বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের কাছে ‘আগুনপাখি’ অপরিচিত নয়। এর লেখক হাসান আজিজুল হক, যাকে বলা হয় বাংলা গল্পের রাজপুত্র। এই গল্পকারের প্রথম উপন্যাস ‘আগুনপাখি’। প্রথম বলছি এই জন্য, উপন্যাসটি যখন প্রকাশিত হয় তখনো তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘শামুক’, যেটি তিনি ছাত্রজীবনে লিখেছিলেন, প্রকাশিত হয়নি। আগুনপাখির মধ্য দিয়ে তিনি জানান দিলেন, শুধু গল্পে নয়, উপন্যাসেও তাঁর হাত শক্তিশালী। সমাজ, ইতিহাস, রাজনীতি ও দেশভাগ শৈল্পিক কথন এই উপন্যাস। রাঢ়বঙ্গের এক নারীর জবানিতে লেখক তুলে ধরেছেন সাতচল্লিশ-পূর্ব অখণ্ড ভারতের উত্থান-পতন, রাজনীতি, বিশ্বযুদ্ধের উত্তাপ, দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ, দেশ গঠন ও সামাজিক অবক্ষয়ের কথা।
আগুনপাখির বিষয়টি কোথা থেকে পেলেন হাসান আজিজুল হক, কিভাবে লেখা হলো এই উপন্যাস, কত দিন সময় লেগেছিল লিখতে, এসব জানতে এক দিন ফোন দিই তাঁর নম্বরে। দীর্ঘ আলাপচারিতায় জানা গেল উপন্যাসটি রচনার নেপথ্য কাহিনী। প্রিয় পাঠক, আসুন, জেনে নিই সেই কাহিনী।
আশির দশকের শুরুর কথা। ১৯৮২-৮৩ সাল হবে হয়তো। হাসান আজিজুল হক তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক। অধ্যাপনার পাশাপাশি লেখালেখিতে নিবিষ্ট। লিখছেন জীবনের সেরা গল্পগুলো। সপরিবারে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৬/সি পশ্চিমপাড়া কোয়ার্টারে। তাঁর মা জোহরা খাতুনও তখন তাঁর বাসায়। এর আগে তিনি বড় ছেলের বাসায় ছিলেন। বয়স হয়েছে তাঁর। বয়সজনিত কারণেই মতিভ্রম দেখা দিয়েছে। উল্টাপাল্টা কথা বলেন, লোকজনকে ঠিকমতো চিনতে পারেন না, কখনো কখনো নিজ পুত্রকেও না। রাতের বেলায় কাঁথা-বালিশ-মশারি টেনেটুনে এক করে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকেন। দিনের বেলায় প্রায়ই একা একা বকেন।
এক দিন সন্ধ্যাবেলায় তিনি তাঁর জা অর্থাৎ হাসান আজিজুল হকের চাচিকে উদ্দেশ করে বলছেন, ‘ও ল-বউ, ডাল তো শুকোতে দিলাম, দেখ তো পাখি খেল কি না?’ সবাই তো অবাক! কোথায় ল-বউ? কোথায় ডাল? এসব কী আবোল-তাবোল বকছেন তিনি! আরেক দিন বললেন, ‘দেখ, কারা দাঁড়িয়ে আছে। তারা ঝগড়া করতে এসেছে, বুঝলি?’ কেউ তাঁর কথা ঠিক বুঝতে পারে না। কোথাও তো কেউ নেই, কার কথা বলছেন তিনি! আবার কখনো নির্জন দুপুরে নিজ মনে বলেন, ‘দেখ দেখ, ঘুঘু পাখি ডাকছে কেমন করে!’ মুখে ঘুঘুর ডাক নকল করেন, ‘ঘু...ঘু...ঘু...ঘু।’
এভাবেই নিজ মনে আবোল-তাবোল বকতেন জোহরা খাতুন। এক দিন হাসান আজিজুল হকের মনে হলো—আচ্ছা, মায়ের জীবনস্মৃতি রেকর্ড করে রাখলে কেমন হয়? পরে তো কাজে লাগতেও পারে। একটা রেকর্ডার জোগাড় করে এনে তিনি রেকর্ড শুরু করলেন। রেকর্ডারটি মায়ের মুখের সামনে ধরে জানতে চাইলেন, ‘মা, তোমার ছোটবেলা কেমন ছিল?’ উত্তরে জোহরা খাতুন বললেন, ‘কেমন ছিল আবার? আমার মা তো ছোটবেলায় মরে গেল। একটা ভাই রেখে গেল, তার বয়স মাত্র এক বছর, সে হলো আমার কাঁকালের পুঁটুলি। বাপ আবার আরেকটা বিয়ে করল। তারপর বাপও মরে গেল। আমার একটা নানি ছিল, সেও মরে গেল...।’
মায়ের কথাগুলো শুনে কিছুটা অবাক হলেন হাসান। মা বারবার শুধু মৃত্যুর কথা বলছেন কেন? বলার মতো কথা কি আর নেই? বিষয়টি খুব ভাবাল তাঁকে। পরে বুঝলেন, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতার কারণেই হয়তো তাঁর মায়ের মাথায় গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে। তাই আত্মীয়স্বজনের বিয়োগব্যথাই এখন তাঁর একমাত্র বলবার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জোহরা খাতুন মারা গেলেন ১৯৮৩ সালে। প্রায় কুড়ি বছর কেটে গেল। তাঁর জীবনস্মৃতির সেই রেকর্ডগুলো কোথায় অযত্নে পড়ে আছে খোঁজ নেই। কুড়ি বছর ধরে মায়ের জীবনের সেসব স্মৃতি মাথায় ফেরি করে বেড়ান হাসান আজিজুল হক। মাকে নিয়ে লেখার কথা ভাবেন। লিখবেন-লিখবেন করেও লেখা হয়ে ওঠে না।
২০০৩ সালের কথা। একটি জাতীয় দৈনিক ঈদ সংখ্যায় ছাপানোর জন্য উপন্যাস চাইলেন হাসান আজিজুল হকের কাছে। কিন্তু উপন্যাস তো লেখেন না তিনি। একটা লিখেছেন সেই কবে, এখনো অপ্রকাশিত। উপন্যাস লেখার ঠিক পরিকল্পনাও নেই তাঁর, ছাপতে দেবেন কোথা থেকে? পরক্ষণে ভাবলেন, তাঁর মায়ের জীবনের কথা নিয়ে তো একটা গল্প লেখা যেতে পারে। তিনি বললেন, ‘আচ্ছা, আমি যদি আমার মায়ের জীবনস্মৃতি, পশ্চিমবঙ্গের একজন পর্দানশীন মহিলার জীবন নিয়ে একটা গল্প লিখি, ছাপবে?’ তিনি কি আর আপত্তি করেন! হাসান আজিজুল হক যা লেখেন তা-ই তো ছাপবেন।
মা জোহরা খাতুনের জীবনের প্রথম অধ্যায় নিয়ে ‘একটি নির্জল কথা’ নামে একটা গল্প লিখলেন হাসান আজিজুল হক। খুব বড় নয় গল্পটি। পাঠিয়ে দিলেন। যথারীতি ছাপা হলো ঈদ সংখ্যায়।
পরের বছর একই পত্রিকার ঈদ সংখ্যার জন্য একটি বড় উপন্যাস চাইলেন। হাসান আজিজুল হক রাজি হলেন। হয়তো তিনি মনে মনে একটা উপন্যাস লেখার পরিকল্পনাই করছিলেন তখন। তাঁর মায়ের জীবনস্মৃতিই সেই উপন্যাসের বিষয়। তবু পরামর্শ চাইলেন প্রাবন্ধিক সনত্কুমার সাহার কাছে। উপন্যাসের বিষয় শুনে তিনিও উৎসাহিত করলেন, বিষয় হিসেবে ভালো লেখা যেতেই পারে।
মায়ের জীবনের প্রথম অধ্যায় তো আগেই লিখেছেন, এবার লিখতে শুরু করলেন পরবর্তী অধ্যায়গুলো। ঠিক মায়ের জবানিতেই, বর্ধমানের ভাষায়। জোহরা খাতুনের জীবনকে কেন্দ্র করেই উপন্যাস। তার মানে আবার এই নয় যে উপন্যাসটি হুবহু জোহরা খাতুনের জীবনী। কারো হুবহু জীবনী তো আর উপন্যাস হয় না। লেখক ইচ্ছামতো এই জীবনকে ভাঙচুর করেছেন। এই জীবনের সঙ্গে অন্য আরো অনেক জীবনকে যুক্ত করেছেন। বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনার মিশেল ঘটিয়েছেন। মায়ের জীবনের মধ্যে তিনি গাঁথলেন সাতচল্লিশ-পূর্ব অখণ্ড ভারতের উত্থান-পতন, তত্কালীন রাজনীতি, বিশ্বযুদ্ধের উত্তাপ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ, দেশ গঠন ও সামাজিক অবক্ষয়ের নানা প্রসঙ্গ। আঁকলেন রাঢ়বঙ্গের মুসলিম সমাজের চিত্র, আঁকলেন একটি পরিবারের উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে গোটা সমাজের উত্থান-পতনের চিত্র।
প্রায় ১৫৮ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটি লিখতে সময় লাগল প্রায় দেড় বছর। ছাপা হলো ঈদ সংখ্যায়। পরে আরো কয়েকটি নতুন অধ্যায় সংযোজন করে বই আকারে ছাপতে দিলেন। ২০০৬ সালে ঢাকার সন্ধানী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হলো ‘আগুনপাখি’। পাঠক মহলে ব্যাপক সাড়া পড়ল। ২০০৭ সালে উপন্যাসটির জন্য কলকাতার আনন্দ পুরস্কার লাভ করলেন হাসান আজিজুল হক।
তিনি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। আমি সরাসরি তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্র নই। কিন্তু ছাত্রেরও অধিক। তাঁর কাছ থেকে শিখেছি সাহিত্যের অনেক কিছু। তিনি আমাকে অকুণ্ঠচিত্তে শেখাতেন। তাঁকে আমি বলতাম ‘শিল্পপিতা।’ বলতাম, ‘স্যার, আপনি তো আমার শিল্পপিতা।’ স্যার হেসে বলতেন, কীসব যে বলো! শিল্পপিতা শব্দটি সুন্দর। কিন্তু এই পিতা হওয়ার যোগ্যতা তো আমার নেই গো, স্বকৃত।’ আমি বলতাম, ‘আপনার যোগ্যতা না থাকলে কার আছে, তার নাম বলেন। এখন থেকে তাকে শিল্পপিতা ডাকব।’ স্যার তখন হো হো করে হেসে উঠতেন।
১৫ নভেম্বর আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক। আমার মাঝেমধ্যে মনে হতো হাসান আজিজুল হক কখনোই মরবেন না। আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁকে এমনই দেখে যাব। কেন এমনটা মনে হতো জানি না। হয়ত আমি তাঁকে বেশি শ্রদ্ধা করতাম বলে। হয়ত তাঁকে বেশি ভালোবাসতাম বলে। কিন্তু মৃত্যু তো অমোঘ। সেই অমোঘকে বরণ করে নিলেন হাসান আজিজুল হক। চলে গেলেন আমার শিল্পপিতা। আমি কেমন করে তাঁকে বিদায় জানাই! আমি কেমন করে বলি হাসান স্যার মারা গেছেন! আমি কেমন করে বলি হাসান স্যারকে আর কখনো দেখব না!
না স্যার, আপনাকে বিদায় বলব না। অসম্ভব। আপনি আমার কাছে থাকবেন। আমার হৃদয়ে থাকবেন। আমার স্মৃতিতে থাকবেন। আমি জানি, আপনার একটি হাত চিরকাল আমার মাথার ওপর থাকবে। সেই হাত সরবে সেদিন, যেদিন আপনার মতো আমিও অমোঘ সত্য মৃত্যুর হাত ধরে চলে যাব।
লেখক : কথাসাহিত্যিক
আরও পড়ুন
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক আর নেই
হাসান আজিজুল হকের সাহিত্যকর্ম এই জনপদের দর্পণ: তথ্যমন্ত্রী
হাসান আজিজুল হকের পক্ষে বলায় লেখককে ‘হত্যার হুমকি’
জন্মদিনে ভালোবাসায় সিক্ত হাসান আজিজুল হক