'জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন' - স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির পুনরুত্থানে রচিত 'আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই, আজো আমি মাটিতে মৃত্যূর নগ্ননৃত্য দেখি, ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে … এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়? বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে, মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।'- কবিতার বহুল উচ্চারিত এই পংক্তির বিক্ষুব্ধ কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহর আজ ৬৬তম জন্মদিন।
১৯৫৬ সালের এই দিনে বরিশালে রেড ক্রস হাসপাতালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাড়ি মোংলার মিঠেখালীতে। মাটি ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ এ কবির শিল্পমগ্ন উচ্চারণ তাকে দিয়েছে সত্তর দশকের অন্যতম কবির স্বীকৃতি। তারুণ্য ও সংগ্রামকে কবিতায় তুলে ধরেছেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। এই কবির স্মরণে বাগেরহাট জেলার মোংলার মিঠেখালিতে গড়ে উঠেছে 'রুদ্র স্মৃতি সংসদ'।
ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি আলাদা একটা টান ছিল কবি রুদ্রর। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় তার বোনের ট্র্যাংক থেকে তিনি ও তার মামাতো ভাইয়েরা মিলে টাকা ধার করেন। কথা ছিল তারা সিনেমা দেখতে যাবেন। কিন্তু সেটি না করে রুদ্র আরেকটি কাজ করলেন। তারা একটি লাইব্রেরি তৈরি করলেন। সেই লাইব্রেরির নাম দেয়া হয়েছিল বনফুল লাইব্রেরি।
যৌবনে রুদ্র ছিলেন প্রাণবন্ত। এবং কিছুটা উচ্ছন্ন। খেয়ালীপনা তার মধ্যে ছিল না। তার চুল ছিল কোঁকরা। তার মুখে ছিল খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। জিন্স পড়তেন প্রায় সময়ই। সবসময় আড্ডা দিতে ভালোবাসতেন। তবে কবিতার ক্ষেত্রে তিনি অনেক মনোযোগী থাকতেন। তার এই অস্থির ভাব নিয়ে কবি শামসুল হক বলেছিলেন, 'তার মধ্যে যে বাউন্ডুলেপনা ছিল তা তাকে সুস্থির হতে দেয়নি'।
ঢাকা ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুল থেকে ১৯৭৪ সালে এসএসসি করেন। ছাত্র হিসেবে তিনি মেধাবী ছিলেন। চার বিষয়ে লেটার মার্ক্স পেয়েছিলেন। এবং প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৭৬ সালে এইচএসসি পাস করেন। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৮০ সালে সম্মানসহ বিএ এবং ১৯৮৩ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ।
তিনি ছিলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা এবং জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক। ১৯৭৫ সালের পরের সবকটি সরকারবিরোধী ও স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। প্রতিবাদী কবি হিসেবে খ্যাত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, দেশাত্মবোধ, গণআন্দোলন, ধর্মনিরপেক্ষতা, ও অসাম্প্রদায়িকতা তার কবিতায় বলিষ্ঠভাবে উপস্থিত। এছাড়া স্বৈরতন্ত্র ও ধর্মের ধ্বজাধারীদের বিরুদ্ধে তার কণ্ঠ ছিল উচ্চকিত। কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠে যে কজন কবি কবিতাকে শ্রোতৃপ্রিয় করে তোলেন, তিনি তাদের অন্যতম। তারুণ্য ও সংগ্রামের দীপ্ত প্রতীক কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ৩৪ বছরের স্বল্পায়ু জীবনে সাতটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও গল্প, কাব্যনাট্য এবং 'ভালো আছি ভালো থেকো'সহ অর্ধশতাধিক গান রচনা ও সুরারোপ করেছেন।
তসলিমা নাসরিনের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের পর রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ আরো মুক্ত জীবন যাপন করতে শুরু করেন। তিনি খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম করতেন। ঠিক ঠাক সময়ে খেতেন না। এবং নিজের শরীরের যত্ন নিতেন না। ফলে তার পাকস্থলিতে ক্ষত তৈরি হয়েছিল। ১৯৯১ সালের ২১ জুন নিজ বাড়িতে তিনি মারা যান।