একহাতে অবিরাম অনুবাদ করছেন আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু। ওরিয়ানা ফালাসি থেকে খুশবন্ত সিং, এম জে আকবর হয়ে ইতিহাস, রাজনীতি, সভ্যতা ও ঐতিহ্যের বহু নন-ফিকশান প্রপঞ্চ বাংলাভাষী পাঠকের সামনে উন্মোচিত করেছেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শেষে বাংলাদেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকারী আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। তার সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ ও অনুবাদ সাহিত্যের নানা বিষয়ে আলাপচারিতার চুম্বক অংশ এখানে উপস্থাপিত হলো।
প্রশ্ন: এবারের বইমেলায় রাজনীতিবিদ গান্ধী ও জিন্নাহর ধর্ম বিষয়ক অবস্থান মূল্যায়ন করে এম জে আকবরের বই অনুবাদ করেছেন। বইটির মূল বৈশিষ্ট্য কি?
উত্তর: বইমেলাকে উপলক্ষ করে আমি কোনো বই অনুবাদ করি না। আমি সারা বছর কাজ করি, প্রকাশকরা মেলাকে বই প্রকাশের উপলক্ষ্য হিসেবে বেছে নেন। এম জে আকবরের ‘গান্ধী’স হিন্দুইজম: দ্য স্ট্রাগল অ্যাগেইনস্ট জিন্নাহ’স ইসলাম’ বইটি পাঠ করার সুযোগ হয় ২০২০ সালে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমাকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক বিকাশ, ভারত বিভাজন ইত্যাদির নিবিড় পাঠ করতে হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়েও ব্যক্তিগত আগ্রহ ও সাংবাদিকতার পেশাগত কারণেই উপমহাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো, বিশেষ করে যে বিষয়গুলো আমাদের আবেগ-অনুভূতিকে স্পর্শ করে, তা পাঠ করতে আগ্রহী হই। এম জে আকবর তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন, যা বিতর্কিত হলেও গুরুত্বপূর্ণ। পাঠকরা বিতর্কের মধ্য দিয়ে সত্যে উপনীত হবেন - এই দার্শনিক তত্ত্বকে সামনে রেখে আমি বইটি অনুবাদ করার প্রয়োজন অনুভব করেছি।
বইটির বৈশিষ্ট হলো, এম, জে আকবর ভারতের অখণ্ডতা গান্ধীর কাছে কেন প্রয়োজন ছিল এবং ভারত বিভাগ জিন্নাহ’র কাছে কেন মুসলিম মুক্তির সমার্থক ছিল, তা দলিলিকভাবে তুলে ধরেছেন। তার দৃষ্টিকোণ থেকে গান্ধীর ধর্মনিষ্ঠা, মানবতা ও মহত্বের বিপরীতে জিন্নাহ ছিলেন ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারকারী, ক্ষমতালোভী ও একগুঁয়ে। তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে, জিন্নাহ’র মগ্নতা ছিল পাকিস্তানে এবং পাকিস্তান সৃষ্টির কারণে উপমহাদেশের মুসলমানদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে এবং শুধু মুসলিম অধ্যুষিত হলেই তারা চিরশান্তিতে থাকবে, এমন রাজনৈতিক চিন্তা ও দ্বি-জাতিতত্ত্ব যে ভ্রান্ত ছিল তার প্রমাণ ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করার ঘটনা। তার মতে, জিন্নাহ’র সেরা সাফল্যই ছিল তার সবচেয়ে চরম ব্যর্থতা। বইটিতে আরেকটি সত্য তুলে ধরা হয়েছে যে, গান্ধী তার অহিংস আন্দোলন ও সত্যাগ্রহের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সংঘাত থেকে ভারতবাসীকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা চালালেও ভারতকে অখণ্ড রাখতে সফল হননি, অপরদিকে জিন্নাহ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিকে বাস্তবে রূপ দিয়ে তার রাজনৈতিক লক্ষ্যকে সফল করেছেন। উভয়েই যার যার মতো ধর্মকে ব্যবহার করেছেন। আমার কাছে আকবরের এ কথাগুলো বস্তুনিষ্ঠ বলে মনে হয়েছে।
প্রশ্ন: কেন এর অনুবাদে আকৃষ্ট হলেন?
উত্তর: এম জে আকবরের লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় সত্তরের দশক থেকে। ভারতে বিভিন্ন মুসলিম ইস্যুর ওপর তিনি যা লিখতেন তা ভারতীয় মুসলিমদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি করতো। কিন্তু আমি তার যেকোনো লেখা পাঠ করতাম। ২০২০ সালের প্রথম দিকে আমি প্রথমবারের মতো গান্ধীর ওপর এম জে আকবরের একটি নিবন্ধ অনুবাদ করি এবং সেটি বাংলাদেশের মিডিয়ায় গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। লেখাটি ছিল শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের বিচারের শুনানি ও রায়ের ওপর এইচএলও গ্যারেটের ‘দ্য ট্রায়াল অফ বাহাদুর শাহ জাফর’ গ্রন্থের ভারতীয় সংস্করণের ভূমিকা। আমি আমেরিকায় বসবাস করলেও আমার অনূদিত লেখাটি বাংলাদেশের একটি সূত্রের মাধ্যমে এম জে আকবরের কাছে গিয়ে পৌঁছায়। তাছাড়া খুশবন্তু সিং এর অধিকাংশ বই আমি অনুবাদ করেছি বলে আমার পরিচয় জেনে আকবর তার ‘গান্ধী’স হিন্দুইজম: দ্য স্ট্রাগল অ্যাগেইনস্ট জিন্নাহ’স বইটি অনুবাদ করার জন্য আমাকে অনুরোধ করতে বলেন। আমাকে তার অনুরোধ পৌছানো হলে বইটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সচেতন পাঠকদের পাঠ করা প্রয়োজন ভেবে আমি অনুবাদ করতে সম্মত হই।
প্রশ্ন: আগেও আপনি মুঘল ইতিহাস-ঐতিহ্য অন্বেষী বহু গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন। কেন এই বিষয় বেছে নিলেন?
উত্তর: মুঘল ইতিহাস-ঐতিহ্য বলতে আমি মূলত শুধু শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের ওপর লেখা বেশ কয়েকটি বই অনুবাদ করেছি। সামগ্রিকভাবে মুঘল শাসন অথবা অন্যান্য মুঘল সম্রাটদের নিয়ে কোনো বই অনুবাদ করিনি। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ওপর একাধিক বই অনুবাদ করেছি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে ভারত বিভক্তি এবং ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতাসহ উপমহাদেশের রাজনৈতিক বিকাশের ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ থেকেই এসব বই অনুবাদ করেছি।
প্রশ্ন: কোন কোন বইয়ের অনুবাদ আপনাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে? কেন?
উত্তর: আমি একটি বইয়ের কথা না বলে তিন সংস্কৃতির তিনটি বইয়ের কথা উল্লেখ করবো, যে বইগুলো আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। একটি খুশবন্ত সিং এর বিখ্যাত উপন্যাস 'ট্রেন টু পাকিস্তান', যার বিষয়বস্তু হলো ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের ফলে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে মানুষের গণ-স্থানান্তরের বা ব্যাপক ও জোরপূর্বক অভিবাসনের সিদ্ধান্তের কারণে উদ্ভুত মানবিক সংকট। এই মানবিক সংকটের মধ্যেও এক মুসলিম তরুণীর সঙ্গে এক শিখ যুবকের প্রণয়ের ঘটনা বইটি মূলবিন্দু। প্রেমিক যখন জানতে পারেন যে তার মুসলিম প্রেমিকাকে যে ট্রেনে তুলে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে, নাশকতাকারীরা একটি রেলসেতুতে রশি বেঁধে দিয়েছে যাতে ট্রেনের ছাদে আরোহীরা রশির আঘাতে ছিটকে পড়ে, ট্রেনের গতিরোধ হয় এবং তারা ট্রেনের সকল মুসলিমকে হত্যা করতে পারে। নাশকতাকারীদের হাতে সে তার প্রেমিকার মৃত্যুর কথা ভাবতে পারে না। সন্ধ্যার পর ট্রেন আসার আগে সে সেতুতে ওঠে রশি কাটতে শুরু করে, নাশকতাকারীরা তাকে দেখতে পেয়ে গুলি করে। সে আহত হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত রশি কাটতে সফল হয়ে সে পড়ে যায়, ট্রেনটি তার প্রেমিকাকেসহ নিরাপদে পাকিস্তানে চলে যায়।
দ্বিতীয় বইটি সার্বিয়ার নোবেল বিজয়ী লেখক আইভো অ্যানড্রিচের ইতিহাস ভিত্তিক 'দ্র ব্রিজ অন দ্য দ্রিনা'। সার্বিয়া তথা বৃহত্তর যুগোস্লাভিয়া বা বলকান অঞ্চলে তিনশ’ বছরের অটোম্যান যুগে ওইসব এলাকায় তুর্কি প্রশাসন ছাড়াও তুর্কি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। সার্বিয়ার একটি নদী দ্রিনা, সেই নদীর পাশে ভিশেগ্রাদ শহরকে অপর পাশের এলাকার সঙ্গে যুক্ত করার জন্য একটি সেতু নির্মাণ করে তুর্কিরা। পার্বত্য নদীর ওপর সেতু দেশের দুই অঞ্চলের বিকাশে ভূমিকা রাখে। তিনশ’ বছর ধরে সেতুটি ছিল ভিশেগ্রাদের মানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। লেখক সেতুকে কেন্দ্র করে তিনশ বছরের অটোম্যান শাসন তুলে ধরেছেন। এটি অসাধারণ এক সাহিত্যকর্ম।
তৃতীয় বইটি হচ্ছে আরবি সাহিত্যে একমাত্র নোবেল বিজয়ী মিশরের ঔপন্যাসিক নাগিব মাহফুজের 'কায়রো ট্রিলজি'। প্রায় দেড় হাজার পৃষ্ঠার তিন খণ্ডে কায়রোর একটি পরিবারের তিন প্রজন্মের কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে নিপূণভাবে। এর মধ্যে পরিবার, সমাজ, রাজনীতি সবই আছে। লেখক বইটি লিখতে ছয় বছর ব্যয় করেছেন, আমি অনুবাদ করতে চার বছর ব্যয় করেছি। ধৈর্য্য শেষ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পাঠকের আগ্রহ টেনে রাখার মতো উপন্যাস বলে আমি অনুবাদ শেষ করতে সফল হয়েছি।
প্রশ্ন: বাংলা ভাষায় অনুবাদ সাহিত্য সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
উত্তর: বাংলা ভাষায় বিভিন্ন ভাষার বই প্রচুর অনুবাদ হচ্ছে। আমার বিশ্বাস মৌলিক বই এর চেয়ে অনুবাদ প্রকাশিত হচ্ছে অনেক বেশি। আমি দেশের বাইরে থাকি বলে কার অনুবাদ কেমন তা বলা সম্ভব নয়। আমি নিজেও কতটা ভালো অনুবাদ করি তা পাঠকদের সঙ্গে আমার সরাসরি ইন্টার্যাকশন বা মিথস্ক্রিয়া নেই অথবা মতবিনিময় হয় না বলে বুঝতে পারি না। নিষ্ঠাবান পাঠক বা কট্টর অনুবাদ-সমালোচকের পাল্লায় পড়লে আমার অনুবাদ হয়তো আরো উন্নত হতে পারতো। আমরা যে ভাষাগুলো থেকে অনুবাদ করি, সেগুলো কোনোটাই আমাদের মাতৃভাষা বা প্রথম ভাষা নয়। আমি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করি, অনুবাদ করতে গিয়ে অনেক সময় কোনো বাক্যে একটি শব্দের উপযুক্ত বা যে মর্মার্থ হওয়া উচিত তা খুঁজে না পেয়ে আক্ষরিক অনুবাদ করে ফেলি, সেক্ষেত্রে পাঠক হোঁচট খাবেন। সেজন্য যারাই অনুবাদ করছেন, পাকা অনুবাদক হোক বা নতুন অনুবাদক হোক, প্রকাশকদের উচিত সম্পাদকের মাধ্যমে পাণ্ডুলিপি যাচাই করার ব্যবস্থা করা।
প্রশ্ন: মানসম্মত অনুবাদে ক্ষেত্রে কোন কোন বৈশিষ্ট্যকে আপনি বিশেষ গুরুত্ব দেবেন?
উত্তর: অনুবাদের বিষয়বস্তু কী এবং কে অনুবাদ করবেন তার ওপর নির্ভর করে মানসম্মত অনুবাদ। যিনি প্রাচীনকালের দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিষ্টটল, মিলেটাস, এপিকুরাস, ডায়োজেন, পিথাগোরাস, প্রোটাগোরাস, জেনো থেকে শুরু করে আধুনিককালের দার্শনিকদের কঠিন বই অনায়াসে অনুবাদ করবেন, তার পক্ষে উপন্যাস বা কবিতার মতো সাহিত্য অনুবাদ করা সহজ হবে না। অনুবাদের ক্ষেত্র হওয়া উচিত অনুবাদকের মন ও মনন অনুযায়ী। অনেকে থ্রিলার অনুবাদ করছেন, আমি থ্রিলার অনুবাদ করতে গেলে পুরোপুরি ব্যর্থ হবো। যেহেতু অনুবাদ নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো কাঠামোর অস্তিত্ব নেই সেজন্য যিনি অনুবাদ করবেন তার উচিত নিজের ভাষার ওপর ভালো দখল থাকার পাশাপাশি যে ভাষার বই অনুবাদ করবেন শুধু সেই ভাষায় ভালো দখল থাকা নয়, বইটিতে যে সমাজ ও সংষ্কৃতি, এমনকি স্থানে বর্ণনা রয়েছে সেই সমাজ, সংস্কৃতি ও স্থান সম্পর্কে কিছুটা জানা। ‘কায়রো ট্রিলজি’ বইটি অনুবাদ করতে গিয়ে আমি দু’জন শিক্ষিত মিশরীয় বংশোদ্ভুত আমেরিকানের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি। একজন আমার ডেন্টিস্ট, আরেকজন ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির সাবেক অধ্যাপক। জায়গার বিবরণ বা আরবি শব্দের মিশরীয় উচ্চারণ জানতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, কারণ মধ্যপ্রাচ্যে একই আরবি শব্দের অর্থ অভিন্ন হলেও উচ্চারণ ভিন্ন ভিন্ন।
প্রশ্ন: মার্কিন প্রবাস জীবনে লেখালেখি করতে কেমন সুবিধা পাচ্ছেন বা অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন?
উত্তর: প্রবাস জীবনে আমি নবীন হলেও বয়সে প্রবীণ। যুক্তরাষ্ট্র কোনো ওয়েলফেয়ার স্টেট বা কল্যাণ রাষ্ট্র নয়। প্রত্যেককে কাজ করে জীবিকা সংস্থান করতে হয়। যারা দীর্ঘদিন কাজ করেন তারা সোস্যাল সিকিউরিটি বেনিফিট নিয়ে হয়তো একটি সময়ের পর কাজ করেন না, নিজের সৃজনশীল কাজ করেন। আমাকে রুটিরুজির ব্যবস্থা করার পর অনুবাদের কাজ করতে হয়। সেজন্য বাংলাদেশে থাকতে অনুবাদে যে গতি ছিল এখানে আসার পর তা মন্থর হয়েছে। কাজের বাইরে যতটা সময় পাই, সাধ্যমত অনুবাদ করি। পরিস্থিতির চাপ উপেক্ষা করেও আমি সানন্দে আমার লেখালেখি চালিয়ে যেতে কোনো শৈথিল্যকে স্থান দিই নি আমার জীবনে, এখনো এটাই আমার মূলমন্ত্র।
প্রচ্ছদ ও অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু