১
আজ দুপুরের পর পরই অফিস থেকে ফিরেছে তিন্নি। মেয়েদের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে বিকেলবেলা বেডরুমে জানালার পাশে রাখা ইজি চেয়ারটাতে বসল সে। তিন্নি বার বার ঘড়ি দেখছে। যদিও আটটা বাজতে অনেক দেরী আছে তবুও দেখছে। আটটার সময় ইভান ইংল্যান্ড থেকে ফোন করে রোজ। অফিস থেকে ফেরার পর থেকেই সে ঘড়ি দেখতে শুরু করে। এটা তিন্নির অভ্যাস। হঠাৎ পাশের ছাদে বিষণ্ন একটি শালিকের দিকে চোখ পড়তেই তিন্নির মন খুশিতে নেচে উঠল। তিন্নির মনেহলো শালিকটির সঙ্গীটি হয় মরে গিয়েছে, নয়তো ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। সে সঙ্গীর কথা ভেবে বিষণ্ন মনে একা একা বসে আছে। এমন বিষণ্ন শালিককে দেখলে যে কারও মন বিষণ্ন হওয়ার কথা। কিন্তু তিন্নির তা হলো না। কারণ তিন্নি ভাবে, সে মারা গেলে ইভানও ওর কথা মনেকরে এমন বিষণ্নভাবেই একা একা বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিবে। ভাবতেই তিন্নির বুকে অন্যরকম একটা ভালোলাগা দোলা দিল। তিন্নি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে সে মারা গেলে ইভান কোনদিন বিয়ে করবে না। তিন্নিই ইভানের জীবনের প্রথম ও শেষ ভালবাসা।
তিন্নি নিজেকে প্রশ্ন করে, ইভান মারা গেলে সে কি অন্য কাউকে বিয়ে করবে?
না কখনও না। ইভান ছাড়া সে কখনও অন্য কাউকে ভালবাসতে পারবে না।
বিষণ্ন শালিকটির দিকে আবার তাকিয়ে তিন্নির বুকটা কেমন যেন কেঁপে উঠল। এমন বিষণ্ন আর একা! পরক্ষণেই ভাবল, হয়তোবা কাউকে বিয়ে করতেও পারে সে। তবে তার সম্ভবনা খুবই ক্ষীণ। কিন্তু ইভানের ক্ষেত্রে এমন ক্ষীণ সম্ভাবনাও তিন্নি দেখতে পায়না। বেঁচে থাকতেও তিন্নি যেমন ইভানের মন দখল করে আছে, মারা গেলেও তিন্নি এমনিভাবেই ইভানের সারা মন জুড়ে থাকবে। ইভানের মনে অন্য কোন নারীর জায়গা নেই। ওর পুরো মন জুড়ে শুধু তিন্নি আর তিন্নি!
ইভান আর তিন্নির প্রেমের শুরুটা হয়েছিল কলেজ জীবনে। কলেজ শেষে দুজন ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশুনা শেষ করে চাকুরিতে ঢোকে। দুজনই খুব তুখোড় স্টুডেন্ট। চাকরি শুরুর পর তারা বিয়ে করে। বিয়ের বছর দেড়েক পর তাদের প্রথম মেয়ে জন্মায়। এর বছর দুয়ের পর দ্বিতীয় মেয়ের জন্ম। দুই সন্তান আর চাকরি নিয়ে তিন্নির গলদঘর্ম অবস্থা। ইভানের এক সিনিয়র বন্ধুর এনজিওতে চাকরি করে তিন্নি। পরিচিত বলেই ছোট বাচ্চা দুটিকে নিয়ে চাকরিটা করতে পারছে সে। কারণ মেয়েরা ছোট হওয়ায় প্রায়ই তিন্নিকে অফিস কামাই করতে হয়। আজ বড় মেয়ের জ¦র তো কাল ছোটটার পেটের সমস্যা। আজ কাজের মেয়ে আছে তো কাল নেই। চাকরিটা টিকিয়ে রাখতেই তার জান বেরিয়ে যাচ্ছে। হায়ার এডুকেশনের জন্য তিন্নি আর কোন চেষ্টা করেনি। ছোট মেয়ের বয়স যখন তিন বছর তখন ইভান ইংল্যান্ডের সবচেয়ে নামকরা ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করতে যায়। চারবছর হলো ইভান ইংল্যান্ডে। ইভান যাওয়ার দুবছর পর তিন্নি মেয়েদেরকে নিয়ে একবার গিয়েছিল। কমাস পরেই ইভানের পিএইচডি শেষ হবে।
আজ আটটার সময় ফোন করে ইভান তিন্নিকে ইংল্যান্ডে যাওয়ার জন্য ভিসার প্রসেস শুরু করতে বলল। অনেকদিন ধরেই ইভান তিন্নিকে বলছে কথাটা কিন্তু অফিসের বিভিন্ন ঝামেলার কারণে তিন্নি শুরু করতে পারছে না। তিন্নি ইভানকে জানাল, আর দেরি করবে না, দ্রুত কাগজপত্র রেডি করে ভিসার জন্য এপ্লাই করবে।
তিন্নি আজ সেই বিকাল থেকে জানালার পাশের ইজি চেয়ারটিতেই বসে আছে। পাশের ছাদে বসে থাকা বিষণ্ন চড়–ই পাখিটা কখন উড়ে গেছে তিন্নি টের পায়নি। মাঝে একটু তন্দ্রার মতো এসেছিল। শরীরটা আজ একটু খারাপ লাগছিল বলেই অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরেছে সে। চেয়ারে বসে বসেই ইভানের সঙ্গে কথা শেষ করল তিন্নি। শরীর খারাপের কথাটা বেমালুম চেপে গেল ইভানের কাছে। বললেই অস্থির হয়ে পড়বে সে। ডাক্তার বন্ধুদেরকে ফোন করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলবে। আজ মঙ্গলবার হওয়ায় মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে পারল না ইভান। কারণ বরি,মঙ্গল, বৃহস্পতি সপ্তাহে তিনদিন এই সময় মেয়েরা বাসায় রাখা টিচারের কাছে পড়ে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তিন্নি দেখল নটা পার হয়েছে। আজ ইভান ফোন ছাড়তেই চাইছিল না। ইশ! এত দেরী হয়েছে! কাজের মেয়েটিকে টেবিলে খাবার দিতে বলে তিন্নি আগামীকালের জন্য মেয়েদের স্কুলের টিফিন, সকালের নাস্তা আর নিজের অফিসের লাঞ্চ রেডি করতে শুরু করল।
পিএইচডিতে খুব ভালো করার কারণে সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকতা শুরু করে ইভান। এরমধ্যে তিন্নিরা যেয়ে মাসখানেক থেকে ফিরে এসেছে। তিন্নি চায় ইভান ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটির শিক্ষকতাটা আরও কয়েক বছর করুক। এত নামকরা ইউনিভার্সিটি! এখানে পিএইচডি করার সুযোগ পাওয়াই কঠিন। সেখানে শিক্ষকতা করার সুযোগ পেয়েছে ইভান! বিশাল ব্যাপার! এতবড় সম্মান! যদিও ইভানকে ছেড়ে থাকতে তিন্নির খুব কষ্ট হয় তবুও ইভানকে এমন উঁচু জায়গায় দেখতে খুব ভাল লাগে তিন্নির। ইভানের জন্য ওর খুব গর্ব হয় । কিন্তু ইভানের দেশ ছেড়ে, তিন্নি আর মেয়েদেরকে ছেড়ে থাকতে ভালো লাগে না। তাই সেখানে বছরখানেক শিক্ষকতা করার পর ফিরে এলো দেশে। ইভান সবমিলিয়ে প্রায় বছর পাঁচেক ছিল ইংল্যান্ডে। ফিরে এসে ইভান প্রথম সারির উন্নয়ন সংস্থায় ভালো বেতনে চাকরি শুরু করেছে।
তিন্নি আর ইভান দুজনই দেখতে খুব সুন্দর। তিন্নির সৌন্দর্যের সঙ্গে যে জিনিসটি সবার নজর কাড়ে তা হলো ওর ভীষন মিষ্টি চেহারা আর হাসি। ওর হাসি দেখলে যে কেউ প্রেমে পড়ে যায়। আর তাই কিশোরী বয়স থেকে এ পর্যন্ত অসংখ্য ছেলে ওর প্রেমে দেওয়ানা। কিন্তু তিন্নি শুধু ইভানের প্রেমেই দেওয়ানা। ইভান ছাড়া আর অন্য কোন ছেলেকে ভালোবাসতে হয়নি তিন্নির। কারণ ইভানের সঙ্গেই তিন্নির প্রথম প্রেম হয়, যার পরিণতি বিয়ে।
যদি দাঁড়িপাল্লায় মাপা যেত তবে হলফ করে বলা যেত অন্য মেয়েদের তুলনায় স্বামীর প্রতি তিন্নির ভালবাসার ওজনের পরিমান কয়েকগুণ বেশি। যেহেতু তিন্নি ইভানকে খুব বেশি ভালবাসে তাই ইভানের প্রতি তার বিশ্বাসটাও বহুগুণ বেশি। আর বিশ্বাস না হওয়ারও কোন কারণ নেই। ইভানের প্রতিটি আচরনে তিন্নির প্রতি গভীর ভালবাসাই প্রকাশ পায়। তিন্নির প্রতি ইভান খুব যত্নশীল। তিন্নিকে ছেড়ে ইভান ইংল্যান্ডে পিএইচডি করতে যেতে চায়নি। তিন্নিই জোর করে পাঠিয়েছে তাকে। তিন্নির প্রতি ইভানের ভালবাসা আর যত্নশীলতা দেখে তিন্নির বান্ধবীরা রীতিমতো জেলাস!
২
নতুন অফিসে জয়েন করার পর ইভানের ফিরতে রাত আটটা-নটা, কোনদিন দশটাও বাজে। তিন্নি অফিস থেকে ফেরে সন্ধ্যার মধ্যেই। বাসায় এসে সে প্রায়দিন ইভান আর মেয়েদের পছন্দের কিছু খাবার-দাবার বানায়। ইভান ফিরলে চারজন একসঙ্গে রাতের খাবার খায়।
ছুটির এক সকাল। ইভান বাজরে গিয়েছে। ল্যাপটপটা ওর টেবিলের উপর খোলা রয়েছে। হঠাৎ তিন্নির বস ফোন করে জানায়, কি একটা জরুরি ফাইল এখনই মেইল করতে হবে তাকে। তিন্নি নিজের ল্যাপটপ খুলে বসল, ধ্যাৎ ল্যাপটপটা অন হচ্ছে না! প্রয়োজনের সময় এমন যন্ত্রণা যে হবে সে আর বলতে! সে ল্যাপটপটা গুতাগুতি করছে খোলার জন্য। খোলা দূরে থাক, বদমায়েসটা অনই হচ্ছে না। মুখটা অমাবশ্যার রাতের মতো ঘুটঘুটে আন্ধকার করে আছে। এরমধ্যে আবার অফিস থেকে বসের ফোন, তিন্নি এখনই ফাইলটা মেইল না করলে, আমরা খুব বিপদে পড়ব। কি আর করা, অগত্যা তিন্নি ইভানের ল্যাপটপে যেয়ে বসল। মেইলটা লিখছে। ইভান ফেসবুক মেসেঞ্জার ওন করে রেখে গিয়েছে। একটু পর পর ইভানকে করা সুস্মির মেসেজের নোটিফিকেশন আসছে। সুস্মিকে তিন্নি চেনে। ইভানের অফিসেই সে চাকরি করে। তবে সুস্মি অন্য ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। মেয়েটা দেখতে সুন্দর, স্মার্ট। অফিসে সুস্মির সঙ্গে ইভানের তেমন কোন কাজ থাকার কথা না। কিন্তু একই অফিসে চাকরি করলে অনেক সময় কাজ পড়তেও পারে। আর কাজ ছাড়াও কলিগ হিসেবে সুস্মি মেসেজ পাঠাতেই পারে ইভানকে। তিন্নি মেইল লেখায় মনোযোগ দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেইলটি পাঠিয়ে দিল। সুস্মি এইটুকু সময়ের মধ্যে অসংখ্যবার মেসেজ পাঠিয়েছে। বার বার কম্পিউটারে ভেসে উঠছে, সুস্মি মেসেজড ইউ। তিন্নি ভাবল, হয়ত অফিসের খুব জরুরি কোন বিষয়ে সুস্মি ইভানকে বার বার নক করছে।
একটু আগেই বাজরে গেল ইভান। সারা সপ্তাহের মাছ, মাংস, তরকারি, মুদির দোকানের কেনাকাটা রাজ্যের বাজার! সবকিছু ছুটির দিনেই করে রাখে ইভান। কারণ সারা সপ্তাহে সময় হয় না তার। অফিস আর সংসারের ব্যস্ততার কারণে তিন্নিও বাজারে যেতে পারে না। বাজারের পুরো দায়িত্ব ইভানের উপর। ফিরতে ফিরতে আরও মিনিমাম দু থেকে আড়াই ঘন্টা লাগবে। বাজার নিয়ে ব্যস্ত থাকায় নিশ্চয় ইভানকে ফোনে রিচ করতে পারছে না সুস্মি। খুব জরুরি না হলে এতটুকু সময়ের মধ্যে তার এত অসংখ্যবার মেসেজ দেয়ার কথা নয়।
যত ব্যস্তই থাকুক ইভান অন্যকারও ফোন না ধরলেও সাধারণত তিন্নির ফোন ধরে। এমনকি মিটিং-এ থাকলেও ফোনটা ধরে ফিসফিসিয়ে বলে আমি মিটিং এ। তিন্নি ভাবল, ড্রাইভার তো ইভানের সঙ্গেই আছে, যদি ইভান একান্তই তিন্নির ফোন শুনতে না পায় তাহলে ড্রাইভারকে জানালে ইভান ফোন ব্যাক করবে। আগে সুস্মির সঙ্গে কথা বলে বিষয়টা জেনে নিই। যদি খুব জরুরি হয়, সুস্মি যদি বলে এখনই ইভানের সঙ্গে কথা বলতে হবে, তাহলে তিন্নি ইভানের সঙ্গে যোগাযোগ করে সুস্মিকে কল দিতে বলবে। খুব জরুরি না হলে তিন্নি শুধু শুধু বাজারের হচপচ অবস্থার মধ্যে ফোন করবে না ইভানকে। ও খুব বিরক্ত হবে।
সুস্মির সঙ্গে কথা বলার জন্য তিন্নি ইভানের মেসেঞ্জারটি ওপেন করল, প্রথমে যা দেখল তাতে তিন্নির পায়ের মাটি নড়ে উঠল। একটু ধাতস্থ হয়ে ভাবল, সে ভুল দেখছে। চোখ রগড়াল, এরপর বেসিনে যেয়ে মুখ- চোখ ভালোভাবে পানি দিয়ে ধুয়ে এসে আবার মেসেঞ্জারের সামনে বসল। না, ভুল সে দেখেনি। এতটুকু সময়ের মধ্যে ইভানকে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশবার লাভ ইমোজিসহ ‘আই লাভ ইউ’ ‘আই মিস ইউ’ লিখেছে সুস্মি। তিন্নি ভাবল, সুস্মি ইভানকে ‘আই লাভ ইউ’, ‘আই মিস ইউ’ আরও অনেক কিছু লিখতেই পারে, তাকেও তো মেসেঞ্জারে ছেলেরা কত কিছু লিখে। ইভানের মতো এমন মেধাবী, সুন্দর, স্মার্ট পুরুষকে সুস্মি কেন, সুস্মির মতো হাজারও মেয়ে এসব কথা বলবে এটা খুবই স্বাভাবিক।
তিন্নি নিজেকে ধিক্কার দিল, ছি! সুস্মির পাঠানো মেসেজগুলোর উপর চোখ পড়তেই কেন সে এমন ঘাবড়ে গিয়েছিল! এত নীচ আমি! সে ভাবল, এত বছরের সম্পর্ক আমাদের! একটা মেয়ের লেখা দুটি বাক্যেই তা নড়ে উঠল! আমার আসলে মাথায় সমস্যা আছে!
এবার সে মেসেঞ্জার স্ক্রল করে ধীরে ধীরে নীচে নামতে শুরু করল। প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটি লাভ ইমোজিসহ সুস্মির মেসেজগুলো শেষ হওয়ার পর, যা দেখল তাতে তিন্নির বুকটা একদম ফাঁকা হয়ে গেল। তার পুরো শরীর দুলতে শুরু করল, যেন ভুমিকম্প সারা পৃথিবীটার সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরটাকেও দোলাচ্ছে। চোখ জোড়া ঘোলা হয়ে এলো।
বাজারে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ইভান সুস্মিকে অজ¯্রবার লাভ ইমোজিসহ ‘আই লাভ ইউ’ লিখেছে। আরও লিখেছে, ছুটে যেতে মন চাইছে। একদিন নয়, এ যেন এক যুগ মনেহচ্ছে। ইশ! কেন যে এই শুক্রবারটা আসে! তোমাকে একমুহূর্ত না দেখে থাকতে পারি না! এমন অজশ্র আবেগঘন কথা। ইভানের এমন মেসেজের মাঝে মাঝে সুস্মিরও আবেগঘন অনেক মেসেজ তিন্নি দেখল।
মেসেজগুলো দেখার পর তিন্নি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না, মেঝেতে ঢলে পড়ে। ছুটির দিন হওয়ায় মেয়েরা তখনও ঘুমাচ্ছে। কাজের মেয়েটি রান্না ঘরে কাজে ব্যস্ত। ইভান বাজার থেকে ফিরে তিন্নিকে জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে কিছুই বুঝতে পারে না। সে তিন্নিকে মেঝে থেকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিল। মুখ চোখে পানি ছিটালো। একটু পর তিন্নির জ্ঞান ফিরল। তিন্নি ইভানের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে! যেন ইভানকে সে চিনে না! যেন ইভানকে সে কোনদিন দেখেনি! ইভান তিন্নির এমন অদ্ভুত আচরণে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তিন্নিকে ধরে ঝাকুনি দিতে দিতে বলে, এই তিন্নি কি হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন? তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? এই তিন্নি?
ইভানের মনে একবারের জন্যও এই ভাবনা আসেনি, সে সুস্মির সঙ্গে কথা বলতে বলতে মেসেঞ্জার খোলা রেখে চলে গিয়েছে। তিন্নি হয়ত দেখেছে বলে এমন অদ্ভুত আচরন করছে। এমন ভাবনা তার হওয়ার কথা নয় কারণ ইভানের প্রতি তিন্নির বিশ্বাসটা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি সেটা ইভান জানে। স্বামীর প্রতি সাধারণ বিশ্বাস সম্পন্ন মেয়েরাই কোন সন্দেহের উদ্রেক না হলে স্বামীর অনুপস্থিতিতে লুকিয়ে তাদের মেসেঞ্জার চেক করে না। এতে তার নীচুতা প্রকাশ পায়। নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে যায়। আর তিন্নির তো এমন কাজ করার প্রশ্নই আসে না। ওর নিজের আলাদা ল্যাপটপ আছে, যদি ওর আলাদা ল্যাপটপ না থাকত তাহলে ইভান নিজেই সতর্ক হতো। আর ছুটির দিন সে এতটাই ব্যস্ত থাকে সেটা বলে বুঝানো যাবে না। সারা সপ্তাহের কাজ সে গুছিয়ে রাখে এই একদিনে। নিঃশ্বাস নেয়ার সময় হয়না তার। এরমধ্যে কোন কারণ ছাড়া ইভানের মেসেঞ্জার চেক করার প্রশ্নই আসে না।
তিন্নির দু কাঁধ ধরে ইভান আবার ঝঁকুনি দিয়ে বলল, কি হয়েছে বলো প্লিজ! এবার তিন্নি দুহাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে উঠল, ‘ইভান আমি সহ্য করতে পারছি না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ইভান! খুব যন্ত্রণা হচ্ছে! আমি এখন কি করব! আমি এখন কি নিয়ে বাঁচব ইভান!’
ইভান তিন্নির মুখ থেকে হাত সরিয়ে জিজ্ঞেস করল, পাগলের মতো এসব কি বলছ! কেন বলছ! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!
‘তুমি সুস্মিকে এসব ---’ তিন্নি শেষ করতে পারল না কথাটা। আবারও সে ঢলে পড়ল বিছানার উপর।
ইভান ল্যাপটপের কাছে যেয়ে সবকিছু বুঝল।
জ্ঞান ফেরার পর ইভান তিন্নির কাছে এসে হাত জোর করে মাফ চাইল। অনেক অনুনয়-বিনয় করে বলল, এবারকার মতো মাফ করে দাও প্লিজ। আসলে সুস্মি সারাক্ষণ আমার পেছনে এমন আঠার মতো লেগে থাকত, আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি।
ইভান অনেক মাফ চাওয়ার পর, অনেক বুঝানোর পর তিন্নি ভাবে, বাইরের একটা মেয়ের জন্য আমি নিজে কেন এত কষ্ট পাব! সংসারের সবাইকে কেন এত কষ্ট দিব! আসলে ইভান কখনই এমন করত না। ইভান এমন ছেলেই নয়। ইভানকে আমি সেই কলেজ জীবন থেকে চিনি। ইভান আমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালবাসে না। বাসতেই পারে না। আসলে সব দোষ ঐ সুস্মির। সুস্মি সারাক্ষণ ইনিয়ে বিনিয়ে ভালবাসার কথা বলেছে, সবসময় পিছে লেগে থেকেছে বলেই ওর প্রতি ইভানের সাময়িক একটা আবেগ তৈরী হয়েছে। আমার প্রতি, নিজের মেয়েদের প্রতি ইভানের ভালবাসা কত গভীর! ইভানের মতো স্নেহশীল বাবা, দায়িত্বশীল স্বামী কখনও এমন হতে পারে না! সুস্মির মতো ছলনাময়ী, চরিত্রহীন মেয়েদের পাল্লায় পড়ে ইভানের মতো সৎ ছেলেরা এমন একটু আধটু ভুল করতেই পারে!
তিন্নি নিজেকে প্রতিদিন এভাবে বুঝাতে বুঝাতে একসময় স্বাভাবিক হয়ে আসে। বিষয়টি না ভুললেও সেটা আর তাকে কষ্ট দেয় না। আবার ইভানকে সে আগের মতো বিশ্বাস করে।
৩
ভালই চলছিল সবকিছু। হঠাৎ একদিন সে মেসেঞ্জারে একটা মেসেজ পায়। রিয়া নামের খুব সুন্দরী অল্প বয়সী এক মেয়ে তাকে মেসেজ দেয়, আপু আপনার স্বামীকে বলেন, আমাকে যেন আর ডিস্টার্ব না করে। আমি আর তার সঙ্গে থাকতে চাই না। সে একটা নোংরা ও অসৎ চরিত্রের মানুষ, আমি প্রথমে বুঝিনি। বুঝতে পেরে সরে এসেছি । আমি এখন তাকে ঘৃনা করি। আমি এখন অন্য একজনকে ভালবাসি। আমি তাকে সব বলেছি। আমরা কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ে করব। আপনার স্বামী সারাক্ষণ আমাকে তার সঙ্গে দেখা করতে বলছে। ওকে সব জায়গা থেকে ব্লক করেছি। কিন্তু সে নতুন নতুন আইডি খুলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। মেইল পাঠিয়ে যন্ত্রণা করছে। প্লিজ আপু আপনার স্বামীকে থামান।
তিন্নি প্রথমে একদম বিশ্বাস করেনি রিয়ার কথা। মেসেঞ্জারে উল্টা রিয়াকেই গালিগালাজ করে সে। তিন্নির ঘরে, তিন্নির বাসরের খাটে ইভানের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কিছু ছবি তাকে পাঠায় রিয়া। যেগুলো দেখে তিন্নি বাকরুদ্ধ হয়ে যায়!
রিয়া জানায়, তিন্নি গত রোজার ঈদে যখন ময়মনসিংহে বাবার বাড়ি গিয়েছিল তখন ইভান রিয়াকে রোজ বাসায় আনত। বিয়ের পর ঢাকায় তিন্নির শ্বশুরের কিনে দেয়া এই ফ্ল্যাটেই তিন্নিরা ওঠে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত তিন্নি এখানেই আছে। বাসর রাতের সেই খাটটিতেই তিন্নি এখনও ঘুমায়। তিন্নি যখন ঈদ করতে বাবার বাড়িতে গিয়েছিল তখন ইভান অফিসের কাজের অজুহাতে ঢাকায় ছিল। তিন্নির বাবার বাড়ি আর শ্বশুড় বাড়ি একই শহরে হওয়ায় ঈদে গেলে দুজায়গা মিলিয়ে তাকে বেশ কিছুদিন থাকতে হয়।
এবারও ইভান তিন্নির কাছে মাফ চায়, অনেক বুঝায়। তিন্নি এখন বুঝতে পারে, ইভান আগাগোড়ায় একজন অসৎ চরিত্রের ছেলে ছিল। কিন্তু সে প্রথম থেকে তাকে এত বিশ্বাস করত, এত ভালবাসত, কখনই কোন সন্দেহ মাথায় আসেনি। তিন্নির মনেপড়ে, বিয়ের পর পর তার ছোট বোন মিমিকে ইয়ার্কির ছলে ইভান এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছিল, মিমির বিষয়টি একদম ভাল লাগেনি। তিন্নির কাছে এ বিষয়ে অভিযোগও করেছিল মিমি। কিন্তু তিন্নি উল্টো মিমিকে ধমক দিয়ে বলেছিল, দুলাভাই হয় বলে একটু ইয়ার্কি করে, তুই এমন মাইন্ড করিস কেন! এরপর থেকে তিন্নি খেয়াল করেছে ইভান ওদের বাড়িতে গেলে, মিমি তাকে এড়িয়ে চলে সবসময়। তিন্নি মনে মনে ভাবে, মিমিটা একদম কাঠখোট্টা গোছের হয়েছে। দুলাভাইয়ের একটু ইয়ার্কিও সহ্য করতে পারে না। একই অভিযোগ তিন্নির এক বান্ধবীও করেছিল। তাকেও তিন্নি একইভাবে ধমক দিয়েছিল।
রিয়ার ঘটনাটি জানার পর তিন্নি ইভানকে ডিভোর্স দেয়ার কথা ভাবে। কিন্তু সে তার ভালবাসার কাছে পরাজিত হয়। ইভানকে সে কিছুতেই ছাড়তে পারে না। ইভান তার জীবনে থাকবে না, ইভানকে সে চাইলেই ছুঁতে পারবে না, চাইলেই সে ইভানের গায়ের গন্ধ নিতে পারবে না, এসব ভাবলেই সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আবার ইভানের সঙ্গে থাকতেও তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, যন্ত্রণা হচ্ছে। দিনে-রাতে যতবার সে খাটে শুতে আসে ততবার সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। এই খাটে ইভান অন্য মেয়েকে নিয়ে কিভাবে শুয়েছিল। ওর কি একবারও মনেহয়নি আমার কথা!
তিন্নি অসুস্থ হয়ে পড়ে। সারারাত সে ঘুমাতে পারে না। খেতে পারে না। প্রায় সারারাত সে কেঁদেই কাটিয়ে দেয়। দিনের বেলা অফিস আর মেয়েদেরকে নিয়ে থাকে বলে কাঁদতে পারে না। তবে বুকের ভেতরে যেন একটা আগুনের কু- জ্বলতে থাকে সবসময়। একসময় সে মানসিক ডাক্তারের শরনাপন্ন হয়। মা-বাবা, ভাইবোন সবাই ইভানকে ছাড়ার পরামর্শ দেয়। কিন্তু ইভানকে ছাড়ার কথা ভাবলেই তিন্নির হাত পা অবশ হয়ে আসে, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। ইভানকে ছাড়া সে তার জীবন চিন্তা করতে পারে না। ইভানকে সে আগের মতোই ভালবাসে। কিন্তু পার্থক্য হলো ইভানের প্রতি এখনকার ভালবাসাটা ভয়ংকর যন্ত্রণা আর কষ্ট মিশ্রিত। ইভানের স্পর্শের জন্য সে উন্মুখ হয়ে থাকে। রাতে ইভান যখন তাকে কাছে টানে তখন সে যেন মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু ভুলে যায়। দুটি শরীর যতক্ষণ এক হয়ে মিশে থাকে ততক্ষণ তিন্নির মনেহয় ইভান তারই আছে। আগের মতোই সে ইভানকে সন্তুষ্ট করতে পারে। কিন্তু দুটি শরীর আলাদা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাসরের খাটে ইভান আর রিয়ার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের সেই ছবিগুলো। এতক্ষণ তিন্নি যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল! ঘোর কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিন্নি ডুকরে কেঁদে ওঠে। প্রায় রাত এভাবেই কাটে তিন্নির। ইভান তাকে যথারীতি বুঝায়, সে ভাল হয়ে গিয়েছে, আর সে এমন করবে না। তিন্নি ইভানের কথাগুলো বিশ্বাস করে না।
তিন্নির বন্ধুরা ওকে অনেক তিরস্কার করে ইভানের মতো এত নীচ আর ভন্ড একজন মানুষের সঙ্গে থাকার জন্য। তিন্নি বলে, আমি নিজের কাছে অসহায়। আমি ওকে ছাড়তে পারছি না। ওর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে থাকতেও পারছি না। তিন্নিকে হাই ডেজের ঘুমের ওষুধ দিয়েছে ডাক্তার কিন্তু ওষুধেও ঘুম হয় না ওর।
ইভানকে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবারে ফলো করে তিন্নি বুঝতে পারে সে একসঙ্গে অনেক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে। বসুন্ধরার একদম শেষ মাথায় তাদের আর একটি ফ্ল্যাট আছে, ওখানেই সে বিভিন্ন মেয়েদেরকে নিয়ে যেয়ে সময় কাটায়। ফ্ল্যাটটি ফাঁকা রেখেছে সে। ইভান বাবা-মার একমাত্র ছেলে হওয়ায় ওর সিদ্ধান্তই বাবা-মা মেনে নেয়।
ইভান এখন আর কিছু লুকাতে পারে না। লুকাতে না পারার আর একটি কারণ হলো, একসঙ্গে বিভিন্ন মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারণে ওর সঙ্গে একেক সময় একেক মেয়ের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তখন তারা তিন্নিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। তারা তিন্নিকে ইভানের নামে অভিযোগ করে। গত দশ-পনের বছরে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ,ভাইবারের যথেচ্ছা ব্যবহারের কারণে ইভানের আরও বেশি পতন হয়েছে বলে তিন্নি মনেকরে।
এরমধ্যে একটা মেয়ে ওকে জানায়, ইভানের সঙ্গে থাকার কারণে সে দুবার বাচ্চা নষ্ট করেছে। সেই মেয়ে তিন্নিকে আরও বলে, আপনি তাড়াতাড়ি ইভানকে ডিভোর্স দেন। এভাবে আমি আর থাকতে পারছি না। আমি বিয়ে করে ইভানের সঙ্গে থাকতে চাই। ইভানকে বহুবার বলেছি, আপনাকে ডিভোর্স দিতে কিন্তু তার এক কথা সে আপনাকে ডিভোর্স দিবে না কখনও। তিন্নি অবাক হয়ে ভাবে, যা শুনছে তা কি বাস্তব! নাকি সে স্বপ্ন দেখছে!
ইভান প্রথম থেকেই নিশ্চিত ছিল তিন্নি কখনও ইভানকে ছেড়ে থাকতে পারবে না, যাবে না কখনও ইভানকে ছেড়ে। রিয়ার সঙ্গে তার বাসরের খাটে অন্তরঙ্গ ছবিগুলো দেখার পরও তিন্নি তাকে ছেড়ে না যাওয়ায় ইভানের এই ধারণা আরও পাকাপোক্ত হয়েছে। এ কারণে ইভান যেন আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। এখন সে প্রায় দিনই গভীর রাত করে বাসায় ফেরে।
তিন্নি নিয়মিত মানসিক ডাক্তারের কাছে যায়। গাদা গাদা ওষুধ খায়। এরপরও প্রায় দিন তিন্নির প্যানিক অ্যাটাক হয়। তিন্নি সারারাত কাঁদে। নামাজে বসে কাঁদে। তিন্নির মা-বাবাসহ সবাই অনুরোধ করে ইভানকে ডিভোর্স দিতে। কিন্তু তিন্নি পারে না। তিন্ন অসহায়! নিজের কাছে ভীষণ অসহায় সে!
তিন্নি একদিন ইভানকে বলে, আমি যেহেতু তোমাকে ডিভোর্স দিতে পারছি না, তুমি আমাকে ডিভোর্স দাও প্লিজ। তাহলে আমার আর করার কিছু থাকবে না। তোমার কাছ থেকে আমি চলে যেতে বাধ্য হব। কিন্তু ইভান বলে, আমি তোমাকে কখনও ডিভোর্স দিব না।
কেন?
আমি তোমাকে ভালবাসি।
ইভানের মুখ থেকে ভালবাসা শব্দটি শোনার পর তিন্নির বমি চলে আসে। সে বাথরুমে যেয়ে হল হল করে বেসিন ভরে বমি করে।
৪
এত ঝড়ঝাপটার মধ্যে আগের মতো না হলেও তিন্নি এখনও যথেষ্ট সুন্দরী আছে। ওর মিষ্টি হাসি দেখলে এখনও যেকোন পুরুষের বুক উত্তাল সাগরের মতো উথাল-পাথাল করে। তিন্নির ঘনিষ্ঠ বান্ধবী সিঁথি বলে, তুই অন্য কোন ছেলের প্রেমে পড়লেই ইভানকে ছাড়তে পারবি, তার আগে নয়। আসলেই কি তাই! তিন্নি জানে না। সিঁথির পরামর্শে তিন্নি ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করেছে। উদ্দেশ্য বন্ধুত্বের সম্পর্কটি ধীরে ধীরে প্রেমে গড়াবে। ফেসবুকে ও পরিচিতদের মাধ্যমে অনেক ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্বও হয়েছে তিন্নির। কিন্তু কোন ছেলে এগুতে চাইলে তিন্নি যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। তিন্নি পারে না, ইভানকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালবাসতে পারবে না সে।
এখন প্রায়ই বিভিন্ন মেয়েরা মেসেঞ্জারে তিন্নির কাছে ইভানের নামে অভিযোগ করে। অল্প বয়সী বিভিন্ন মেয়েরা ইভানের টার্গেট। প্রথমে ইভান বিভিন্ন অল্প বয়সী মেয়েদেরকে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠায়, ওরা এমন হাই প্রোফাইলের একজনকে তার সঙ্গে অ্যাড করতে পেরে গর্বিত হয়। এরপর ইভান যখন সেসব মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে চায়, তারা খুব আগ্রহ নিয়ে কথা বলে। কথা চালাতে চালাতে কিছু কিছু মেয়ে তার টোপে পা দেয়। কিন্তু কিছুদিন পর তাদের মধ্যে কেউ কেউ বুঝতে পারে সে ভয়ংকর চরিত্রহীন একজনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। তারা ইভানের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। তখন ইভান তাদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যোগাযোগের চেষ্টা চালায়। কখনও কখনও ভয়ও দেখায় তাদেরকে। তখন তারা তিন্নির কাছে অভিযোগ করে ইভানের সম্পর্কে। কেউ কেউ তিন্নির কাছে সাহায্যও চায়। এসব শুনে এখন আর তিন্নি অবাক হয় না, বিস্মিত হয় না, ক্ষুব্ধ হয় না! শুনে শুধু হাসি পায় তার, করুন সে হাসি!
ফেসবুকে দীপন নামে একটা ছেলের সঙ্গে তিন্নির পরিচয় হয়েছে। দীপন তাকে জানায় কলেজ জীবন থেকে তিন্নিকে পছন্দ করে সে। কিন্তু তিন্নি ইভানকে ভালবাসত বলে কথাটা তাকে বলতে পারেনি দীপন। তিন্নির জন্যই সে রুয়েট, কুয়েটে চান্স পাওয়ার পরও ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিল। শুধু তিন্নিকে দেখতে পাবে সে আশায়। দীপন সবসময় আশায় আশায় থেকেছে যদি ইভানের সঙ্গে তিন্নির কখনও ব্রেকআপ হয় তখন সে তিন্নিকে তার ভালবাসার কথা জানাবে। কিন্তু তাদের এত গভীর প্রেম! সেই সুযোগ আর পায়নি দীপন।
সুন্দরী আর মিষ্টি চেহেরার মেয়ে তিন্নির প্রেমে কিশোরী বয়স থেকে অনেক ছেলে হাবুডুবু খেত। তিন্নি সেটা জানত। কিন্তু তিন্নির প্রতি দীপনের এত গভীর প্রেম! ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া বাদ দিয়ে শুধু তিন্নির জন্য ঢাকা ভাসির্টিতে ভর্তি হয়েছে সে! কথাটা শুনে তিন্নির কেন জানি খুব ভাল লাগল। অনেকদিন পর তার ভেতরে অন্য কোন ছেলের জন্য অন্যরকম এক ভাল লাগার অনুভুতি জাগল। ভার্সিটিতে পড়ার সময় দীপনকে তিন্নি চিনত। কিন্তু বিষয়টি জানত না। দীপন খুব চাপা স্বভাবের ছেলে। দীপন আরও জানায়, সে বিয়ে করেছে। প্রায় পনের বছরের সংসার জীবন তাদের। কিন্তু কিছুদিন হলো তাদের সম্পর্ক ভাল যাচ্ছে না। তারা ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ফেসবুকে তিন্নিকে অনেক খুঁজেছে দীপন। কিন্তু এতদিন পর সে পেল। আসলে তিন্নির প্রোফাইল এতদিন লক করা ছিল। বান্ধবী সিঁথির পরামর্শে কিছুদিন হলো সে প্রোফাইলটা পাবলিক করেছে। এখন তিন্নির মনেহচ্ছে, ইভানের সঙ্গে এভাবে থাকলে সে পাগল হয়ে যাবে। কিন্তু ইভানকে সে এখনও ছাড়তে পারছে না। সে বুঝতে পারছে কারও প্রেমে না পরা পর্যন্ত ইভানকে সে ছাড়তে পারবে না। সিঁথি শুরু থেকেই তাকে এই কথা বলত। কিন্তু এখন তিন্নি নিজেও এটা বিশ্বাস করে। যদিও বলে কয়ে, এভাবে প্রস্তুতি নিয়ে তো আর প্রেম হয় না। কিন্তু প্রেমের বিষয়টা সে এখন সিরিয়াসলি মাথায় নিয়েছে। আর সেকারণে মনের মানুষকে খুঁজে পেতে সে তার প্রোফাইল পাবলিক করেছে।
মেয়েরা যথেষ্ট বড় হয়েছে। বড়টা ভার্সিটির প্রথম বর্ষে, আর ছোট মেয়ে কলেজে পড়ে। বেশিরভাগ সন্তানই চায় না মা-বাবা আলাদা থাকুক। কিন্তু ওর মেয়েরা বাবার এসব কুর্কীতি দেখতে দেখতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে। ওরা এখন মাকে নিয়মিত চাপ দিচ্ছে, আলাদা থাকতে। এখনও তিন্নি পারবে তা ভাবছে না। তবে সে সিরিয়াসলি চেষ্টা করছে।
দীপনের সঙ্গে কথা বলতে তিন্নির খুব ভাল লাগে। দীপনের সঙ্গে পরিচয়ের তিন-চার মাসের মধ্যেই তিন্নি তাকে ইভানের বিষয়টি বলে। দীপন মনে মনে খুশি হয়। কিন্তু সেটা প্রকাশ করে না। বন্ধুর মতোই চলতে থাকে তাদের সম্পর্ক। একসময় দীপন আর তার বউয়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তিন্নি খবরটা শুনে খুশি হয় কিন্তু সেটা প্রকাশ করে না। এখন একদিন দীপনের সঙ্গে কথা না বললে তিন্নির খারাপ লাগে, খুব খারাপ লাগে। দীপনের বউ নেই। ইভানও সারাদিন অফিসে থাকে, অনেক রাত করে ফেরে। তিন্নি অফিসের ফাঁকে ফাঁকে দীপনের সঙ্গে কথা বলে, বাসায় ফিরেও ইভান আসার আগ পর্যন্ত কথা বলে। একসময় তিন্নি খেয়াল করে দীপনকে সে ভালবাসে। ইভানের জন্য তার আর কোন ভালবাসা নেই। ইভানের দেয়া কষ্টগুলো তাকে আর কষ্ট দেয় না। তিন্নির সারা মনপ্রাণ এখন দীপন দখল করে নিয়েছে। তিন্নি দীপনকে সে কথা জানায়। দীপন বলে, আমি এদিনটির জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলাম। তিন্নি ইভানকে ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
ইভানকে সে সিরিয়াসলি ডিভোর্সের বিষয়টি জানায়। ইভান প্রথমে বিশ্বাস করেনি। ভেবেছে আগের মতোই ইভানকে ভয় দেখানোর জন্য বা রাগ করে বলছে। কারণ ইভান জানে তিন্নি তাকে ছাড়তে পারবে না। কিন্তু সে যখন বুঝতে পারল, তিন্নি সত্যি সত্যি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ইভানকে ছাড়ার, তখন অবাক হয়ে সে তিন্নির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। এরপর সে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। সে তিন্নিকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না। আমাকে আর একটাবার সুযোগ দাও। আমি সব ছেড়ে তোমাকে নিয়েই থাকব।
তিন্নি ইভানের কথা আর বিশ্বাস করল না। কারণ আগে বহুবার একথা শুনেছে তিন্নি। তিন্নি ইভানকে এমন কথাও বলেছে, তুমি সব মেয়েদেরকে ছেড়ে ভাল হয়ে যাও ইভান। আমি তোমার আগের দেয়া সব কষ্ট ভুলে সুখী হতে পারব। আমি যদি শুধু বুঝতে পারি, অন্যকোন মেয়ের সঙে তোমার কোন সম্পর্ক নেই, তুমি এখন শুধু আমাকেই ভালবাস, তাহলেই আমি পৃথিবীর সেরা সুখী হতে পারব ইভান! প্লিজ ইভান ভাল হয়ে যাও। আমরা আমাদের মেয়েদেরকে নিয়ে বাকি জীবনটা সুখে কাটিয়ে দেই। কিন্তু ইভান শোনেনি। নতুন নতুন মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্কের কথা তিন্নির কাছে ফাঁস হওয়ার পর সে বলেছে, আমাকে আর একটাবার সুযোগ দাও। আমি সব ছেড়ে তোমাকে নিয়েই থাকব। কিন্তু কিছুদিন পর আবারও সে জড়িয়ে পরে বিভিন্ন মেয়েদের সঙ্গে।
ইভানের একথা আর বিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না। আর বিশ্বাস করেও এখন আর লাভ নেই কারণ তিন্নি এখন দীপনকে ভালবাসে। ইভানের প্রতি ওর আর কোন ভালবাসা নেই।
তিন্নি ডিভোর্সের জন্য উকিলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছে। এখন ইভান অফিস থেকে রাত আটটা-নটার মধ্যেই বাসায় ফিরে। বাসায় ফিরতে সে আর গভীর রাত করে না। ফেসবুক চালায় না। হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার কোন কিছুতেই সে আর এ্যাকটিভ থাকে না। আগে ঘুমানোর সময়টুকু ছাড়া বাকি পুরোটা সময় সবগুলো যোগাযোগ মাধ্যমে সে এ্যাকটিভ থাকত। একসঙ্গে সবগুলো মাধ্যম সে অন রাখত। তিন্নি ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকে ইভান অফিস শেষে বাসায় এসে শুয়ে অথবা বসে থাকে চুপচাপ। খাওয়া-দাওয়াও করে না ঠিকমতো। অফিসে যতক্ষণ থাকে তখনও ফোন ছাড়া তার সবগুলো যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ থাকে। তিন্নি ভাবে এটা তার নতুন চাল।
তবে তিন্নি কিছুতেই বুঝতে পারে না, কেন ইভান এতদিন তিন্নিকে ডিভোর্স দেয়নি! অনেক ভেবেছে সে কিন্তু কোন উত্তর পায়নি। তিন্নির সঙ্গে থাকার কারণে তার লাম্পট্য কিছুটা হলেও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তিন্নিকে ডিভোর্স দিলে তার লাম্পট্যের রাস্তা তো ক্লিয়ার হতো। আবার তিন্নি যখন সিরিয়াসলি ডিভোর্স দিতে চাইছে তখন সে কেন বাধা দিচ্ছে! কেন সে ডিভোর্স চায় না! সামাজিক কারণ কি! তিন্নি ভাবে, না, সমাজকে সে বিন্দুমাত্র কেয়ার করে না। সমাজকে যদি সামান্যতম কেয়ার করত তাহলে একজন মানুষ এত নীচু কাজ বছরের পর বছর ধরে চালাতে পারত না! তাহলে কেন! তিন্নি বুঝতে পারে না!
প্রতিদিন রাতে ইভান তিন্নিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে, আমি তোমাকে ভালবাসি, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না। তিন্নির সামনে হাতজোড় করে অনুরোধ করে, তিন্নি প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না! তিন্নি ভাবে সবই অভিনয়! ইভানের মুখ থেকে ভালবাসা শব্দটি শুনলেই তিন্নির শরীরটা গুলাতে থাকে, বমি পায়! কোন কোনদিন তিন্নি বেসিন ভাসিয়ে বমি করে!
ইভানকে ডিভোর্স দিয়ে দীপনকে বিয়ে করে তিন্নি। মেয়েরা তিন্নির সঙ্গেই থাকে। এর কিছুদিন পর তিন্নি জানতে পারে ইভান আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যা করার আগে ইভান কুরিয়ারে তিন্নির কাছে একটা চিঠি পাঠায়-
‘তিন্নি আমি তোমাকে ভালবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না। বাঁচতে চাইও না। তুমি ছাড়া আমার জীবন অর্থহীন তিন্নি!
তিন্নি এখন বুঝতে পারে, সত্যিই ইভান তাকে ভালবাসত। এতদিন ধরে ইভান যা করেছে সেটা ছিল ইভানের আসক্তি। বিড়ি, সিগারেট, মদ, গাঁজা, ভাংয়ের মতো এটাও একটা আসক্তি! যেটা ইভান ছাড়তে পারত না কোনভাবেই! চিঠিটি হাতে নিয়ে তিন্নি হাসে, করুণ সে হাসি!