'স্বাধীনতা তুমি, রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান। স্বাধীনতা তুমি, কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো, মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-' কিংবা 'তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা, সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো, সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর। তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা, শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো, দানবের মত চিৎকার করতে করতে ...।' অথবা 'গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের, জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট' উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।'
তার কবিতা প্রেরণা দিয়েছে এ দেশের মানুষকে। তার কিছু কবিতা মানুষের মুখে মুখে, শিক্ষার্থীদের আবৃত্তির প্রথম সারিতে অবস্থান নেয়। আজ সেই উত্তর আধুনিক বাংলা কবিতার পুরোধা পুরুষ কবি শামসুর রাহমানের ৯৩তম জন্মদিন। ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর ঢাকার মাহুতটুলিতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
পরাধীন বাংলায় জন্মগ্রহণ করার জন্য তাঁর কবিতায় বারবার উঠে এসেছে সেই সময়ের চিত্র। গদ্য কবিতায় তিনি এক জোয়ার এনেছিলেন। অসাধারণ দক্ষতায় তিনি লিখে যেতেন নাগরিক জীবনের কথা। অসাম্প্রদায়িক ও মুক্ত মনের মানুষ ছিলেন তিনি। বহুবার মৌলবাদীরা তাঁকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। কিন্তু তিনি আমৃত্যু অবিচল ছিলেন তাঁর লেখনীর মতোই।
১৯৪৫ সালে পুরনো ঢাকার পোগোজ স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন শামসুর রাহমান। ১৯৪৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে ভর্তি হন এবং তিন বছর নিয়মিত ক্লাসও করেছিলেন সেখানে। শেষ পর্যন্ত আর চূড়ান্ত পরীক্ষা দেননি। পাস কোর্সে বিএ পাস করে তিনি ইংরেজিসাহিত্যে এমএ (প্রিলিমিনারি) পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করলেও শেষ পর্বের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পর তিনি পাঠকমহলে আলোচিত হন। তার লেখা ‘আসাদের শার্ট’ কবিতায় ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান যেন সচিত্র রূপ পায়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে শামসুর রাহমান সপরিবারে তাদের পৈতৃক বাড়ি নরসিংদীর পাড়াতলী গ্রামে চলে যান। এপ্রিলের প্রথম দিকে তিনি লেখেন ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা’সহ বেশ কিছু কবিতা। শামসুর রাহমানের ষাটের বেশি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়ও শিশুতোষ, অনুবাদ, ছোটগল্প, উপন্যাস, আত্মস্মৃতি, প্রবন্ধ-নিবন্ধের গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
সাংবাদিক হিসেবে কবি শামসুর রাহমান ১৯৫৭ সালে কর্মজীবন শুরু করেন দৈনিক মর্নিং নিউজ-এ। ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি দৈনিক বাংলা ও সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৮৭ সালে সামরিক সরকারের শাসনামলে তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এরপর তিনি অধুনা নামের একটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
লেখালেখির জন্য পেয়েছেন একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক, জীবনানন্দ পুরস্কার, আবুল মনসুর আহমেদ স্মৃতি পুরস্কার, মিতসুবিসি পুরস্কার (সাংবাদিতার জন্য), ও আনন্দ পুরস্কার। ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে।
২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা বেজে ৩৫ মিনিটে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার ইচ্ছানুযায়ী ঢাকার বনানী কবরস্থানে, মায়ের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়।