কাজী নজরুল ইসলামের একক সম্পাদনায় ২৬শে শ্রাবণ, ১৩২৯ (১১ই আগস্ট, ১৯২২) শুক্রবার সপ্তাহে দুবার প্রকাশের ঘোষণা দিয়ে অর্ধ-সাপ্তাহিক ধূমকেতু পত্রিকার আত্মপ্রকাশ হয়। অধিকাংশ সংখ্যাই শুক্রবার ও মঙ্গলবার প্রকাশিত হয়েছে, পত্রিকার পৃষ্ঠার আকৃতি ছিল ক্রাউন ফোলিও (১৫ ইঞ্চি × ২০ ইঞ্চি)। প্রথম সংখ্যা ছিল ১৬ পৃষ্ঠার। প্রতি সংখ্যার দাম ছিল ১ আনা। দেশবাসীকে স্বাধীনতা ও মানবতার বিপ্লবী মন্ত্রে উজ্জীবিত করাই ছিল পত্রিকাটির লক্ষ্য।
চট্টগ্রামের হাফিজ মাসউদ আহমদের অর্থানুকূল্যে প্রকাশিত এ পত্রিকার সম্পাদক, সারথি ও স্বত্বাধিকারী ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। প্রথম থেকে সপ্তম সংখ্যা পর্যন্ত সম্পাদক হিসেবে, অষ্টম সংখ্যা থেকে সারথি হিসেবে এবং ছাব্বিশ সংখ্যা থেকে প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নজরুলের নাম মুদ্রিত হয়। পত্রিকার মুদ্রাকর ও প্রকাশক আফজাল-উল হক, কর্মসচিব বা ম্যানেজার ছিলেন শান্তিপদ সিংহ। ঠিকানা ৩ নং কলেজ স্কয়ার, কলিকাতা, সপ্তম সংখ্যার পর অফিস চলে যায় ৭ প্রতাপ চাটুজ্যে লেনে।
ধূমকেতুতে নজরুল মানুষের স্বাধীনতা, সাম্য ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে ভাস্বর করে দুরন্ত আবেগে যেসব সম্পাদকীয় নিবন্ধ, বিবৃতি ও কবিতা লিখেছিলেন তা পাঠক সমাজকে আলোড়িত করেছিল। ধূমকেতুতে প্রকাশিত নজরুলের গদ্য রচনাগুলো পরে 'দুর্দিনের যাত্রী' ও 'রুদ্র মঙ্গল' গ্রন্থে এবং কবিতা গুলো 'বিষের বাঁশী' ও 'ভাঙার গান' কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হয়।
'নজরুলের ধূমকেতু' গ্রন্থে সেলিনা বাহার জামান সম্পাদকীয়তে লিখেছেন-
"প্রথম পৃষ্ঠায় কাগজের ওপর দিকে সৌরমন্ডলের ছবি, তাতে ধূমকেতু আঁকা। সবই কালো কালিতে ছাপা। তার নীচে বড় হরফে লেখা সম্পাদক - কাজী নজরুল ইসলাম। আফজালুল হক কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছিল ধূমকেতু। ছাপা হয়েছিল মেটকাফ প্রেসে, যার ঠিকানা-৭৯ বলরাম দে স্ট্রিট, কলিকাতা।
ধূমকেতুর বয়স হয়েছিল ৫ মাস ১৬ দিন। প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২২ সালের ১১ আগস্ট, বাংলা শ্রাবণ ১৩২৯।
শেষ সংখ্যা ধূমকেতুর তারিখ ১৩ মাঘ ১৩২৯ সাল, ২৭ জানুয়ারি, ১৯২৩। ধূমকেতুর মোট ৩২টি সংখ্যা বের হয়েছিল।
ধূমকেতু নানা কারণে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য:
১. ধূমকেতু নজরুল সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা যার উদ্যোক্তা এবং মালিক নজরুল নিজে।
২. ধূমকেতু পত্রিকায় বাংলা ভাষায় নজরুলই প্রথমে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবী করেন।
৩. ধূমকেতু পত্রিকার ১২ নম্বর সংখ্যায় অর্থাৎ ২৬শে সেপ্টেম্বর ১৯২২ 'আনন্দময়ীর আগমনে' নামক একটি প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হয়। এই কবিতা লেখা ও ছাপার জন্য পুলিশ ধূমকেতু কার্যালয়ে হানা দেয় ৮ই নভেম্বর, ১৯২২। আর নজরুল গ্রেফতার হন ২৩শে নভেম্বর,১৯২২ শহর কুমিল্লায়। কবি কারারুদ্ধ হবার পর অমরেশ কাঞ্জিলাল ধূমকেতু বের করেন।"
ধূমকেতুর প্রথম সংখ্যায় 'সারথির পথের খবর' - এ প্রকাশিত হয়-
"আমার এই যাত্রা হল শুরু
ওগো কর্ণধার,
তোমারে করি নমস্কার!"
"মাভৈঃ বাণীর ভরসা নিয়ে" "জয় জয় প্রলয়ঙ্কর" বলে ধূমকেতুকে রথ করে আমার আজ নতুন পথে যাত্রা শুরু হল। আমার কর্ণধার আমি। আমায় পথ দেখাবে আমার সত্য। আমি প্রথমে আমার যাত্রা- শুরুর আগে আমার সত্যকে সালাম জানাচ্ছি-নমস্কার করছি। যে পথ আমার সত্যের বিরোধী, সে পথ ছাড়া আর কোনো পথই আমার বিপথ নয়। রাজভয় - লোকভয় কোনো ভয়ই আমায় বিপথে নিয়ে যেতে পারবেনা। আমি যদি সত্যি করে আমার সত্যকে চিনে থাকি, তা হলে বাইরের যদি আমার অন্তরে মিথ্যার ভয় না থাকে, তাহলে বাইরের কোনো ভয়ই আমার কিছু করতে পারবেনা। যার ভিতরে ভয়,সেই তার ভয় পায়। আমার বিশ্বাস, যে নিজেকে চেনে, তার আর কাউকে চিনতে বাকী থাকেনা। অতএব যে মিথ্যাকে চেনে সে মিছামিছি তাকে ভয়ও করেনা। যার মনে মিথ্যা, সেই মিথ্যাকে ভয় করে। নিজেকে চিনলে মানুষের মনে আপনা আপনি এত বড়ো একটা জোর আসে, যে, সে আপন সত্য ছাড়া আর কারুকখে কুর্ণিশ করেনা- অর্থাৎ কেউ তাকে ভয় দেখিয়ে পদানত রাখতে পারেনা। এই যে নিজেকে চেনা, আপনার সত্যকে আপনার গুরু, পথ-প্রদর্শক, কাণ্ডারী বলে জানা এটা দম্ভ নয়, অহংকার নয়। এটা আত্মকে চেনার সহজ স্বীকারেক্তি..."
২৬শে আশ্বিন,১৩২৯ সালে (১৩ই অক্টোবর, ১৯২২) ধূমকেতু পত্রিকায় 'ধূমকেতুর পথ' - এ কাজী নজরুল ইসলাম লেখেন: "অনেকেই প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছেন, ধূমকেতুর পথ কি? সে কী বলতে চায়? এর দিয়ে কোন্ মঙ্গল আসবে ইত্যাদি।
নীচে মোটামুটি ধূমকেতুর পথ-নির্দেশ করছি। প্রথম সংখ্যার ধূমকেতুতে 'সারথির পথের খবর' প্রবন্ধে একটু আভাষ দিবার চেষ্টা করেছিলাম, যা বলতে চাই, তা বেশ ফুটে ওঠেনি মনের চপলতার জন্য। আজও হয়ত নিজেকে যেমনটি চাই তেমনটি প্রকাশ করতে পরবোনা, তবে এই প্রকাশের পীড়ার থেকেই আমার বলতে-না পারা বাণী অনেকেই বুঝে নেবেন-আশা করি। পূর্ণ সৃষ্টিকে প্রকাশ করে দেখাবার শক্তি ভগবানেরও নেই, কোন স্রষ্টারই নেই।
মানুষ অপ্রকাশকে আপন মনের পূর্ণতা দিয়ে পূর্ণ করে দেখে।
সর্বপ্রথম, ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়।
স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, কেননা ও কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমানু অংশও বিদেশীর অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা-রক্ষা, শাসন-ভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়ের হাতে। তাতে কোনো বিদেশীর মোড়লী করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যাঁরা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লী করে দেশকে শ্মশান-ভূমিতে পরিণত করছেন, তাঁদেরে পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা পুঁটুলি বেঁধে সাগর-পাড়ে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন নিবেদন করলে তাঁরা শুনবেন না। তাঁদের অতটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনও। আমাদেরও এই প্রার্থনা করার, ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকু দূর করতে হবে।
পূর্ণস্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে সকল-কিছু নিয়ম-কানুন-বাঁধন-শৃঙ্খল-মানা-নিষেধের বিরুদ্ধে। আর এই বিদ্রোহ করতে হলে-সকলের আগে আপনাকে চিনতে হবে। বুক ফুলিয়ে বলতে হবে, 'আমি আপনারে ছাড়া করিনা কাহারে কুর্ণিশ'! বলতে হবে, 'যে যায় যাক সে আমার হয়নি লয়'!..."
ধূমকেতু পত্রিকার প্রথম সংখ্যা থেকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই আশীর্বাণী নিয়মিত ছাপা হয়:
কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু
আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু,
আঁধারে বাঁধ্ অগ্নিসেতু,
দুর্দ্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন!
অলক্ষণের তিলক রেখা,
রাতের ভালে হোক না লেখা,
জাগিয়ে দে রে চমক্ মেরে'
আছে যারা অর্দ্ধচেতন।
২৪ শ্রাবণ
১৩২৯ শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ধূমকেতু পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় তৎকালীন বহু গুণী মানুষের শুভেচ্ছাবাণী প্রকাশিত হয়:
অরবিন্দ-বারীন্দ্রের ভগিনী বিদূষী শ্রীযুক্তা সরোজিনী ঘোষ লিখেছিলেন:
ভাই নজরুল!
তোমার ধূমকেতু বিশ্বের সকল অমঙ্গল, সমস্ত অকল্যাণকে পুড়িয়ে ভস্ম করে ফেলুক-তোমার ধূমকেতু যা কিছু মিথ্যা, যা কিছু মেকী, যা কিছু অসুন্দর তা ধ্বংস করে সত্য সুন্দর ও মঙ্গল প্রতিষ্ঠার সহায়তা করুক। তোমার ধূমকেতু মানুষে মানুষে মিলনের সকল অন্তরায় চূর্ণ করে দিয়ে মহামানবের সৃষ্টি শক্তি ও সামর্থ্য এনে দিক!
তোমার
সরোজিনী দিদি
২৩শে শ্রাবণ,১৩২৯ সাল
সাহিত্য-সম্রাট শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন:
২৪শে শ্রাবণ
শিবপুর
পরম কল্যাণীয়বরেষু,
তোমার কাগজের দীর্ঘজবন কামনা করিয়া তোমাকে একটিমাত্র আশীর্বাদ করি, যেন শত্রু মিত্র নির্ব্বিশেষে নির্ভয়ে সত্য কথা বলিতে পার। তারপরে ভগবান তোমার কাগজের ভার আপনি বহন করিবেন।
তোমাদের-
শ্রী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বাঙালার প্রলয় ধূমকেতু বারীন দা লিখেছিলেন:
পণ্ডিচারী আর্য্য আফিস
৮ই শ্রাবণ, ১৩২৯
ভাই পাগল,
তুমি ধূমকেতু বের করছো শুনে সুখী হলুম। ধূমকেতুর জন্যে আমার আশীর্ব্বাদ চেয়েছ, এ রকম নি-খরচা আশীর্ব্বাদ করার জন্য আমি হাত উুঁচিয়েই আছি! আশীর্ব্বাদ করি তোমার ধূমকেতু দেশের যারা মেকী, তাদের গোঁফ ও দাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিক; আশীর্ব্বাদ করি তোমার ধূমকেতু দেশের যারা সাঁচ্চা সোণা তাদের খাদ ময়লা পুড়িয়ে উজ্জ্বল করে তুলুক; আশীর্ব্বাদ করি তোমার ধূমকেতু বাঙালীর মেয়ের মুখে জহরব্রতা রাজপুতানীর সতী-স্ত্রী দেবী-গর্ব্ব ফিরিয়ে আনুক; আশীর্ব্বাদ করি তোমার ধূমকেতু যতুগৃহ জ্বালিয়ে দিক,স্থির-মণি হয়ে বঙ্গমাতার স্বর্ণ সিংহাসন সাজিয়ে নিক, ভগ্নধ্যান শিবের চক্ষু দিয়ে বেরিয়ে এসে এ কামুক জাতির কাম দেবতাকে পুড়িয়ে ফেলুক আর কামিনী উমাকে করুক শান্তজ্যোতি তাপসী। আত্মজয়ের তপস্যার মধ্য দিয়ে বাঙলার মেয়েরা বাঙলার নব- জাগ্রত শিবসেনাকে পূর্ণ জীবনে মুক্তির স্বর্গে ফিরে পাক।
আমার ও হেমন্তের বড় সাধ ছিল একত্রে 'মুড়ো ঝ্যাঁটা' নাম দিয়ে কাগজ বের করব। বহুযুগের আবর্জ্জনা-ভরা বাঙলায় তথা ভারতে ঝ্যাঁটার বড় দরকার। আশাকরি ধূমকেতু আগুনের ঝ্যাঁটা হয়ে বঙ্গমাতার দেউলখানি সাফ করে দেবে।
ইতি-
তোমার বারীন দা
শ্রী যতীন্দ্রমোহন বাগচী লিখেছিলেন:
সেদারোপম শ্রীমান কাজী নজরুল ইসলাম প্রিয়বরেষু-
প্রলয়াত্মিকা প্রোজ্জ্বল শিখা সর্ব্বনাশের সাথী
জ্বালুক বন্ধু ধূমকেতু তব বিশ্বদহন বাতি
চক্ষে তাহার যে বিপুল জ্বালা বক্ষে যে কালানল
পুচ্ছে জ্বলিছে অভিশাপরূপে যে মহা অমঙ্গল
এক সাথে তাহা হানুক মিলায়ে ভীষন বজ্র বেগে
পাপ খান্ডব যাক্ জ্বলে তারি উল্কা ফুল্কি লেগে
দেশভরা যত অধস্ম যতু পুড়ে হোক ছারখার
যত অসত্য ভস্মের মাঝে হোক্ সমাপ্ত তার
তব প্রদীপ্ত সংমার্জ্জনা অত্যাচারের ভালে
শেষ লেখা তার লিখে দিয়ে যাক্ চিতার বহ্নিজালে
তোমার স্নেহমুগ্ধ
শ্রী যতীন্দ্রমোহন বাগচী
শ্রী উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন:
কাজী ভায়া,
রুদ্ররূপ ধরে ধূমকেতুতে চড়ে তুমি দেখা দিয়েছ-ভালই হয়েছে। আমি প্রাণ ভরে বলছি-স্বাগত। আজ ধ্বংসের দিন, বিপ্লবের দিন, মহামারীর দিন, দুর্ভিক্ষের দিন, সর্ব্বনাশের দিন-তাই রুদ্রের করাল রূপ ছাড়া আর চোখে কিছু লাগেনা।
সৃষ্টি যারা করবার তারা করবে; তুমি মহাকালের প্রলয় বিষাণ এবার বাজাও। অতীতকে আজ ডোবাও, ভয়কে আজ ভাঙ্গ, মৃত্যু আজ মরণের ভয়ে কেঁপে উঠুক।
ভয়ঙ্কর যে কত সুন্দর, তা তোমার ধূমকেতু দেখে যেন সবাই বুঝতে পারে।
অভিন্নহৃদয়
শ্রী উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
ধূমকেতুর প্রথম সংখ্যায়, ১৯২২-এর ১১ আগস্ট ‘মায়ের আশিস’ শিরোনামে মুদ্রিত হয়েছিল স্নেহশালিনী বিরজাসুন্দরী দেবীর এই লেখাটি:
গগনে ধূমকেতুর উদয় হলে জগতের অমঙ্গল হয়, ঝড়, ঝঞ্ঝা, উল্কাপাত, ভূমিকম্প, দুর্ভিক্ষ, মহামারী অনিবার্য্য হয়ে ওঠে,এটা জ্যোতিষ শাস্ত্রের কথা বলে জ্ঞান হয়েছে অবধি শুনে আসছি। আমরা বাঙালী, আমরা বড়ো শান্তিপ্রিয় গো-বেচারা জাতি, তাই আমাদের ধূমকেতু নামটা শুনেই প্রাণটা কেঁপে ওঠে। ভারতের অদৃষ্টে অলক্ষ্যে হয়তো সত্যসত্যই ধূমকেতুর উদয় হয়েছে, তা না হলে আজ এর বুকের উপর দিয়ে এত অমঙ্গল উপদ্রব আর অশান্তির রক্ত-সাইক্লোন বয়ে যেত না। অতএব তোমার এই ধূমকেতু দেখে আমাদের নতুন করে ভয় পাবার তো কিছু দেখি না। যাঁর আদেশে আজ প্রলয় ধূমকেতুর উদয় আর তারই জন্যে অমঙ্গল-শঙ্কায় তাবৎ ভারতবাসী বিত্রস্ত, পথভ্রান্ত, লক্ষ্যভ্রষ্ট আর কেন্দ্রচ্যুত হয়ে ঘুরে মরছে- আমার বিশ্বাস নিশ্চয় এই অমঙ্গল অন্ধকারের পিছনে মঙ্গলময় ভগবান তাঁর অভয় হস্তে মঙ্গলপ্রদীপ নিয়ে অপেক্ষা করছেন। যখন সকল দেশবাসী আমার সেই মঙ্গল-আলোকের জন্য কেঁদে উঠবে, সকলে এক হয়ে সমস্বরে সেই আলোক-শিখাকে স্মরণ করবে, তখনই সত্য সুন্দর শিব সমস্ত অমঙ্গল আঁধার অপসারিত করে তাঁর মঙ্গল-প্রদীপ নিয়ে ধরায় ধরা দিতে আসবেন। চিরদিন দুঃখের পর সুখ, আাঁধারের পর আলো, কান্নার পর হাসি, বিরহের পর মিলন অনির্বচনীয় আনন্দ দান করে থাকে; এর একটা বাদ দিলে অন্যটার তীব্রতা ও উল্লাস উপলব্ধি করা যায় না। তাই, আমরা মায়ের জাত, তোমার ধূমকেতুর রুদ্র জ্বালা দেখে অমঙ্গল-আশঙ্কায় কেঁপে উঠব না। কেন না, মঙ্গল-দীপ সাজাবার ভার আমাদেরই হাতে। ধূমকেতু ভগবানের বিদ্রাহী ছেলে।। মা বিদ্রোহী দুরন্ত ছেলেকে শান্ত করবার শক্তি রাখে। অতএব ভয় নেই; তাই বলে অহংকারও কোরো না। কর্ম করে যাও, তোমার যাত্রা শুরু কর, বল মাভৈঃ। তিমিররাত্রির অবসানে যখন অরুণ রাগে তরুণ সূর্য্যের উদয় হবে, তখন তোমার এই ধূমকেতু আলোর সেতু হয়ে আঁধারের পারে নিয়ে যাবে। প্রার্থনা করি যতদিন এই আগুনের শিখা এই ধূমকেতুর প্রয়োজন, ততদিন এ অমঙ্গল মঙ্গলমতে নিরাপদে থাক্।
আশীর্বাদিকা
শ্রীবিরজাসুন্দরী দেবী
শরৎচন্দ্র পণ্ডিত যিনি দাদাঠাকুর নামে পরিচিত, তাঁর জঙ্গিপুর সংবাদে লিখলেন:
ধূমকেতুর প্রতি বিষহীন ঢোঁড়ার অযাচিত আশীর্বাদ
ধূমকেতুতে সওয়ার হয়ে আসরে আজ নামল কাজী
আয় চলে ভাই কাজের কাজী!
তোর সাচ্চা কথার আচ্ছা দাওয়াই পাবে যারা বেইমান পাজি
আয় চলে ভাই কাজের কাজী!
হাবিলদার আজ আবিলতার কলজে বিঁধে এপার ওপার
চালিয়ে বুলির গোলাগুলি জাহির কর তোর গোলন্দাজি।
আয় চলে ভাই কাজের কাজী!
কোনটা বদি কোনটা নেকি কোনটা খাঁটি কোনটা মেকি
দেশের লোকের দেখাদেখি রে।
‘নজর-উলের' তীক্ষ্ম নজর খাক করে দিক দাগাবাজি
আয় চলে ভাই কাজের কাজী!
ধরিয়ে দে সব অত্যাচারী পাকড়া যত হত্যাকারী
জোচ্চোরদের দোকানদারি রে।
চোখে আঙুল দিয়ে লোকের দেখিয়ে দে সব ধাপ্পাবাজি
আয় চলে ভাই কাজের কাজী!
জানিস কলির বামুন মোরা কেউটে নই যে আস্ত ঢোঁড়া
কাজেই আশিস ফলে থোড়া রে।
মোদের হরি তোদের খোদা তোর উপরে হউন রাজি
আয় চলে ভাই কাজের কাজী।
২৬শে ভাদ্র,১৩২৯(১২ই সেপ্টেম্বর, ১৯২২) ধূমকেতুর ৮ম সংখ্যায় প্রকাশিত ফজলুল হক সেলবর্সী-এর লেখা:
৩৩, বেনেপুকুর রোড,
কলিকাতা
ভাই কাজী সাহেব,
স্বয়ং বিশ্বকবি যাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ, তাঁকে আমার মতো লোকের ভক্তি নিবেদন করিতে যাওয়াও ধৃষ্টতা।সেই পরম পুরুষকে ধন্যবাদ; আজ মুসলমান বাংলার একটি দৈন্য দূর হইয়াছে। আজ সাহিত্যের পুণ্য আঙ্গিনায় আপনার সমাজ দাঁড়াইবার মত যে স্থানটি পাইয়াছে, তাহা আপনারই দয়ায়। আপনি আমার ভ্রাতা, আপনাকে তোষামদ করিব না। চির অন্ধকারের জীব আমরা, আঁধারে আলোর স্বপ্ন দেথাই আমাদের কাজ। দুর্দিনের 'রাতের ভালে' প্রতিভার আলোক দেখিয়া প্রাণে যে আনন্দ লাভ করিয়াছি, তাহাই একটু ব্যক্ত না করিয়া পারিলাম না।
ফজলুল হক সেলবর্সী
২৯শে ভাদ্র,১৩২৯ সালে (১৫ই সেপ্টেম্বর,১৯২২) ধূমকেতুর নবম সংখ্যায় কবিশেখর কালিদাস রায়ের কাব্যাশিস প্রকিশিত হয়
ভাই নজরুল
তেমার ধূমকেতুকে সাদর আহ্বান করি-
"জাগ ধূমকেতু ধ্বংসের হেতু,
স্বাগত অশিব মহোৎসব,
শিবের শ্মশান, জীবের মশান
স্বাগত অশিব উপ্লব।"
সত্যের জয় হোক। চিত্তের জয় হোক
নিত্যের জয় হোক।
অসত্যের ক্ষয় হোক।
ইতি- তোমার কালী দাদা-
পুনশ্চ- তোমার লেখা পড়ছি আর অবাক হচ্ছি- তুমি নিজেই ধূমকেতু। তোমার লেখনীতে পশুপতের শক্তি।
ইতি আশীর্ব্বাদক
শ্রী কালিদাস রায়
২রা আশ্বিন,১৩২৯ (১৯শে সেপ্টেম্বর,১৯২২) ধূমকেতুর ১০ম সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ধূমকেতু সম্পর্কে শ্রী কুমুদরঞ্জন মল্লিক-এর অনুভূতি:
ও কে এলো আলোরথে
ধূমকেতু সারথি,
অঞ্জলি আগুনের
দিয়ে করে আরতি?
তারা সে বীণার মাঝে
বাজের গমক বাজে,
অনলের মাঝে রাজে
সীতা সম ভারতী।
ধূমকেতুর ঐ সংখ্যাতে মিসেস এম. রহমান লিখেছিলেন:
৭২ মেছুয়াবাজার স্ট্রীট
শ্রদ্ধাস্পদ 'ধূমকেতু' সারথি!
অনেকদিন আগে আমি আপনাকে খেতাব দিয়াছিলাম 'বাঁধন ছেঁড়া', আজ দিলাম 'সত্য সাধক'। সত্যের সাধনায় সিদ্ধিলাভ করুন ইহাই প্রর্থনা।
মিসেস এম. রহমান
তৎকালীন বিভিন্ন সংবাদপত্র ও পত্র পত্রিকায় ধূমকেতু সম্পর্কে লেখা প্রকাশিত হয়:
বাসন্তী ২রা ভাদ্র,১৩২৯
আলোচনা
আমরা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত 'ধূমকেতু' উপহার পাইয়াছি। ধূমকেতু জাতির ও দেশের বাধা বিঘ্ন জড়তা ধ্বংস করিয়া দেশের নূতন প্রাণের উৎস আনয়ন করুক আমরা এই প্রার্থনা করি। চারণ কবির দেশ- মাতান সঙ্গীত ধূমকেতুর আড়ালে উজ্জ্বল হইয়া ফুটিয়া উঠুক।
পরিদর্শক,১০ই ভাদ্র,১৩২৯
...কাজী নজরুল ইসলাম বাংলার সাহিত্যে ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছেন। তাঁহার কলমের জোর আছে, তাঁহার কবিতায় তুবড়ি ছুটে-কথায় আগুন জ্বলে-ভাবে বান ডাকে-ভাষায় ঝলক দেয়। তাঁহার লেখনী যেন কশাঘাত খাইয়া বল্গাহীন উন্মত্ত অশ্বের মত ছুটিয়া চলে। ধূমকেতুর পুচ্ছাঘাতে অনেকেরই চমক ভাঙ্গিবে,নেশা অনেকেরই টুটিবে। কাজেই অত্যাচারী সাবধান হউন।
দৈনিক বসুমতী,১২ই ভাদ্র,১৩২৯
বাঙ্গালার নবীন কবি, সুলেখক, সুগায়ক, স্নেহাস্পদ কাজী নজরুল ইসলাম ভায়া ধূমকেতুকে মাঙ্গলিক বেশে সাজাইয়া বাহির করিয়াছেন, ইহাতে ভয়ের কিছুই নাই, কেবল নামটায় যা কিছু। আশা করি নজরুল ইসলাম সাধনায় সিদ্ধি লাভ করিবেন।
Amrita Bazar Patrika, August 30,1922
"...The editor has already made his mark as a powerful poet and some of his recent poems, particularly the 'Bidrohi' are among the most well known in the Bengali literature. The articles from the editorial pen in the 'Dhumketu' fully sustain the reputation of the soldier poet and the collections he has been able to make are in tune with the fire and energy of his own writings. There is something novel, something enthralling in the new venture. We hope the 'Dhumketu' Or comet will not simply be an emblem of destruction in the hands of the soldier poet but will create something that is beautiful, something that is abiding and holy."
তথ্য ঋণ:
১. নজরুলের ধূমকেতু, সংগ্রহ ও সম্পাদনা: সেলিনা বাহার জামান
২. সমকালে নজরুল ইসলাম, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম
৩. নজরুল তারিখ অভিধান, মাহবুবুল হক
৪. নজরুল জীবনী, অরুণকুমার বসু
সোমঋতা মল্লিক, নজরুল সঙ্গীত শিল্পী এবং সভাপতি, ছায়ানট (কলকাতা)