মানুষ যে কাজ দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করে তাই পেশা বা বৃত্তি। আর্থ-সামাজিক কাঠামোর উপর নির্ভর করে পেশার উদ্ভব ও বিকাশ, যা চলমান উত্তরণের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে পৃথিবীর সব দেশের মানুষের সমাজে পরিবর্তনের এই ধারা একরূপ নয়, বাংলাদেশের অনেক পেশা দীর্ঘদিনের লালিত। সমাজ পরিবর্তন বা আধুনিকতার ছোঁয়ায় কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি বংশ পরম্পরায়। একইভাবে নির্দিষ্ট পেশাকে অবলম্বন করে তাদের দিন চলে যাচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মেথর, ঝাড়–দার, ডোম, মুচি, নাপিত প্রভৃতি পেশাজীবী। বাংলাদেশের সমাজ-জীবনের পেশাগত পদবি এবং বর্ণ বিভাজন ও বৃত্তিগত শ্রেণিভেদ আমরা প্রাচীনকাল থেকে লক্ষ করি। বাংলায় ডোমদের অস্তিত্বও প্রাচীনকাল থেকেই লক্ষ্য করা যায়। নৃতত্ত্ববিদগণ বাঙালির দৈহিক গঠন পরীক্ষা করে অভিমত পোষণ করেন যে, বাংলার আদিম অধিবাসীগণের বংশধর কোল, শবর, পুলিন্দ, হাড়ি, ডোম, চ-াল প্রভৃতি জাতি। এরা নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায় এবং অন্ত্যজ অস্পৃশ্য পর্যায়ভুক্ত।
৬৫০ থেকে ১২০০ শতকের মধ্যে রচিত প্রাচীন সাহিত্য চর্যাপদের প্রতিফলিত বাংলার জীবন ও সমাজচিত্রে বিভিন্ন পেশাজীবীর পরিচয় বিধৃত। চর্যাকার কাহ্নপা বলেন-
‘নগর বাহিরি রে ডোম্বি তাহরী কুড়িয়া,
ছোই ছোই জাসি বামহণ নাড়িয়া।’
একইভাবে ভুসুকু বলেন-
‘আজি ভুসুকু বাঙ্গালী ভইলী
নিঅ ঘরিণী চ-ালে লেলী।’
ডোম সম্প্রদায়ের বা ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে এবং তাদের পরিবেশ দেখে এমন মনে হয়েছে যে ডোমরা ঝাড়– দেয়, পয়ঃপরিষ্কার, শবদেহ উত্তোলন, লাশ কাটা, লাশ সেলাই, মৃত পশু সরানো, পঁচালাশ তোলা, পুনরায় কবর দেয়া, শশ্মানে মৃত দেহ পোড়ানের মত কাজসহ শুকর পালন, বাঁশের কুলা, ডালা, চাটাই, চালনা, ঢোল ইত্যাদি তৈরি করে থাকে। যারা এধরনের পেশায় নিয়োজিত থেকে আমাদের ঝকঝকে, সুন্দর ভাল থাকতে সাহায্য করছে তারা প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান আধুনিক সমাজেও অপরিহার্য। তবু আমাদের ভদ্র সমাজে এখনো তারা অস্পৃশ্য, ঘৃণিত। এরাই সমাজ সভ্যতার বাইরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ বা এশিয়া উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে। বলতে হয় ডোমরা শুধু এ সমস্ত কাজই করতো না, প্রাচীন বাংলার প্রধানত বাহন নৌকা খেয়া পারাপারের কাজও তারা করতো।
সাভার ঐতিহ্যপূর্ণ প্রাচীন জনপদ। নৃতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদদের মতে প্রাচীনকাল থেকেই বহু জাতির সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে বাঙালি জাতি। জাতিতাত্ত্বিক বিচারে বাঙালির রক্ত তাই একক কোন জাতি বা গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যকে বহন করে না।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মত বংশপরম্পরায় লালিত পেশাকে ধারণ করে দীর্ঘদিন থেকে ডোম সম্প্রদায় সাভার অঞ্চলে বাস করছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের অতি আধুনিককালে এদের দিনকাল কেমন যাচ্ছে জানতে, সম্প্রতি কথা হয়েছে সুজন, লক্ষ্মী রাণী হেলানী, চন্দনা, দুলাল, ভিকু প্রমুখের সাথে। হরিজন হিসেবে পৌরসভা কর্তৃক বরাদ্দ সাভার অঞ্চলে বিভিন্ন সুইপার পল্লীতে তারা বসবাস করছে। আমাকে দেখে অনেকে অতি-উৎসাহে প্রশ্ন করে, “আপনি কোন এনজিও থেকে এসেছেন?” বললাম কোন এনজিও থেকে আসিনি। আপনাদের সাথে কথা বলবো। অনেকে বলে উঠে তারপর কী পত্রিকায় লিখবেন? বললাম লিখব। অনেকে তাৎক্ষণিক আবদার করে বসে, আমাদের কিন্তু পত্রিকা দিবেন। কেউ আবার প্রশ্ন করে, “আমাদের কথা পত্রিকায় লিখে কি হবে? আমাদের অবস্থার উন্নতি হবে?” উত্তর দিতে পারিনি। একটুখানি চুপ থেকে বললাম ‘জানি না। অন্য একজন মুখ বাঁকা করে বলল, “তাহলে লিখে কী হবে?” কথা শুনে খারাপ লাগলো সত্যিই তো কি হবে? তবু কথা বললাম। বোঝানোর চেষ্টা করলাম, বললাম আপনাদের সম্পর্কে আমরা জানতে চাই। আপনারা সমাজের অপরিহার্য অংশ। আপনারা ময়লা কেটে পরিষ্কার করেন বলেই তো আমরা এত সুন্দর চলতে পারছি। নাপিত মানুষকে সুন্দর করে, সে নরসুন্দর। কেউ পরে তেমন কোন প্রশ্ন করে না তবে বুঝতে পারি, একটা ক্ষোভ ওদের মনে। ওদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম ডোম সম্প্রদায়ের মধ্যেও প্রকারভেদ রয়েছে- ক. ভুঁইমালী, খ. হেলানি জাতি, গ. বাঙালি হাড়ি জাতি, ঘ. টম বাঁশফোড় (বাজফল) ও ঙ. পাটনী ইত্যাদি।
ডোমদের পূর্বের জীবনযাপনের সঙ্গে বর্তমান জীবনযাপনের কতটুকু উন্নতি বা উত্তরণ হয়েছে জানতে চাইলে তেমন কোন উন্নয়ন হয়নি বলে জানান। আমি বলি, কেন পৌরসভা থেকে থাকার ব্যবস্থা, ছেলে-মেয়েদের আলাদা প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা এগুলো সুবিধা দেয়া তো হয়েছে। তাই না? হ্যাঁ, সমস্বরে সবাই বলল। এও জানালো পৌরসভা থেকে একটি করে ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যে ঘরে ছেলে-মেয়ে নিয়ে থাকা অত্যন্ত কষ্টকর। উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থাও দাবি করে। অনেক অভিযোগের মধ্যে একটি অভিযোগ, হাসপাতালে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে বড় বড় বাবুরা টাকা নিয়ে মুসলমানদের চাকরি দিচ্ছে। ফলে বেকারদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। অনেকে এটাও বললেন, নিচু জাত বলে আমাদের মানুষ ঘেন্না করে। আমরা সব জায়গায় যেতে পারি না। সবার সঙ্গে মিশতে পারি না। অন্য সব কাজ আমাদের দেয়া হয় না। আমাদের ঘরে কেউ খেতে চায় না। আমাদের চাকরি যদি অন্যরা নিয়ে নেয় তাহলে আমরা কী করবো। ভারতচন্দ্র অন্নদামঙ্গলকাব্যে ‘ঈশ্বরী পাটনীর’ কথা উল্লেখ করেছিলেন। খেয়া পারাপারকারী এই মাঝি পাটনীদের এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, যান্ত্রিকতার ফরে, মাটি ভরাট করে নদীমাতৃক বাংলাদেশের রূপ যেমন পরিবর্তিত হয়েছে, তেমনি ইংরেজ শাসনের বদৌলতে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মুৎসুদ্দি তথা দালালি অর্থনীতি। তাই এদের নিশ্চিহ্ন করে ঘাটের মালিক বা জলের মহাজন, যারা খাজনা আদায়ের ইজারাদার হয়ে বসেছে। অধিকাংশ মুসলমান ইজারাদার মুসলমান মাঝিদের দাপটে খেয়া ঘাটে পাটনীদের আর দেখা যায় না। প্রচণ্ড ঝড়ে এরা শক্ত হাতে বৈঠা ধরতে পারলেও স্তরবিশিষ্ট দুঃসহ সমাজ ব্যবস্থাকে ভাঙতে পারে না। আর পারে না বলেই নিজেদের সামাজিক সমতায়, মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় এরা অক্ষম। সাভার শহরের বিভিন্ন এলাকার সুইপারপল্লীতে প্রায় আড়াইশত পরিবার বাস করছে এবং এর বাইরেও রয়েছে অনেকে। দু’একটি পরিবার ছাড়া অধিকাংশ পরিবারের অবস্থা খুব একটা ভাল না। অনেকেই কাজ পায় না।
এরা খুব কষ্ট সহ্য করতে পারে এবং অল্পেই সন্তুষ্ট থাকে। এজন্য এদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা কম। ডোমরা অল্প শিক্ষিত বা অক্ষর জ্ঞানহীন হলেও সময়, সমাজ, রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্কে মোটেই অসচেতন নয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে ওরা খুবই শঙ্কিত। ফেরার সময় অনেকে আবেদন জানালো ‘ভাই আমাদের কথা সরকারকে জানাবেন।’ বিদেশের মেথর, ঝাড়–দাররা তো আমাদের মত কষ্ট করে না। ওদের নাকি অনেক বেতন? মেশিন দিয়ে কাজ করে। কেউ ওদের ঘৃণার চোখে দেখে না।’ আশ্বাস দিতে পারলাম না ডিজিটাল বাংলাদেশের এই সময়েও।
আহসান ইমাম: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।