একটা দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী মানে বিরাট ব্যাপার। আর আমরা সেই মাহেন্দ্রক্ষণের স্বাদ পাচ্ছি। স্বাধীন দেশ মানে অন্য অনেক অধিকার অর্জনের সাথে সাথে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও লাভ করা। আর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পেলেই কেবল একটা দেশের শিল্প-সাহিত্য সমৃদ্ধ হতে পারে। যত বেশি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পাওয়া যায় তত বেশি সমৃদ্ধ হয় দেশের সাহিত্য।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের সাহিত্য গত ৫০ বছরে কতটুকু সমৃদ্ধ হয়েছে? এই প্রশ্নের জবাব আসলে এক কথায় দেওয়া সম্ভব নয়। এর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে ইতিহাসের দিকে। কেন বাংলাসাহিত্যের কথা না বলে আমি বাংলাদেশের সাহিত্যের কথা বলছি? প্রথমেই এই বিষয়টা পরিষ্কার করে নিতে চাই। কারণ ঐতিহাসিক দিক থেকে অঞ্চলগতভাবে বাংলাসাহিত্যে একটা স্পষ্ট বিভাজন আছে। ৪৭-এর সেই দেশবিভাগের কূটকৌশলে এই বিভাজন সৃষ্টি হলো।
আর আমরা এক শাসকের থেকে মুক্তি পেয়ে আরেক শাসকের হাতে শৃঙ্খলিত হলাম। তবে আমরাই সেই জাতি যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি। এটা আমাদের অহংকার। আর এই বাংলা ভাষায় কথা বলার স্বাধীনতা চাওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীন একটা ভূখন্ডের স্বপ্ন দেখতে পেরেছিলাম। বঙ্গবন্ধু ছিলেন আমাদের স্বপ্নদ্রষ্টা। এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আমরা পেলাম এই বাংলাদেশ।
এখন আমরা বাংলাদেশের সাহিত্যের দিকে তাকালে এর বিচিত্র সম্ভাবনাকে খুঁজে পাবো। যদিও দশকের চিন্তা থেকে কোনো সাহিত্যকে কিংবা সাহিত্যিককে বিশ্লেষণ করা বিশেষ কার্যকরী বিষয় নয়। তবে আলোচনার সুবিধার্থে আমরা এই দশকের চিন্তা ধরেই এগোবো। এবং সবশেষে আমরা একটা সামগ্রিক চিত্র পাবো।
যেহেতু সত্তরের দশকেই বাংলাদেশের জন্ম তাই তার পরবর্তী দশকগুলোকেই আমাদের বাংলাদেশের সাহিত্য বলা উচিত। কিন্তু এখানেই দশকের হিসাবে গন্ডগোলটা বাঁধে। কেননা সত্তরের দশকে বাংলাদেশের জন্ম হলেও পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের শক্তিমান কবি-সাহিত্যিকদের অমর সৃষ্টিগুলোকে আমরা বাংলাদেশের সাহিত্য থেকে বাদ দিতে পারি না।
তাঁদের সাহিত্যের অন্তর্দৃষ্টিতে সমাজের ঐসময়টাকে আমরা প্রকটভাবে দেখতে পাই। তাঁদের বহুমাত্রিক সাহিত্যপ্রতিভা এই দেশের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
সত্তর, আশি এবং নব্বইয়ের দশকে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল উত্তাল। বারবার ক্ষমতার পটপরিবর্তন, মানুষের স্বপ্নের অতৃপ্তি আর অনাকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক সমীকরণগুলো বাংলাদেশকে সেসময়ে একরকম দুঃস্বপ্নের দেশে পরিণত করেছিল। আর সেই উত্তাল সময়কে আমরা আমাদের বাংলাদেশের সাহিত্যের মাঝেও দেখতে পাই।
একরকম নির্মোহ বয়ানে সেই সময়টা লেখকদের লেখায় চিত্রিত হয়েছিল। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর সত্তরের দশকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-নির্ভর কোনো কাজ তখন প্রকাশিত হয়নি। মানে কোনো সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধার বয়ানে কোনো কথাসাহিত্য সেই দশকে কেন হয়নি তা প্রশ্নবিদ্ধ। পরবর্তী সময়ে যদিও সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশ।
এই সময়কার কবিতায় সবচেয়ে যে বৈশিষ্ট্যটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, তাহলো কবিতার শ্লোগানধর্মীতা। এই সময়ের কবিতাগুলোই একেকটি শ্লোগান হয়ে উঠেছিল। কিংবা বলা যায় শ্লোগানই হয়ে উঠেছিল কবিতা।
তবে ৮০'র দশকে বাংলাদেশের কবিতায় একটা নতুন ভাবনার বিকাশ ঘটে। এই দশক থেকেই লিটল ম্যাগাজিনের উত্থান ঘটে। গাণ্ডিব, অনিন্দ্য, পেঁচা, দামোদর, পূর্ণদৈর্ঘ্য, ফু, প্রসূন এবং আরো অনেক লিটল ম্যাগাজিনের উত্থান ঘটে এই সময়ে। যার ফলে বাংলাদেশের সাহিত্যে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। এসময়ে সাহিত্যে নানানরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়। এছাড়া লিটল ম্যাগাজিনের কল্যাণে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা'র তাত্ত্বিক আবহাওয়া এসময় খুব জনপ্রিয়তা পায়।
যদিও বর্তমানে লিটল ম্যাগাজিনের সেই প্রতাপ এখন ম্লান হয়ে গেছে। তবে এখনও কালি ও কলম, চিরকুট,মেঘফুল, দেশলাই, বিন্দু, ড্যাস এবং আরো অনেক লিটলম্যাগ নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। ৮০'র দশককে লিটল ম্যাগাজিনের দশক বলা হলেও এর প্রকৃত সূত্রপাত হয়েছিল ৬০'র দশকে। সেই সময়কার উল্লেখযোগ্য লিটলম্যাগগুলো হচ্ছে স্যাড জেনারেশন, সপ্তক, স্বাক্ষর, না, বহুবচন প্রভৃতি।
৯০'র দশকে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্যের আরো একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। এবং এই দশকের পরবর্তী সময়ে মানে একবিংশ শতকের শূন্য দশক এবং তারপরের দুই দশকে এদেশের সাহিত্যে নানানরকম সংযোজন শুরু হয়।
শ্লোগানধর্মীতা থেকে কবিতা ধীরে ধীরে উত্তরাধুনিককালে উন্নিত হয়। এবং কবিতার বৈশিষ্ট্য অনেক বেশি বিমানবিকতার দিকে ধাবিত হয়েছে। কবিতার মাঝে গল্পধর্মী পরাবাস্তববাদী এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পাওয়া যায় বর্তমান সময়ে। এছাড়া কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রেও নানানরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলমান আছে। কথাসাহিত্যে সুররিয়ালিটির ব্যবহার দেখা পাওয়া যায় এসময়ে।
এছাড়া ইতিহাস-নির্ভর কথাসাহিত্যও প্রবলভাবে বিকশিত হয়েছে এই সময়ে। ইতিহাস-নির্ভর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই হচ্ছে নিষিদ্ধ লোবান, মা, দেয়াল, রাইফেল রোটি আওরাত, জীবন আমার বোন, হাঙর নদী গ্রেনেড, আমার বন্ধু রাশেদ, জোছনা ও জননীর গল্প, ক্রাচের কর্নেল ইত্যাদি।
গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের সাহিত্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রভাব-বিস্তারকারী কাজ সেই তূলনায় অপ্রতুলই রয়ে গেছে। যে কারণে মৌলবাদীতার নীল দংশন থেকে আমাদের স্বপ্নের দেশ এখন বাস্তবের রূপ দেখতে পায়নি। আমাদের সাংস্কৃতিক উন্নয়ন যতটা হবার কথা ছিল, সেই তুলনায় হয়েছে সামান্যই। সমাজতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক যে সমাজের স্বপ্নের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল, তা রয়ে গেছে অধরাই।
সত্তর, আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকে আমরা প্রকৃত মুক্তমনা সাহিত্যিকদের দেখা পেলেও একবিংশ শতকের শূণ্য, এক এবং দুইয়ের দশকে তেমন সাহিত্যিকদের কাজ পেয়েছি খুব কম। একটা দেশের মননকে সমুন্নত করতে মুক্তমনা সাহিত্যের যে পরিমাণ সহযোগিতা দরকার ছিল, তা আমরা সেই চাহিদা মতো পাইনি। বাংলাদেশের সাহিত্যে মননশীল পাঠক তৈরির জন্য যে অনমনীয় দৃষ্টান্ত থাকা উচিত ছিল, এই সময়ের চাটুকার সাহিত্যের জয়জয়কারে তা বিঘ্নিত হয়েছে।
বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত জনগণ জ্ঞান অর্জন করে মননশীল ও সৎ-মানুষ হবার চেষ্টার দিকে না গিয়ে, একপ্রকার ছা-পোষা কেরানি হবার স্বপ্নের দিকে ধাবিত হয়েছে। এই ব্যর্থতার দায়ভার অবশ্যই বাংলাদেশের সাহিত্যিকগোষ্ঠী এবং সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীকে নিতে হবে। কেননা তাঁরা সেই রকম প্রভাববিস্তারকারী কাজ করতে পারেনি।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আমরা যেসব গুণী কবি-সাহিত্যিকদের বাংলাদেশের সাহিত্যে পেয়েছি তাঁরা হলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আহমদ ছফা, সৈয়দ শামসুল হক, আবুল হাসান, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, হুমায়ুন আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, হেলাল হাফিজ, আবিদ আজাদ, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, হুমায়ুন আহমেদ, শহীদুল জহির, প্রমুখ।
এছাড়া আরো অনেকেই আছেন যাদের নাম নিতে গেলে আসলে নামের তালিকাটা দীর্ঘ থেকে আরো দীঘর্তর হবে। আগেই বলেছিলাম সাহিত্য কিংবা সাহিত্যিক কাউকেই দশকের হিসেবে বিশ্লেষণ করাটা কঠিন এবং কখনো কখনো অচল ব্যবস্থাও বলা যায়।
এখন কথা হচ্ছে আমাদের দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আসলে কতটা কার্যকরী হয়েছে? এই প্রশ্নের জবাবটা সন্ধান করা খুবই জরুরি। কারণ সমৃদ্ধ সাহিত্যের জন্যই এই স্বাধীনতা থাকাটা খুব জরুরি। এবং সাহিত্য যত সমৃদ্ধ হবে তত বেশি মানুষের মাঝে তা প্রভাববিস্তার করবে।
৫২'র ভাষা আন্দোলনে তো আমরা স্বাধীনভাবে নিজের ভাষায় কথা বলতে পারার অধিকারের জন্যই প্রাণ দিয়েছিলাম। এই ইতিহাস যেমন আমাদের জন্য গৌরবের, সেরকমই আমাদের দেশে এই মতপ্রকাশের অধিকার যে এখনও প্রশ্নবিদ্ধ; এই প্রশ্নবিদ্ধতাও আমাদের জন্য পীড়াদায়ক।
এই বিশ্লেষণ থেকেই কি আমরা বলতে পারবো বাংলাদেশের সাহিত্য গত পঞ্চাশ বছরে সমৃদ্ধি'র চরম শিখরে পৌঁছে গেছে? না, একেবারে এত মোটা দাগে বলা মুশকিল। যেহেতু এখনও আমাদের বাংলাদেশের সাহিত্যের আন্তর্জাতিক কদর সেরকম অর্থে আমরা বৃদ্ধি করতে পারিনি। এবং অনুবাদ সাহিত্যে আমরা কাঙ্খিত সফলতা পাইনি।
সাহিত্যের আন্তর্জাতিক কদর বৃদ্ধি করতে চাইলে আমাদেরকে অনুবাদ-সাহিত্যে মনোযোগী হতে হবে। বাংলাদেশের সকল উল্লেখযোগ্য বইকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে দিতে হলে প্রয়োজন ভালো অনুবাদের ব্যবস্থা করা। আর এর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের সাহিত্যের বিচিত্র সম্ভার বিশ্বের মানুষের দরবারে পৌঁছে যাবে ও সমৃদ্ধি পাবে।
সকলরকম প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তির হিসাবনিকাশ শেষ হলে আমরা একটা কথা খুব দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে কেবল বাংলাদেশের সাহিত্যই টিকিয়ে রাখতে পারবে। যদিও অনেকে মনে করেন ঔপনিবেশিক ভাষাগুলোর প্রভাব বাংলা ভাষাকে দূষণ করছে, তবে এই দূষণকে আমরা শাপে-বর বলতে পারি। কেননা ভাষা তো চিরকাল প্রবহমান। পরিবর্তনই তার ধর্ম।
আর পরিবর্তনের জন্য অন্য ভাষা থেকে গ্রহণটাও বাংলা ভাষার জন্য পুষ্টিকর। তবে অধিক আহার গ্রহণ করা যেমন স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ংকর হতে পারে, সেরকমভাবে অন্য ভাষার অধিক প্রভাবও ভাষার জন্য অস্বাস্থ্যকর হতে পারে।
তাই বাংলাদেশের সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মীদের এই ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। আর আমরা প্রচন্ডরকম আশাবাদী; এই সকল প্রশ্ন এবং জবাবের মধ্য দিয়ে, বাংলা ভাষার দীর্ঘদিন টিকে থাকার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্য নিজেকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলবে।