নিষিদ্ধ এক শব্দ পরকীয়া—হ্যাঁ ঠিক এটাই আমাদের ধারণা ছিল। ছিল বলছি; তাহলে কি সুপ্রিম কোর্টের রায় শোনার পর থেকে আমরা আধুনিক হয়ে গেছি! নিশ্চয় নয় বরং এক বিশ্রী ধারণার প্রচারে ভরে যাচ্ছে চারিদিক। ফেসবুক, ওয়াটসহ্যাপে যেসব চুটকি ঘুরে বেরাচ্ছে তার সারাংশ হলো এই যে “যৌনতা বিষয়টা অবাধ হয়ে গেছে এবং নারী-পুরুষ যে কোনো বিবাহের সম্পর্কে জড়িয়েও অন্য সম্পর্কে লিপ্ত হতে পারে এবং এটা একটা জোরালো স্বেচ্ছাচারের ব্যাপার।” তবে এর থেকে যে ভুল বোঝার এক ভয়ঙ্কর জায়গা তৈরি হচ্ছে সেটা আমরা কেউ বুঝতে পারছি না। ৪৯৭ ধারাটিতে সুপ্রিম কোর্ট কোন সাপেক্ষে কী বলেছে তা-ই জনসাধারণের কাছে স্পষ্ট নয় এবং এই স্পষ্ট না হওয়ার পেছনে আমাদেরই তাৎক্ষণিক হুজুগ দায়ী।
সব আইনের সব দিকই যে মানুষের কাছে স্পষ্ট তা একেবারেই নয়, কিন্তু এক্ষেত্রে মুখে মুখে যা প্রচারিত হচ্ছে তাও অতিমাত্রায় ভুলে ভরা। কেউ বলছে ছেলেদের জন্য দারুণ ব্যবস্থা হলো, কেউ বলছে মেয়েরা এবার খুব ফষ্টিনষ্টি করে বেরাবে, সন্তান সত্যিকারের মানুষ হবে না—এইসকল চিন্তার ভিত্তি কেবল একটাই বাক্য—“পরকীয়া বৈধ হয়েছে।” লোকের বাড়িতে বাসন মাজতে আসা মেয়ে, কারখানায় কাজ করা শ্রমিক এবং বিশেষত যারা খাদ্যচিন্তায় ব্যস্ত তারা সত্যি সময় করে ভাবনাকে কাউন্টার করে প্রশ্নে রেখে এগোনোর কথা ভাববে না। ফলে মুখে মুখে কথা শুনে বিশ্বাস করে নেবে যে “বিবাহ হলেও বহুসম্পর্ক করা স্বাভাবিক তাতে কোনো শাস্তি নেই, অন্যায় নেই।” পরকীয়া ও ব্যভিচারের মধ্যে যে এক বড় রকমের পার্থক্য আছে তা তারা বুঝবে না কারণ তারা স্মার্টফোন ব্যবহার করলেও ইন্টারনেট ঘেঁটে আসল মানে বুঝতে পারবে না; কারণ চায়ের ঠেকে, বাসের আড্ডায় একটাই ছোট্ট বাক্য উড়ে বেরাচ্ছে—“পরকীয়া বৈধ হয়ে গেছে।”
এইসমস্ত মানুষ যারা হয়তো আক্ষরিক অর্থে শিক্ষিত হয়নি যাদের কেবল শোনা কথাটা অনেক কিছু তারা এক ভ্রমের জোয়ারে ভেসে যাবে। এমনিও বহুঅন্যায় সহ্য করে থেকেও ছেলেমেয়েরা নিজেদের নাগরিক অধিকারে থানায় গিয়ে অভিযোগ জানাতে ভয় পায়। ফলে , এখন যে ভুল প্রচারে চারিদিক জর্জরিত হলো তার পরিণাম খুব মধুর নয়। পূর্বের এই আইনে বিবাহিত একটি মেয়ের পরকীয়া সম্পর্কে যুক্ত প্রেমিকটি শাস্তি পেত তার স্বামীর অভিযোগে। প্রথমত এটি ছিল অসমান বিচার, দ্বিতীয়ত—স্বামী প্রেমিকটির বিরুদ্ধে অভিযোগ করার অর্থ যেন তার একটি জিনিসের হস্তান্তরের ব্যাপার তিনি চুরির অভিযোগ করছেন অর্থাৎ মেয়েটির কোথাও কোনো সম্মানজনক ভূমিকা নেই। এইখান থেকে মূলত বর্তমানে আইন এই পর্যায়ে এলো যে—“পরকীয়া নিয়ে পূর্বোক্ত আইন আর কার্যকরী নয় কারণ এটি অসমান প্রক্রিয়া।” আইন যে কতটা উন্নত হলো সেইটা সকলে ভুলে গেল! রটনায় কেবল উঠে এলো—“পরকীয়া বৈধ।”
এরপরের বিষয়টি আরো মারাত্মক হয়ে মানুষের মুখে মুখে ক্রমে প্রচারিত হচ্ছে—“পরকীয়া বৈধই যদি মূল কথা হয় তবে যে যার সঙ্গে ইচ্ছে সম্পর্কের যথেচ্ছাচার করতে পারবে।” মানে দাঁড়াল একটি ত্রুটিযুক্ত তথ্যের বহুল প্রচার হওয়ায় বাকি তথ্যরাও ত্রুটিমুক্ত হতে পারল না। আসলে অন্যায় অন্যায় হিসেবেই আইনে গৃহীত আছে তাই সেখানে পরকীয়ার সঙ্গে সম্পর্কের ব্যভিচারকে এক করে আইনের ভুল বার্তা চারিদিকে যেভাবে প্রচারিত হচ্ছে সেটা খুব দুঃখজনক। যদি আমরা শুধু খবরের হেডলাইন না পড়ে আরো ভেতরে যেতে আরেকটু চেষ্টা করতাম তাহলে বুঝতাম কত ভুল অসন্তোষে আমরা নিজেদের ক্রমাগত জড়িয়ে রাখি। সর্বোপরি যেকোনো নিষিদ্ধ কাজের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেশি—যদি এই কথাকে অস্বীকারও করি, এটা মানতেই হবে ব্যক্তিচরিত্র এই আইনের ফলে স্পষ্ট হবে। ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনেও এটা ব্যক্তির নিজস্ব সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সন্তোষজনক সংস্কার। আমরা যে আইনের দিকে হাজারবার আঙুল তুলি সেই প্রাসঙ্গিকতাতেই, ভালোকে যদি ভালো হিসেবে বুঝতে না পারি তাহলে খারাপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধও কোনোদিন গড়ে উঠবে না। ব্যক্তির স্বকীয় সত্তাই ঠিক করুক সে পরকীয়া করবে কি করবে না, এক্ষেত্রে যে কারো হস্তক্ষেপই ভীষণ নেতিবাচক ব্যাপার! এই বেড়াজাল থেকে সসম্মানে মুক্ত হওয়ার অধিকার আমরা দেরি করে হলেও পেলাম এটাই গর্বের বিষয়।