আমার মনে হয় পৃথিবীতে বাঙলাসাহিত্য ও বাঙলাদেশের চাঁদ শুধু কলঙ্কময় নয়, সাড়ে কলঙ্কময়। কেন তা ব্যাখ্যা করছি, দাঁড়ান। আমরা জানি স্বভাবতই চাঁদের কলঙ্ক থাকে। সেই কলঙ্ক কীসের তা লাইকা নামের একটা সোভিয়েত কুকুর চাঁদে গমনের পর আমরা মোটামুটি জেনে যাই। কিন্তু সেই কলঙ্ক ছাপিয়ে ভাবে ও অভাবে বাঙলার চাঁদ কালে কালে হয়ে উঠেছে আরো কলঙ্কময়।
‘আয় আয় চাঁদমামা টিপ দিয়ে যা, চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা...’ এই ছড়া দিয়ে ছোটবেলায় প্রথম চাঁদমামার সঙ্গে পরিচয়। তারপর ইদের চাঁদ দেখতে গিয়ে প্রথম চাঁদকে আবিস্কার করি। তবে সেই চাঁদ কাস্তের মতো।
যখন খুব মধ্যে মধ্যে শখের বশে বা অনিবার্য কারণে নিজেদের জমিতে ধান কাটার মৌসুমে ধান কাটতে যেতাম কাস্তে হাতে তখন সেই চাঁদের কথাই মনে হতো কেন জানি না।
তারপর জানতে পারি চাঁদের মধ্যে একটা বুড়ি আছে, তার কাজ হচ্ছে চিরদিন অকারণেই চরকায় সুতা কাটা। তারপর কাজলা দিদির চাঁদ আমাদের বাঁশবাগানের মাথার উপর উঠলে চোখও ভরে ওঠে জলে।
তারপর এই দেশে মহরমের চাঁদ, পূর্ণিমার চাঁদ, আধাপূর্ণিমার চাঁদ, অমাবস্যার আগের চাঁদ, কালাচাঁদ, পুরাণের চাঁদ, চর্যাপদের চাঁদ, জয়দেবের চাঁদ, চাঁদবেনের চাঁদ, আলাওলের চাঁদ, সগীরের চাঁদ, ফকির লালনের চাঁদ, রবিনাথের চাঁদ, কাজী নজরুলের চাঁদ, সুকান্তের চাঁদ, জীবনদাশের চাঁদ, ওয়ালিউল্লাহর চাঁদ, আল মাহমুদের চাঁদ, শামসুর রাহমানের চাঁদ, হুমায়ুনের আজাদের চাঁদ, শহীদুল জহিরের চাঁদ, হুমায়ুন আহমদের চাঁদ, বাঙলা সিনেমার ছিঁচকে চাঁদ, রসগোল্লার মরণ চাঁদ ইত্যাদি চাঁদ দেখে, পড়ে, খেয়ে ও পরে স্নান করে জন্ম, মৃত্যু, প্রেম, কাম, আর বিবাহ পার করে এখন ক্লান্ত-পরিক্লান্ত হয়ে গেছি। এইসব ক্লান্তির কারণ কিন্তু বিদ্যমান।
প্রথমে বাঙলা সিনেমার একটা চাঁদের কথা বলে নিই। হুমায়ূন আহমেদ তার ‘আগুনের পরশমনি’ সিনেমায় রবিনাথের চাঁদকে ধরেছিলো গামলার জলে। এমন সুন্দর-ব্যতিক্রম আর দেখি কই?
এইবার আসল জায়গায় হাত দিই, বাঙলা সাহিত্যের কথা বলি। বিশেষ করে কাব্যের কথা। ফকির লালনের চাঁদ যেমত ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে...’ এই চাঁদকে বোঝার ক্ষমতাই তেমন কারো রইলো না। ফলত লালনের চাঁদ দেহতত্ত্বের গুপ্তসূত্রেই বন্দী রয়ে গেলো। সুকান্তের চাঁদ যেমত ‘...পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি,’ এহেন চাঁদই আমার মনে হয় এই ভুখানাঙ্গা মানুষের দেশে যথার্থ, কিন্তু এই চাঁদকে বয়ে নিয়ে আসার ক্ষমতা বাঙালি কবিদের ছিলো না। তাই সেই চাঁদ ডুবে গেছে।
তারপর জীবনদাশের চাঁদ যেমত ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে...’ এই চাঁদ ভয়াবহ চাঁদ ভয়ানক অস্তিত্ববাদী চাঁদ। কতিপয় শিক্ষিত কবি এই চাঁদকে ধারণ করতে পেরেছে দুয়েকটা জায়গায় যেমন হুমায়ুন আজাদ বলছেন, ‘আজ থেকে খুব ধীরে পুড়ে যাবে চাঁদ...’ আরো বেশ কিছু উদাহরণ টানা যায়। সেইসব আপনার খুঁজে নিয়েন। তো এই পর্যন্ত চাঁদ ঠিকই আছে। একটা ট্রানজিশন টের পাওয়া যায়।
কিন্তু এর ফাঁকফোকর দিয়ে গত একশো বছরে বাঙলা সাহিত্যে রেকর্ড পরিমাণ কবি-সাহিত্যিকের বাম্পার ফলন হয়েছে, তারা চাঁদকে আবাল ও নাবালের মতো আনাড়ি হাতে ঘষতে ঘষতে এতই তরল করে ফেলেছে যে তাদের ঘর্ষণে ও বমনে, লালা ও শ্লেষ্মায়, থুথু ও বীর্যে চাঁদের গা হয়ে গেছে থকথকে, পঙ্কিল, কদাকার, দুর্গন্ধময় আর আরো আরো কলঙ্কময়। এখন জোছনায় নামলেও মধ্যে মধ্যে গা গুলিয়ে ওঠে।
এইবার আসি বাঙলাদেশের চাঁদের নিচে। এই চাঁদ একবারেই সামাজিক ও ধর্মীয় চাঁদ। সুন্দর ঝুলেছিলো আকাশের গায়ে। চাঁদের বুড়ি চরকা কাটছিলো মনের সুখে। তার খিক খিক, খিক খিক হাসিতে পূর্ণিমা নামছিলো মাসিক।
নিয়মিত ইদ আর মহরমের চাঁদেও কোনো বিকার ছিলো না। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা চিরন্তনরূপে পূর্ণিমার আকাশের দিকে চোখ রেখে চাঁদের পিছে পিছে দৌড়াচ্ছিলো।
কিন্তু একদিন সবকিছু ছাপিয়ে মেশিনম্যান সাইদির মুখ দেখা গেল চাঁদে। এই লোক কেমন করে চাঁদের দখল নিলো কেউ জানতে পারলো না। এই লোক চাঁদের বুড়িকেও ছাড়লো না। চাঁদে লেগে গেলো রক্তের দাগ। এরপর থেকে চাঁদ হয়ে উঠলো আরো কলঙ্কময়।
হায়! দুর্ভাগা একটি জাতি আমরা, এমন ভয়ানক কলঙ্কিত এক চাঁদের তলে আমাদের বসবাস।
লেখক: কবি ও চিত্রশিল্পী