করোনাকালে ২০২১ সালের ঈদুল আজহার পরের দিনটি (বৃহস্পরিবার ২২ জুলাই) শুরু হলো শোকাবহ বার্তায়। ভোরে প্রয়াত হলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) অগ্রণী অধ্যাপক, লেখক, ড. ভুঁইয়া ইকবাল। সকাল সকাল প্রিয়জন বিয়োগের সংবাদটি যখন তাঁর স্ত্রী, চবি অধ্যাপক ড. আমাতুল লায়লা জামান টুকু আপা দুঃসহ দুঃখের বাষ্পরুদ্ধ ভাষায় জানালেন, তখন এই সুখী, ঋদ্ধ, শিক্ষক-দম্পতির বহু স্মৃতি আমাকে আচ্ছন্ন করে।
দীর্ঘ তিরিশ বছর তাঁদেরকে নিবিড়ভাবে দেখেছি চবি ক্যাম্পাসে। ১৯৯৩ সালে আমার যোগদানের সময় কলা ভবনেই অবস্থিত ছিল সমাজ বিজ্ঞান, ব্যবসা প্রশাসন ও কলা অনুষদভুক্ত বিভাগগুলো। টিচার্স লাউঞ্জে সবার সঙ্গে সবারই দেখা হতো। অনেক বিষয়ে দিনের পর দিন কথা হয়েছে। সেসব স্মৃতি মেঘ-ভাঙা রৌদ্রের মতো ঝিলিক দিচ্ছে।
প্রথমে এই দম্পতি চবি ক্যাম্পাসের দক্ষিণ আবাসিক এলাকায় বাড়ি বানিয়ে বসবাস করতেন। তখন নানা উপলক্ষ্যে সেখানে গিয়ে দেখা করেছি। তিনি ক্যাম্পাস-ঘেঁষা নতুন আবাসিক এলাকার অবকাঠামো উন্নয়ন ও ইউটিলিটি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরে তাঁরা অ্যাপার্টমেন্ট কিনে চলে আসেন শহরেরর লালখান বাজার এলাকায়। তখন, বাসে শহর থেকে আসা-যাওয়ার পথে রাশি রাশি আলাপ হয়েছে। শিল্প, সাহিত্য, সমাজ ছুঁয়ে ছুঁয়ে গুঞ্জরিত কথাগুলোর প্রতিধ্বনি এখনও কানে বাজে।
অধ্যাপক ড. ভুঁইয়া ইকবালের সঙ্গে আমার একটি মিল ছিল, যা আমরা নিজের মধ্যে আলাপে নিত্য অনুভব করেছি। তিনি যেমন কিছুদিন সাংবাদিকতা করে শিক্ষকতায় এসেছিলেন, আমিও তেমনি পথ পেরিয়ে এসেছি। পিতার কর্মস্থল বঙ্গভবন স্টাফ কোয়ার্টারে কেটেছে তাঁর কৈশোর-যৌবন। 'কচি কাঁচার আসর' করার সুবাদে পেয়েছেন বাড়ির পাশের ইত্তেফাক ভবনের রোকনুজজামান খান দাদাভাইয়ের স্নেহ। ছাত্রাবস্থায় দৈনিক পাকিস্তান/বাংলায় জড়িত থাকার সুবাদে সেখানকার ডাকসাইটে সাংবাদিক তোয়াব খান, আহমেদ হুমায়ূন, ফজল শাহাবুদ্দীনের সঙ্গেও তাঁর নিবিরতা ছিল। ঘটনাক্রমে কুড়ি বছর পরের প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকতার সুবাদে তাঁদের সঙ্গেও আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। যেসব স্মৃতি আমরা একত্রিত হলেই অপার আনন্দে রোমন্থন করেছি।
ড. ভূঁইয়া ইকবাল স্বল্পভাষী হলেও তাঁর স্ত্রী ড. আমাতুল লায়লা জামান টুকু আপা দেখা হলেই প্রাণখোলা আলাপে উচ্ছ্বসিত হতেন। লেখালেখি, গবেষণা, নারী অধিকারের বিষয়ে ম্যারাথন কথাবার্তার মাঝে মাঝে তিনি তাঁর চাচার স্মৃতিচারণ করতেন আমার সঙ্গে। তাঁর চাচা সাংবাদিক খায়রুল আনাম দৈনিক ইত্তেফাকে একজন সিনিয়র রিপোর্টার ও এক সময় চিফ রিপোর্টার ছিলেন। বরিশালের বাসিন্দা হলেও তাঁরা ছিলেন আদিতে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। ইত্তেফাকে আমার কিছুদিন কাজ করার সূত্রে সেসব ব্যক্তি ও বিষয়ের কথাও প্রসঙ্গক্রমে চলে এসেছে।
দ্বীপ জেলা ভোলায় ১৯৪৬ সালে জন্ম হলেও ড. ভূঁইয়া ইকবালের শিক্ষাজীবন ঢাকায় আর অধ্যাপনার পেশাজীবন কেটেছে চট্টগ্রামে। মাঝে কিছুদিন কলকাতা বসবাসের নিরিখে তিনি ছিলেন বাংলার তিন প্রধান নগরের বাসিন্দা। সাগরের কোল থেকে উত্থিত হয়ে তিনি জীবনের বহুমাত্রিক ব্যাপ্তি ও পরিভ্রমণের পরিসমাপ্তি করলেন সমুদ্র তীরের এক অরণ্য-পার্বত্যস্পর্শী শহর চট্টগ্রামে।
জজন্মস্থানে তিনি কমই থেকেছেন। পড়াশোনা করেছেন ঢাকায় সিদ্ধেশ্বরী ও পুরনো ঢাকার ওয়েস্ট অ্যান্ড স্কুলে, ঢাকা কলেজে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পিএইচডি গবেষণা করেছেন কলকাতা বিশ্বভারতীতে। কর্মজীবন শুরু দৈনিক পাকিস্তানে। তারপর ১৯৭৩ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ‘ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’ গ্রন্থ সম্পাদনার জন্য লেখক শিবিরের হুমায়ূন কবির স্মৃতি পুরস্কার লাভ করেন তিনি। ২০১৪ সালে তিনি ভূষিত হন বাংলা একাডেমী পুরস্কারে।
'বাংলাদেশে রবীন্দ্র-সংবর্ধনা', 'রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ', 'পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্র-বক্তৃতা', 'শামসুর রাহমান: নির্জনতা থেকে জনারণ্যে', 'আনিসুজ্জামান: সমাজ ও সংস্কৃতি'- সহ বহু স্মরণীয় বইয়ের লেখক-সম্পাদক ড. ভূঁইয়া ইকবাল। তাঁর 'রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ' (প্রথমা প্রকাশন, ২০১০) বাংলাদেশের গবেষণা-প্রবন্ধ সাহিত্যে নক্ষত্রতুল্য গ্রন্থ। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের 'রবীন্দ্রনাথ' চিত্রকর্মের ভিত্তিতে কাইয়ূম চৌধুরী অঙ্কিত নান্দনিক প্রচ্ছদে সজ্জিত বইয়ের শুরুতেই আছে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের ঐতিহাসিক বৈঠকের ছবি। যে প্রসঙ্গে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বলেছিলেন, 'রবীন্দ্রনাথ যেদিন অবিভক্ত বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন, সেদিন থেকেই হয়েছিল বাঙালি মুসলমানের নবজাগরণের সূচনা।'
এ কথা সুবিদিত যে, বঙ্গের বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়কে তাঁর সমকালে রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্র বসুর মতো করে আর কেউ বুঝতে পারেননি। বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কগত সমস্যার শিকড়ের সন্ধান যে রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন, ড. ভূঁইয়া ইকবালের এই গ্রন্থের প্রতিটি অধ্যায় তার পরিচয়বাহী। যেমন, ‘ব্যাধি ও প্রতিকার’ প্রবন্ধে যে চরম সত্য রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরেন, সেই সত্যই আসলে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিদ্যমান সাম্প্রদায়িকতার মূল।
'যে সাম্প্রদায়িক ছুঁৎমার্গ তাদের অকৃত্রিম আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হতে দেয় না', রবীন্দ্রনাথ তাকেই অভিহিত করেন ‘অভ্যস্ত পাপ’ বলে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'ব্যাধি ও প্রতিকার' প্রবন্ধে উল্লিখিত সমস্যার কথা তুলে ধরে অকপটে আরও বলেছেন, ‘আর মিথ্যা কথা বলিবার কোনো প্রয়োজন নাই। এবার আমাদিগকে স্বীকার করিতেই হইবে হিন্দু-মুসলমানের মাঝখানে একটা বিরোধ আছে। আমরা যে কেবল স্বতন্ত্র তাহা নয়। আমরা বিরুদ্ধ।…আমরা জানি, বাংলাদেশের অনেক স্থানে এক ফরাশে হিন্দু-মুসলমানে বসে না—ঘরে মুসলমান আসিলে জাজিমের এক অংশ তুলিয়া দেওয়া হয়, হুঁকার জল ফেলিয়া দেওয়া হয়।...তর্ক করিবার বেলায় বলিয়া থাকি, কী করা যায়, শাস্ত্র তো মানিতে হইবে। অথচ শাস্ত্রে হিন্দু-মুসলমান সম্বন্ধে পরস্পরকে এমন করিয়া ঘৃণা করিবার তো কোনো বিধান দেখি না। যদি-বা শাস্ত্রের সেই বিধানই হয় তবে সে শাস্ত্র লইয়া স্বদেশ-স্বজাতি-স্বরাজের প্রতিষ্ঠা কোনোদিন হইবে না। মানুষকে ঘৃণা করা যে দেশে ধর্মের নিয়ম, প্রতিবেশীর হাতে জল খাইলে যাহাদের পরকাল নষ্ট হয়, পরকে অপমান করিয়া যাহাদিগকে জাতিরক্ষা করিতে হইবে, পরের হাতে চিরদিন অপমানিত না হইয়া তাহাদের গতি নাই।’
রবীন্দ্রনাথ কতভাবে যে পিছিয়ে পড়া মুসলমান সম্প্রদায়ের সমীপবর্তী হওয়ার চেষ্টা করেছেন, ড. ভূঁইয়া ইকবালের সম্পাদিত গ্রন্থ যেন তারই বিবরণ-ঠাসা লৈখিক-আধার। গ্রন্থের প্রথম ভাগে আছে মুসলমান প্রসঙ্গে ও মুসলমান সম্পাদিত সাময়িকপত্রে কবির নানা রচনা, দ্বিতীয় ভাগে আছে কবির উদ্দেশে ও তাঁকে লেখা মুসলমানদের চিঠিপত্র, নিবেদিত কবিতা, স্মৃতিকথা, মানপত্র, বক্তৃতা, শুভেচ্ছাবার্তা ও কবি সম্পর্কে সাময়িকপত্রে ব্যক্ত প্রতিক্রিয়া।
ড. ইকবালের এই গবেষণাগ্রন্থ সূত্রেই আমরা জানতে পারি, রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক বিষয়ে ৩০টিরও বেশি প্রবন্ধ লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মুসলমান শিক্ষিত মধ্য ও উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের যোগাযোগ-সংক্রান্ত বহু তথ্যও আছে। আছে কবিকে নিবেদিত কবিতাগুচ্ছ, তাঁর সম্পর্কে মুসলমানদের মনোভাব ও প্রতিক্রিয়া এবং তাঁকে লেখা তাঁদের চিঠিপত্র। ১৮ জন চারণ করেছেন কবির স্মৃতি। আছে মুসলমানদের সঙ্গে কবির যোগাযোগ-সংক্রান্ত একটি ক্রমিক বিবরণপঞ্জি এবং চিত্রসূচি। তার সংখ্যাও কম নয়। ড. ভূঁইয়া ইকবালের ‘রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ’ একটি বহুল পরিশ্রমলব্ধ কাজ, যা তাঁকে অবিস্মরণীয় এবং রবীন্দ্রনাথের একটি অতি স্পর্শকাতর-গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সত্যনিষ্ঠ, দালিলিক আলোচনার জন্য মর্যাদাবান করেছে।
'রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ' ছাড়াও ড. ভূঁইয়া ইকবাল অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য 'বাংলাদেশে রবীন্দ্র-সংবর্ধনা', 'বাংলাদেশের উপন্যাসে সমাজচিত্র', 'রবীন্দ্রনাথের একগুচ্ছ পত্র', 'নির্জনতা থেকে জনারণ্যে'
এবং সম্পাদনা ও জীবনীগ্রন্থ বুদ্ধদেব বসু, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আনোয়ার পাশা, বুদ্ধদেব বসু, শশাঙ্কমোহন সেন, (স্যার) আজিজুল হক, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, মানিক বন্দ্যােপাধ্যায় অন্যতম।
অত্যন্ত সজ্জন ও অতি বিনয়ী ছিলেন অধ্যাপক ড. ভূঁইয়া ইকবাল। 'ভদ্র' কাকে বলে তাঁকে দেখেই শেখা যেতো। ১৯৮৬ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকার প্রকাশের সময় থেকে ড. ভূঁইয়া ইকবাল ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কিউরেটর শামসুল হুসেইন বাহাদুর এ পত্রিকার "ইতিহাস ও সংস্কৃতি” পাতা যৌথ ভাবে সম্পাদনা করেছেন। এ কাজে তাঁরা দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন। ইতিহাস অন্বেষী, চট্টগ্রাম প্রেমিক, শামসুল হুসেইন বাহাদুরও অতিসম্প্রতি পরলোকগত।
অবসরে ড. ইকবাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর-এর সন্মানিক কিউরেটর-এর দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রামের 'সুপ্রভাত বাংলাদেশ' পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের উপদেষ্টাও ছিলেন তিনি। কাজে ও অবসরে নিজের লেখায় ধ্যানীর মতো নিবিষ্টতায় মগ্ন থাকতে পছন্দ করতেন এই লেখক-শিক্ষাবিদ। হৈচৈ-এর মাধ্যমে সৃষ্ট-কোলাহল এবং অহেতুক-অনাহুত সামাজিক যোগাযোগ থেকে আপাত দূরত্বে ছিল তাঁর অবস্থান ও কাজের জগৎ। সন্তর্পণের-নৈশব্দে ও একাকীত্বের-একান্তে নিজের কাজকে নিয়ে আচ্ছন্ন-কর্মযোগী মানুষটি মহামারি করোনার স্তব্ধ নীরবতা ছুঁয়ে, জীবনের হীরক জয়ন্তী বছরে চলে গেলেন মৃত্যুচিহ্নিত চিরবিদায়ের অনন্ত পথে।