মহান ব্যক্তিত্বের কালজয়ী জীবন ও কর্ম কালান্তরে প্রবহমান। বছর, দশক, শতক পরিয়েও তারা জনজীবনের মানসপটে দেদীপ্যমান। তাঁদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কালপঞ্জি ঘিরে সে কারণেই বহুমাত্রিক সমীক্ষা ও নিরীক্ষামূলক চর্চা আবর্তিত হয়।
এখন যেমন চলছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। চলছে ফরাসি প্রতিভা শার্ল বোদল্যারের দ্বিশত জন্মবর্ষ। সদ্যই অতিক্রান্ত হয়েছে অনন্যতায় উজ্জ্বল বাঙালি প্রতিভা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী।
বঙ্গবন্ধু ও বোদল্যারকে নিবিড় সমীক্ষার মাধ্যমে কবি, কথাশিল্পী, চিন্তক মহীবুল আজিজ রচনা করেছেন 'বঙ্গবন্ধু, বোদল্যার ও অন্যান্য' শিরোনামে চিন্তাউদ্দীপক গ্রন্থ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানবিক অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মহীবুল আজিজ বিভিন্ন সেমিনার ও ভাষণে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যেসব পবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন, গ্রন্থে সেগুলোই স্থান পেয়েছে। বার্তা২৪.কম'কে তিনি বলেন, 'গ্রন্থের মূল ফোকাস বঙ্গবন্ধু। তবে বোদল্যার ও অন্যান্য কিছু বিষয়ের প্রবন্ধও এতে সন্নিবেশিত হয়েছে।'
প্রফেসর ড. মহীবুল আজিজ বলেন, 'বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে 'মুজিব বর্ষ' উপলক্ষ্যে নানা মাত্রার আয়োজন হয়েছে। উৎসবমুখরতার মধ্যে নিবিষ্ট গবেষণার বিষয়টি যাতে চাপা না পড়ে, আমার মূল বিবেচনা সেটাই। কারণ রাজনীতির পরিসরের মহীরুহ-সম বঙ্গবন্ধু ব্যাপকার্থে বাঙালি মনন চিন্তা এবং সৃজন ধারার অবিচ্ছেদ অংশ।'
'বৃহত্তর বাঙালি সংস্কৃতির মূলস্রোতের কথা বঙ্গবন্ধু ছাড়া কল্পনা করা যায় না। একই সঙ্গে তিনি আন্তর্জাতিক মনীষার অঙ্গনেও আলোকিত ব্যক্তিত্ব স্বরূপ', বলেন তিনি। তাঁর মতে, 'বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অধ্যয়ন ও চর্চায় বহুমাত্রিকতার উন্মেষ যেমন ঘটাতে, তেমনিভাবে তাঁর বৈশ্বিক প্রাসঙ্গিকতার বিষয়গুলোকেও আমাদের শনাক্ত করতে হবে গভীর গবেষণার মাধ্যমে।'
বাঙালি জাতীয়তাবাদ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শিক রাজনীতির অন্যতম নেতা হিসেবে কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবী প্রফেসর ড. মহীবুল আজিজ চট্রগ্রাম শিক্ষক সমিতিসহ বিভিন্ন ফোরামে সামনের কাতারে রয়েছেন। একজন বরিষ্ঠ শিক্ষাবিদ রূপে তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চেতনা বিকাশে পথে নিষ্ঠাবান কাণ্ডারি। মুক্তিযুদ্ধের মতাদর্শিক লড়াই-সংগ্রামের শৈল্পিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক রূপান্তরে তিনি সর্বজনমান্য ভ্যানগার্ড।
ছাত্র জীবনের প্রখর মেধাবী প্রফেসর ড. মহীবুল আজিজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃতিত্বপূর্ণ পেশাজীবনের জন্য স্বীকৃতি একজন ব্যক্তিত্ব। তাঁর সৃজন জগৎ বহুমাত্রিক ও বর্ণময়। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, গবেষণায় ভরপুর তাঁর রচনাসম্ভার। বার্তা২৪কম'কে তিনি বলেন, 'প্রতিটি মুহূর্ত সৃষ্টিশীল থেকে জীবনকে উপভোগ করতে চাই। প্রতিক্ষণ আমি তাই ভাবনা ও লেখার মধ্যে থাকি।'
মহীবুল আজিজ বাংলা ও ইংরেজির পাশাপাশি চমৎকার ফারসি জানেন। শিক্ষক লাউঞ্জের আড্ডায় সহজে বুঝিয়ে দিলেন ফারসি শব্দ ও বাক্য গঠন কৌশল। বললেন, 'আমার বাবা ফারসি বিশেষজ্ঞ ছিলেন। পারিবারিকভাবেই ভাষাটি আমার আয়ত্তাধীন। বাংলায় যে হাজার হাজার ফারসি শব্দ আছে, সে ভাষাটি জানা জরুরি।'
মহীবুল আজিজ জানান, 'বাংলা শব্দভাণ্ডারে সবচেয়ে বেশি শব্দ গৃহীত হয়েছে ফরাসি ভাষা থেকে। ধর্ম পালন, কোর্ট-কাচারি ও দৈনন্দিন জীবনের সর্বক্ষেত্রে আমরা ফারসি শব্দ ব্যবহার করছি।'
ফারসি ছাড়াও ইংরেজিতে মহীবুল আজিজের দখল রয়েছে। বাংলা ভাষার বিদগ্ধ শিক্ষক হয়েও ইংরেজিতে তিনি পারঙ্গম। যে কারণে অনুবাদে তিনি সিদ্ধহস্ত।
দূরপ্রান্তের চট্টগ্রামে অবস্থানকারী মেধাবী-লেখক মহীবুল আজিজ বিশ্ববরেণ্য ইতালো ক্যালভিনোর অসাধারণ গল্পগুলোর অনবদ্য অনুবাদ করেছেন। ইতালো ক্যালভিনো হলেন সেই লেখক, যাকে চিহ্ণিত করা হয়, ‘লেখালেখির কাঠবেড়ালি’ নামে। কারণ, গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও মননশীলতাকে অকাতরে ঢেলে দিয়ে অকল্পনীয় সৃজনী ক্ষমতা দেখাতে ক্যালভিনোর মতো খুব কম লেখকই পেরেছেন। তিনি মানব অনুভূতির অতলে ডুব দিয়ে তুলে এনেছেন অদেখা মানবিক বোধ ও অনুভবের জগৎ। সমাজ ও মানুষের এমন কিছু প্রপঞ্চ ক্যালভিনো এঁকেছেন, যা তিনি ছাড়া অন্য কারো পক্ষে প্রায়-অসম্ভব। সেই মণিকাঞ্চন বাংলা ভাষার পাঠকদের সামনে উপস্থাপনের কৃতিত্ব মহীবুল আজিজের।
মহীবুল আজিজ জানান, কিউবার সান্তিয়াগো শহরের দ্য লাসভেগাসে ইতালো ক্যালভিনোর জন্ম ১৯২৩ সালের ১৫ অক্টোবর। আর মৃত্যু ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৮৫ সালে। কৃষিবিদ পিতার সঙ্গে তিনি নিজের দেশ ছাড়াও তাবৎ দক্ষিণ আমেরিকা চষে বেড়িয়েছেন। উদ্ভিদ বিজ্ঞানি মায়ের কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন প্রাণবৈচিত্র্যের নিখুঁত পরিচয়। দুজনের প্রভাব তাঁর গল্পে স্পষ্ট। তিনি কৃষি ও বনানীময় মানুষের কথাগুলোকেই বলেছেন চরম অভিনব চমকের মাধ্যমে। গল্পের বুনন ও আঙিকের দিক থেকে তিনি তাঁর অসাধারণ পটুত্ব দিয়ে এখনো মাতিয়ে রেখেছেন বিশ্ব কথাসাহিত্যের পুরো দুনিয়াটিকেই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ক্যালভিনো ছিলেন ইতালির তুরিনে। ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের বিরোধিতায় তথন তিনি সমাজতন্ত্রের দিকে মনোদার্শনিকভাবে ঝুঁকে পড়েন। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের দশ বছরের মাথায়, ১৯৫৭ সালে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক হাঙ্গেরিতে আগ্রাসনের প্রতিবাদে তিনি দল ছেড়ে দেন এবং নিজের লেখালেখির অঙ্গনেই স্থিত হন।
পূর্ণকালীন লেখক জীবনে ক্যালভিনো তিনটি উপন্যাস ও অসংখ্য ছোট গল্প রচনা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যে দ্য ক্রো কামস লাস্ট, দ্য ব্যরন ইন দ্য ট্রিজ, কসমিকোমিকস, দ্য হোয়াইট সুনার, দ্য ইয়ুথ ইন তারিন অন্যতম। জীবন পরিচালনার জন্য মাঝে মাঝে সাংবাদিকতার পেশা গ্রহণকারী ক্যালভিনোর অভিনবত্ব দেখানোর জন্য একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। একটি গল্প তিনি শুরু করেছেন এভাবে: ‘একটি শহর ছিল, যেখানে সবাই নিষিদ্ধ। শুধু একটি বিষয় নিষিদ্ধ ছিল না, আর তা হলো ডাঙ্গুলি। ফলে সবাই শহরের পেছনের বড় মাঠে জড়ো হতো। আর দিন পার করে দিত ডাঙ্গুলি খেলেই।’
চমৎকার রূপক আর চিত্রকল্প দিয়ে ক্যালভিনো একটি অবরুদ্ধ জনপদকে কয়েক লাইনেই বুঝিয়ে দিতেন। এমন উদাহরণ একটি নয়, অসংখ্য রয়েছে তাঁর আখ্যানের ভাঁজে ভাঁজে। বাংলা ভাষার পাঠক তাঁর গল্পের হাত ধরে শিহরণ জাগানো জগতের সন্ধানে ছুটে যাবেন। অনাস্বাদিত বিষয়ের আনন্দ পাবেন।
মহীবুল আজিজ ঝরঝরে ভাষায়, গভীর তথ্য বিন্যাসে অনুবাদের সঙ্গে ক্যালভিনোর যে জীবনালেখ্য দিয়েছেন, সেটি নিঃসন্দেহে একটি মূল্যবান পাওনা। ক্যালভিনোর এমন গল্পগুলোকেই তিনি অনুবাদের জন্য বেছে নিয়েছেন, যা সমাজের অনেক লুকনো ক্ষতকে উন্মোচিত করে এবং ঘুঁনে ধরা সমাজের পাটাতন ধরে তীব্র নাড়া দেয়। ‘গ্রন্থাকারে এক জেনারেল’, ‘একটা কিছু কর’, ‘বিড়াল এবং পুলিশ’, ‘বিবেক’, ‘শত্রুর চোখ’, ‘আকাশমুখো নৃগোষ্ঠি’ ইত্যাদি গল্পে স্বাধীনতা, মানবিকতা, নৈতিক স্বাতন্ত্রিকতার অমল মাত্রায় ক্যালভিনো ব্যক্তিসত্তার অচলায়তন ভেঙে মুক্তির দরোজায় কড়া নাড়িয়েছেন।
মহীবুল আজিজের মতে, উত্তরাধুনিক বা বিশ্বায়নের মানুষের একক ও সার্বভৌম জাগৃতির গান ক্যালভিনোর গল্পের অন্তর্গত মূলস্রোত। প্রথা, প্রতিষ্ঠা, দর্শনের নামে মানবসত্তার বন্দিত্বকে অস্বীকার করে মানবমুক্তির অলংকারে পরিণত করার কৃতিত্বের জন্যে ক্যালভিনোর গল্পগুলো পাঠকের মনের গভীরে অমোচনীয় দাগ রেখে যায়।
মহীবুল আজিজ বলেন, শুধু নিজের জন্মদিনেই নয়, প্রতিটি দিনই আমি নিজস্ব লেখার নিভৃতিতে কাটাই, যেখানে বঙ্গবন্ধু, বোদল্যার, ক্যালভিনো, চিনুয়া আবেচে, আর. কে. নারায়ণ থাকেন সরব উপস্থিতিতে, যাদের কাউকে কাউকে আমি পেয়েছিলাম ক্যামব্রিজে অবস্থানকালীন দিনগুলোতে। 'বর্ণ সন্তান' উপন্যাসে আমি বিলাতে দেখা সুপ্ত রেসিজম আর বাঙালি ডায়াসপোরাকে তুলে এনেছি। আমাদের এক্সোডাসে আখ্যান বিশ্বায়নের এ যুগেও আমরা ছেঁকে বের করতে পারনি, অথচ স্থানীয় সমাজের মতোই বৈশ্বিক বাঙালি সমাজ আমাদের নিরীক্ষা ও মনোযোগ দাবি করে।
মহীবুল আজিজ বিশ্বাস করেন, এক জীবনের মহার্ঘ আয়োজনে একজন মানুষের জন্য কণা পরিমাণ সময়ও অলসতা বা হতাশায় অপচয় করা শুধু ভয়ঙ্কর অপরাধই নয়, মারাত্মক পাপ। আমাদেরকে আমাদের কাজের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেই জীবন কাটাতে হবে। একমাত্র কাজের তুল্যমূল্যের নিরিখেই প্রতিপন্ন হবে একজন মানুষের প্রকৃত সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা।
সর্বসাম্প্রতিক সময়ে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য-সম্ভার বীক্ষণে ব্যস্ত। বঙ্গবন্ধুর মহাজীবনের নানা দিক এবং এর সমকালীন প্রাসঙ্গিকতার বিষয়েও অনুসন্ধান করছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কৃতিত্বের সমান্তরালে তাঁর দার্শনিকতার হিরন্ময় পরিসরকে বৈশ্বিক বৌদ্ধিক পরিমণ্ডলে তুলনামূলক সমীক্ষায় পর্যালোচনা করতে তিনি এখন গবেষণায় মগ্ন।