত্নক্ষেত্র ও ধ্বংসাবশেষের ঐতিহাসিক গুরুত্ব। কোথাও কোথাও অবহেলায় পড়ে আছে বহু প্রত্নক্ষেত্র।
দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশ বিশেষ করে ভুটান, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত এমনই একটি অবহেলিত কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ প্রত্নক্ষেত্র হলো চিলারায় গড় (চিলারায় কোট বা চিলারায় দূর্গ)।
বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার (পূর্বতন দেশীয় রাজ্য) তুফানগঞ্জ শহর সংলগ্ন চিলারায় গড় তৈরি করেছিলেন কোচ রাজা নর নারায়ণ (১৫৪০-১৫৮১) ও কোচ সেনাপতি চিলারায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, কোচ রাজ্যের মূলস্থপতি বিশ্বসিংহ (১৫১৫-১৫৪০) তৎকালীন তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় যে রাজ্য স্থাপন করেছিলেন তাকে রক্ষা করার জন্য তাঁর নিজ ভ্রাতা শিষ্যসিংহকে তাঁর রাজ্যের পশ্চিমাংশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল (বর্তমান জলপাইগুড়ি জেলা এবং বাংলাদেশের পঞ্চগড় ও নীলফামারী) দান করেছিলেন। শিষ্যসিংহ নিয়োজিত হয়েছিলেন কোচ রাজ্যের রক্ষক বা ‘রায়কত’ হিসেবে। বিশ্বসিংহ পশ্চিম আসামের ‘চিকিনা’ অঞ্চল ছেড়ে প্রথমে হিঙ্গুলাবাসে (বর্তমান আলিপুরদুয়ার জেলার মহাকালগুড়ি) রাজধানী স্থাপন করেন ও পরে কামতাপুরে তাঁর রাজধানী স্থানান্তরিত হয়।
বিশ্বসিংহের মতই নর নারায়ণ ও তাঁর ভ্রাতা চিলারায়ের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের উত্তরাংশ সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কোচ রাজ্যের সীমানা বিস্তার লাভ করেছিল। উত্তরদিকে ভুটান, পূর্বে অহোম রাজ্য ও দক্ষিণে বাংলার মুঘল শক্তির দ্বারা পরিবেষ্টিত কোচ রাজ্যের সুরক্ষার জন্য নর নারায়ণ (মল্লদেব) ও চিলারায় (শুক্লধ্বজ) বেশ কয়েকটি দূর্গ তৈরি করেছিলেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল চিলাপাতার (বর্তমান আলিপুরদুয়ার জেলার চিলাপাতার জঙ্গল) নররাজার গড় (নর নারায়ণ গড়/নলরাজার গড়) ও ফুলবাড়ির (বর্তমান তুফানগঞ্জ) চিলারায় গড়।
ভুটান ও অহোম রাজাদের আক্রমণ প্রতিহত করা ও উত্তর-পূর্ব ভারতে রাজ্য বিস্তারের সুরক্ষিত সামরিক দূর্গ হিসেবে চিলারায় গড়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। রায়ডাক নদীর সঙ্গে খালের (খোড়া) দ্বারা সরাসরি যুক্ত চিলারায় গড় কোচ নৌবাহিনীর ঘাঁটি হিসেবেও গুরুত্ব অর্জন করেছিল। নদীপথে এই দূর্গ থেকে কুড়িগ্রাম, পাঙ্গা, উত্তরকূল, দক্ষিণকূল, ধুবরী ও গোয়ালপাড়ার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষিত হয়। আবার চিলারায় গড়ের পাশ দিয়েই নির্মিত হয়েছিল ‘গোহাই কমল মহাপথ’ (‘গোহাই কমল আলি’ বা বর্তমানে ভারতের ৩১এ জাতীয় সড়ক)। ফলে রাজ্যবিস্তার ও কোচ রাজ্যের অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা ও শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে তৎকালীন ফুলবাড়ির চিলারায় গড়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
সেনাপতি চিলারায়ের মৃত্যুর পর নর নারায়ণ ও চিলারায়-পুত্র রঘুদেব নারায়ণের মধ্যে কোচ রাজ্য বিভক্ত হয়ে গেলেও (১৫৮১) চিলারায় দূর্গ কোচবিহারের মূলকেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মহারাজা প্রাণ নারায়ণের (১৬৩২-১৬৬৫) পরবর্তীকালে উত্তর দিক থেকে ভুটানের আক্রমণ, পূর্ব দিক থেকে অহোম রাজাদের প্রতিপত্তির বিস্তার ও দক্ষিণ দিক থেকে মুঘল আক্রমণের ফলে কোচ রাজ্যের সীমা সংকুচিত হতে থাকে। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও সামরিক দুর্বলতার প্রকটের সঙ্গে সঙ্গে চিলাপাতার নররাজার গড় ও ফুলবাড়ির চিলারায় গড়, উভয়ই ধ্বংস হতে থাকে। একই সঙ্গে রায়ডাক নদীর গতিপথের পরিবর্তন চিলারায় গড়ের গুরুত্ব হ্রাস করেছিলো। বিশ শতকের গোড়ায় চিলারায় গড় একটি পরিত্যক্ত ঢিবিতে পরিণত হয়।
১৯৪৭ এর ভারত বিভাজন ও ১৯৪৯ সালে কোচবিহার রাজ্যের ভারত-ভুক্তির পরবর্তীকালে চিলারায় গড় অঞ্চলে জনবিন্যাসের বিশাল পরিবর্তন ঘটেছে। পূর্ববাংলা থেকে আগত সহায়-সম্বলহীন উদ্বাস্তুদের এখানে সরকারি উদ্যোগে পুর্নবাসন দেওয়া হয়েছিল। উদ্বাস্তু উপনিবেশ স্থাপনের ফলে পরিত্যক্ত গড়ের একটা অংশ ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাছাড়া গড়ের পশ্চিম পাশে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের সরকারি প্রকল্প। স্বাভাবিকভাবেই একটি বিশাল গড় আজ সংকুচিত হতে হতে একটি ছোট্ট উঁচু মাঠে পরিণত হয়েছে।
বর্তমান রায়ডাক নদী থেকে প্রায় দুই কিমি দূরে অবস্থিত চিলারায় গড়ের পাশ দিয়ে প্রবাহিত জলের ধারা আজও বর্ষাকালে কানায় কানায় ভর্তি হয়ে ওঠে। বাড়িঘর তৈরি বা গড়ের বসতির রাস্তা নির্মাণের সময় মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসে বিশেষ ধরনের ইট ও খোদাই-করা পাথর। ‘পদ্মছাপ’ যুক্ত বিশেষ ধরনের ইট ও গড় নির্মাণে ব্যবহৃত বিশাল আকৃতির পাথরের চাঁই গড়ের আশে পাশে এখনও দেখতে পাওয়া যায়। ইতিহাস চেতনার অভাবে এই মূল্যবান প্রত্নসামগ্রীগুলো অবহেলায় ও অযত্নে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
তবে স্থানীয় কয়েকটি সংগঠনের উদ্যোগে গড়ের উত্তর-পশ্চিম কোণায় স্থাপিত হয়েছে চিলারায়ের একটি পূর্ণাঙ্গ মূর্তি। এই মূর্তি চিলারায়, নর নারায়ণ ও পূর্বতন কোচবিহার রাজ্য সম্পর্কে স্থানীয় মানুষের জনস্মৃতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তাই আশা করা যায় গবেষকদের অনুসন্ধিৎসা বৃদ্ধি পেলে ভুটান, বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্ব ভারতের ইতিহাসের নির্মাণে চিলারায় গড়ের ঐতিহাসিক গুরুত্ব স্বীকৃতি পাবে।
(কৃতজ্ঞতা স্বীকার: ক্ষেত্র সমীক্ষার ব্যয়ভার বহনের জন্য লেখক ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ (নয়াদিল্লি)’ এর কাছে ঋণী।)
ড. রূপ কুমার বর্মণ, কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও আম্বেদকর চর্চা কেন্দ্রের সমন্বয়ক ।