ফুল ফুটক না ফুটুক
আজ বসন্ত
শান-বাঁধানো ফুটপাতে
পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ
কচি-কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে
হাসছে।
ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।
আলোর চোখে কালো ঠুলি পরিয়ে
তারপর খুলে-
মৃত্যুর কোলে মানুষকে শুইয়ে দিয়ে
তারপর তুলে-
যে দিনগুলো রাস্তা দিয়ে চলে গেছে
যেন না ফেরে।
গায়ে-হলুদ দেওয়া বিকেলে
একটা-দুটো পয়সা পেলে
যে হরবোলা ছেলেটা
কোকিল ডাকতে ডাকতে যেত
-তাকে ডেকে নিয়ে গেছে দিনগুলো।
লাল কালিতে ছাপা হলদে চিঠির মতো
আকাশটাকে মাথায় নিয়ে
এ- গলির এক কালোকুচ্ছিত আইবুড়ো মেয়ে
রেলিঙে বুক চেপে ধরে
এইসব সাত-পাঁচ ভাবছিল-
ঠিক সেই সময়
চোখের মাথা খেয়ে গায়ে উড়ে এসে বসল
আ মরণ! পোড়ার মুখ লক্ষ্মীছাড়া প্রজাপতি।
তারপর দড়াম করে দরজা বন্ধ হবার শব্দ।
অন্ধকারে মুখ চাপা দিয়ে
দড়িপাকানো সেই গাছ
তখনও হাসছে।।
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বিংশ শতাব্দীর খ্যাতিমান শক্তিশালী বামপন্থী কবি। ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ক্ষিতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, মাতা যামিনী দেবী। তিনি ১৯৩৭ সালে কলকাতার মিত্র ইন্সটিটিউশন থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করে সক্রিয় রাজনৈতিক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
১৯৪১ সালে কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে দর্শনে অনার্স নিয়ে স্নাতক হন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'পদাতিক' প্রকাশিত হয় ১৯৪০ সালে। এই কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হবার সঙ্গে- সঙ্গেই তিনি বাংলা কাব্যজগতে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর অগ্রজ কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করেছেন- 'নজরুলকে চিনিয়েছিলেন পিতৃদেব' শীর্ষক রচনায় - “কবি নজরুলকে চিনিয়েছিলেন আমার বাবা, দূর থেকে পথে দেখা – এন্টালীর পথে যাচ্ছিলাম বাবার সঙ্গে, কবি গাড়ী চালিয়ে যাচ্ছিলেন, বাবা দেখালেন – ঐ দেখ্ কবি নজরুল ইসলাম । পরে যখন সুযোগ হয়েছিল কাছে দেখবার, তখন তিনি আর স্বাভাবিক নন, পুত্র পরিবারের সাথে তখন আমার আলাপ-পরিচয় হয়েছে।"
রবীন্দ্রনাথের পরে, বাংলার সাধারণ মানুষ সেসময় কবি বলতে নজরুলকেই চিনত। আমাদের যাঁরা গুরুজন ছিলেন, যদিও ধর্ম বা অন্যান্য সংস্কারগত গোঁড়ামি তাঁদের মধ্যে ছিল, তবুও নজরুল তাঁদের প্রিয় কবি ছিলেন। এর একটা বড় কারণ, তখনকার বয়স্ক মানুষ রবীন্দ্রনাথকে ঠিক ততটা গ্রহণ করতে পারেননি- তিনি তাঁদের কাছে দূরের মানুষ ছিলেন, কিন্তু নজরুলকে অনেক কাছের মানুষ মনে হত। কারণ, প্রথমত: তিনি সাম্প্রদায়িকতার বেড়া ভেঙেছিলেন। এইসব কারণে, আমাদের ছেলেবেলার, রবীন্দ্রনাথের এতবড় প্রতিভার মধ্যে থেকেও নজরুলের কবিতা মুখস্থ করেছি, গান গেয়েছি, সাধারণ বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের নানাভাবে ঘরের মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন, সেই আবহাওয়ার মধ্যেই আমরাও বড় হয়েছি।”
তৎকালীন সময়ে কাজী নজরুল ইসলামের জনপ্রিয়তার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন- “নজরুল তাঁর কবিতায় সাধারণ মানুষের মুখের কথা ব্যবহার করেছেন যা তাঁকে জনপ্রিয় হতে সাহায্য করেছে, আমরা যখন বড় হয়েছি, তখন নজরুল ঠিক কবিতার জগতে নেই – শুধুই গান লেখেন, গানে সুর দেন. আলাদা জগতে চলে গেছেন। এর একটা কারণ ছিল, নজরুল কবিতার একটা ছাঁচে পড়ে গিয়েছিলেন, লোকে তাঁর নাম দেয় বিদ্রোহী কবি। কবিতায় বিদ্রোহ ছাড়া অন্য কোন সুর লোকে গ্রহণ করতে চাইত না, তুলনায় গানের মধ্যে জীবনের বিচিত্র দিক তিনি তুলে ধরতে পেরেছিলেন।"
যদিও নজরুলের মধ্যে কোন সাম্প্রদায়িক মনোভাব ছিল না, তবুও বাঙালী মুসলমানদের ভিতর গর্ব করার মত প্রতিভারূপে নজরুল সাধারণ মুসলমান জনের মধ্যেও অসম্ভব জনপ্রিয় হন। বাংলায় মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও সমাজজীবনে খুব বেশী অগ্রসর ছিলেন না। মুসলিম সমাজ নজরুলকে আঁকড়ে ধরে আত্মবিশ্বাস পেয়েছিল, কলকাতার মুসলমান পল্লীতে নজরুল পাঠাগার, নজরুল সংঘ তৈরী হয়েছিল তিনি বেঁচে থাকতেই। নজরুল হিন্দু মেয়েকে বিবাহ করেন, তাঁর মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার লেশমাত্র ছিল না – তবুও পিছিয়ে পড়া মুসলিম জন আত্মবিশ্বাস খুঁজে পান তাঁর মধ্যে। বাংলা সাহিত্যের তৎকালীন দিকপালেরা সেসময় সভা করে বক্তৃতা দেন, সে সভায় তাঁরা বলেছিলেন, নজরুল ধূমকেতু নন, তিনি বাংলার সাহিত্যাকাশের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক।
"এর পরবর্তী সময়ে আর স্বাভাবিক নজরুলকে আমরা পেলাম না, দুঃখের বিষয় এই যে, যিনি স্বাধীনতার একজন রচনাকার, যখন স্বাধীনতা এলো, তখন বেঁচে থেকেও সে স্বাধীনতার স্বাদ কবি গ্রহণ করতে পারলেন না, সে ক্ষমতা তখন আর তাঁর ছিলনা - এটা আমাদের দেশের একটা বিরাট ট্র্যাজেডি।”
সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (১৯৬৪), আনন্দ পুরস্কার (১৯৮৪), জ্ঞানপীঠ পুরস্কার (১৯৯১), পদ্মভূষণ (২০০৩) সহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ‘তোমাকে’ শীর্ষক কবিতাটির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা নিবেদেন করেছেন:
তোমাকে
ফুলেল ফুরফুরে হাওয়া,
বনে মৌমাছির গুনগুন্
- সমস্তই সাময়িক,
সারাবছরের ছবি নয়।
এও ঠিক
সময় সময়
খর সূর্য বর্ষায় আগুন।
কখনও কখনও
মাথার ওপর
মেঘ ডাকলে
ঘন ঘন চমকায় বিদ্যুৎ
উঠে আসে ঝড়।
যখন বাতাসে ঘূর্ণী,
টান লাগে শিকড়ে শিকড়ে
তখন তোমাকে মনে পড়ে।
খুঁজি না রাস্তার নামে
জানি নেই মর্মর মূর্তিতে-
তুমি থাকবে, তুমি আছো
আমাদের নিত্য দুঃখ জয়ের সংগ্রামে।
বাংলা ভাষার অত্যন্ত বলিষ্ঠ এই কবি ৮ই জুলাই, ২০০৩ সালে কলকাতায় ৮৪ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পদাতিক’-এর নামানুসারে শিয়ালদহ –নিউ জলপাইগুড়ি এক্সপ্রেসের নামকরণ করা হয় ‘পদাতিক এক্সপ্রেস’। তাঁর নাম অনুসারে ২০১০ সালে কলকাতায় একটি মেট্রো রেলস্টেশনের নামকরণ করা হয় 'কবি সুভাষ' মেট্রো স্টেশন। আজ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণ দিবসে বাংলা ভাষার কবিতা প্রেমীদের পক্ষ থেকে কবির প্রতি রইল সশ্রদ্ধ প্রণাম। পরিশেষে তাঁরই লেখা কবিতা ‘আমার কাজ’:
আমি চাই কথাগুলোকে
পায়ের ওপর দাঁড় করাতে।
আমি চাই যেন চোখ ফোটে
প্রত্যেকটি ছায়ার।
স্থির ছবিকে আমি চাই হাঁটাতে।
আমাকে কেউ কবি বলুক
আমি চাই না।
কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে
জীবনের শেষদিন পর্যন্ত
যেন আমি হেঁটে যাই।
আমি যেন আমার কলমটা
ট্র্যাক্টরের পাশে
নামিয়ে রেখে বলতে পারি -
এই আমার ছুটি –
ভাই, আমাকে একটু আগুন দাও।
লেখক: সোমঋতা মল্লিক, নজরুল সঙ্গীতশিল্পী এবং সভাপতি, ছায়ানট (কলকাতা)