কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ ছিলেন নজরুল-সুহৃদ এবং ভারতীয় উপমহাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। বাংলাদেশের সন্দ্বীপে জন্মগ্রহণকারী এই নেতা কলকাতাকে রাজনৈতিক জীবন অতিবাহিত করেন। বিদ্রোহী' কবিতার শতবর্ষে মুজফ্ফর আহ্মদ-এর স্মৃতিচারণায় কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত ৫টি কবিতা ও গান নিয়ে আলোচনা করা হলো।
১.কবিতা বিদ্রোহী (অগ্নি-বীণা কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত): আমাদের ৩/৪-সি, তালতলা লেনের বাড়ীটি ছিল চারখানা ঘরের একটি পুরো দোতলা বাড়ী। তার দোতলায় দু'খানা ঘর ও নীচের তলায় দু'খানা ঘর ছিল। পুরো বাড়ীটি ভাড়া নিয়েছিলেন ত্রিপুরা জিলার পশ্চিমগাঁর নওয়াব ফয়জুন্নিসা চৌধুরানীর নাতিরা (দৌহিত্ররা)। তাঁরা নীচের দুখানা ঘর আমাদের ভাড়া দিয়েছিলেন। কিছুদিন পরে নীচেরও একখানা ঘরের তাঁদের দরকার হয়। তখন নজরুল আর আমি নীচের তলার পূব দিকের অর্থাৎ বাড়ীর নীচেকার দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঘরটি নিয়ে থাকি। এই ঘরেই কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি লিখেছিল। সে কবিতাটি লিখেছিল রাত্রিতে। রাত্রির কোন সময়ে তা আমি জানিনে। রাত দশটার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলেম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে আমি বসেছি এমন সময়ে নজরুল বলল, সে একটি কবিতা লিখেছে। পুরো কবিতাটি সে তখন আমায় পড়ে শোনাল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা। কিন্তু নিজের সম্বন্ধে আমি কী যে বলব তা জানিনে। কোনো দিন কোনো বিষয়ে আমি উচ্ছ্বসিত হতে পারি না। যে-লোক প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য তার সামনা-সামনি তাকে প্রশংসা করাও আমোকে দিয়ে হয়ে উঠে না। তার অগোচরে অবশ্য আমি তার প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠি। আমার এই স্বভাবের জন্যে আমি পীড়া বোধ করি বটে, তবুও স্বভাব আমার কিছুতেই বদলায় না। নজরুল তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি আমাকেই প্রথম পড়ে শোনাল, অথচ আমার স্বভাবের দোষে না পারলাম তাকে আমি কোনো বাহবা দিতে, না পারলাম এতটুকুও উচ্ছ্বসিত হতে। কী যে কথা আমি উচ্চারণ করেছিলেম তা এখন আমার মনেও পড়ছে না। আমার স্বভাবটা যদিও নজরুলের অজানা ছিল না, তবুও সে মনে মনে ব্যাহত যে হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। আমার মনে হয় নজরুল ইসলাম শেষ রাত্রে ঘুম থেকে উঠে কবিতাটি লিখেছিল। তা না হলে এত সকালে সে আমায় কবিতা পড়ে শোনাতে পারত না। তার ঘুম সাধারণত দেরীতেই ভাঙত, আমার মতো তাড়াতাড়ি তার ঘুম ভাঙত না। এখন থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে নজরুলের কিংবা আমার ফাউন্টেন পেন ছিল না। দোয়াতে বারে বারে কলম ডোবাতে গিয়ে তার মাথার সঙ্গে তার হাত তাল রাখতে পারবে না, এই ভেবেই সম্ভবত সে কবিতাটি প্রথমে পেন্সিলে লিখেছিল।
২.কবিতা লিচু-চোর (ঝিঙে ফুল কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত): আমরা দেখতাম যে সম্রাট বাবরের জীবন নিয়ে আলী আকবর খান একখানা নাটক লিখছেন। অর্থাৎ তাঁর নিজের স্বভাবেই শুধু নাটকীয়তা ছিল না, তিনি একখানা নাটক রচনাও করেছিলেন। তাঁর লেখা তিনি আমায় পড়েও শোনাতেন। ধৈর্য্য ধারণ করে আমায় তা শুনতে হতো। লেখা আন্দিজানের কথা আসলেই তিনি তাঁর গলার স্বরে খানিকটা দেশপ্রেমের ভাব ফুটিয়ে তুলতেন। আন্দিজান উজবেকিস্তানের একটি জায়গা। খান সাহেব তাকে বাবরের জন্মস্থানরূপে চিত্রিত করেছিলেন। তার পরে দেখতাম তিনি বিভিন্ন জিলার ছোট ছোট ভৌগোলিক বিবরণ লিখে ছাপাচ্ছেন। এই বইগুলি পাঠ্য তালিকাভুক্ত হতো না বটে, তবে শিক্ষকেরা ছেলেদের দিয়ে সে সব বই কেনাতেন এই জন্যে যে আপন আপন জিলা সম্বন্ধে তারা ওয়াকিবহাল হতে পারবে। আলী আকবর খানের বড় ভাই আলতাফ আলী খান বইগুলি ক্যানভাস করে বিক্রয় করতেন। তিনি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। আলী আকবর খানের তৃতীয় কাজ (সেটা বোধ হয় তাঁর আসল কাজ) ছিল যে তিনি প্রাথমিক স্কুলের পাঠ্য পুস্তক রচনার মশ্্ক করতেন। তাঁর কথাবার্তা হতে বুঝতাম যে প্রাথমিক স্কুলের পাঠ্যপুস্তক লিখে বা প্রকাশ করে তিনি একদিন বিত্তশালী হবেন। এই পুস্তকগুলির জন্যে তিনি কবিতা নিজেই লিখতেন। সে যে কি অপূর্ব চীজ হতো তা প্রকাশ করা কঠিন। আমি ঠাট্টা করে তাঁকে বলতাম, কেন আপনি বাচ্চাগুলির ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে যাচ্ছেন? তার চেয়ে বরঞ্চ আমাকে কবিতা পিছু পাঁচটি করে টাকা দিন আমার কবিতা আপনার কবিতার চেয়ে ভালো হবে। তিনি হাসতেন। কেননা, আমি লিখলেও তা যে কবিতা হবে না তা তিনি জানতেন। আলী আকবর খানের কবিতা দেখে তো নজরুলের চক্ষুস্থির। সে তখনই তাঁকে তার বিখ্যাত ‘লিচু চোর’ লিখে দিল। এই কবিতা পেয়ে খান সাহেব আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন।
৩.জাগরণী (ভাঙার গান-এর অন্তর্ভুক্ত) ১৯২১ সালের দুর্গাপূজার সময়ে কাজী নজরুল ইসলাম দ্বিতীয়বার কুমিল্লায় গিয়ে বেশ কয়েকদিন সেখানে ছিল। সেই সময়ে ইংল্যান্ডের যুবরাজের ১৭ই নভেম্বর তারিখে বোম্বেতে পৌঁছানো উপলক্ষ্যে সারা দেশে হরতাল ঘোষিত হয়েছিল। কুমিল্লাতেও যে হরতাল হবে তা আগে হতে স্থির হয়েছিল। ওই তারিখের জন্যে একটি গান রচনার অনুরোধ নিয়ে শ্রী প্রবোধচন্দ্র সেনের তরফ হতে শ্রী শৈলেশচন্দ্র সেন, শ্রী হেমেন্দ্র ভট্টাচার্য ও শ্রী উমেশচন্দ্র চক্রবর্তী নজরুলের সঙ্গে দেখা করেন, সে তার বিখ্যাত জাগরণী তখন রচনা করে-
ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও!
ফিরে চাও ওগো পুরবাসী,
সন্তান দ্বারে উপবাসী,
দাও মানবতা ভিক্ষা দাও!
কুমিল্লা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় গান গেয়ে বেড়ানোর দলে নজরুলের সঙ্গে ছিলেন শ্রী শৈলেশচন্দ্র সেন, শ্রী হেমেন্দ্র ভট্টাচার্য ও শ্রী উমেশচন্দ্র চক্রবর্তী।
৪.চিয়াং কাই-শেকের আগমনে কাজী নজরুল ইসলাম রচনা করেছিলেন- ‘চীন ও ভারতে মিলেছি আবার মোরা শত কোটি লোক’
কল্যাণীয়া প্রমীলা নজরুল ইসলামের মুখে যেমন শুনেছি:
১৯৪২ সালে ৯ই ফেব্রুয়ারি তারিখে চীনের চিয়াং কাই-শেক্ সস্ত্রীক দিল্লী পৌঁছান। দিল্লী হতে রেলওয়ে ট্রেনযোগে তিনি কলকাতা এসেছিলেন এবং কলকাতা হতে তিনি রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনেও গিয়েছিলেন।
সব নিয়ে দুসপ্তাহ তিনি ভারতে ছিলেন। কলকাতা হতেই সোজা চুংকিঙে চলে যান তিনি। এই সময় তাঁকে ভারতে নন্দিত করে একটি গান রচনা করার জন্যে ব্রিটিশ গ্রামোফোন কোম্পানী নজরুল ইসলামকে অনুরোধ করেছিলেন, সে তখন নীচের লেখা গানটি রচনা করেছিল-
চীন ও ভারতে মিলেছি আবার মোরা শত কোটি লোক।
চীন ভারতের জয় হোক! ঐক্যের জয় হোক! সাম্যের জয় হোক!
৫.কবিতা প্রলয়োল্লাস (অগ্নি-বীণা কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত): ১৯২১ সালের শেষাশেষিতে আমরা এদেশে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলব স্থির করেছিলাম। কাজী নজরুল ইসলামও আমাদের এই পরিকল্পনায় ছিল। রুশ বিপ্লবের ওপরে যে সে আগে হতে শ্রদ্ধান্বিত ছিল সে-কথা আমি আগেই বলেছি। আমাদের এই পরিকল্পনা হতেই সৃষ্টি হয়েছিল তার সুবিখ্যাত 'প্রলয়োল্লাস' কবিতা।
তার সিন্ধু-পারের 'আগল ভাঙা' মানে রুশ বিপ্লব। তার প্রলয় মানে 'বিপ্লব'। আর জগৎ-জোড়া বিপ্লবের ভিতর দিয়েই আসছে নজরুলের নূতন অর্থাৎ আমাদের দেশের বিপ্লব। এই বিপ্লব আবার সামাজিক বিপ্লবও।
তথ্য ঋণ: মুজফ্ফর আহ্মদ রচিত 'কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা'।
সোমঋতা মল্লিক, নজরুল সঙ্গীত শিল্পী এবং সভাপতি, ছায়ানট (কলকাতা)