ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন লেখক ড. কে এম এ মালিক ইন্তেকাল করেছেন ২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার দিবাগত রাত সোয়া দশটায়। লন্ডনের বাথ হসপিটালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি পরপারে পাড়ি জমান। মৃতুকালে স্ত্রী, ৩ মেয়ে ও অসংখ্য গুনগ্রাহী রেখে গেছেন।
ড. মালিক আমার খুব আপনজন। তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতিক। এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। শিক্ষক নেতা হিসেবেও সুখ্যাতি ছিল। বৃটেনের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসার পরও ঢাবিতে তার সংযোগ ছিল। দেশের বুদ্ধিজীবী মহলে ছিল ব্যাপক গ্রহনযোগ্যতা। দেশ থেকে দলমত নির্বিশেষে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক যারাই বিলেত এসেছেন, ড. মালিকের আতিথেয়তা গ্রহন করেছেন।
ড. মালিক আমার জ্বালাতনে লেখক হয়েছেন। এজন্য আমার প্রতি তার আলাদা হৃদ্যতা ছিল। প্রথম দিকে লেখাগুলো আমি সম্পাদনা করে দিতাম। কিন্তু অল্পদিনে তার লেখায় এক ধরণের মুনসিয়ানা চলে আসে। সফল একাডেমিক হিসেবে বিষয় বৈচিত্র্য ও তথ্যের সমাহার আগে থেকেই ছিল। ভাষা ও কলাম লেখার ধারাটি রপ্ত করতে খুব সময় লাগেনি।
সাপ্তাহিক ইউরো বাংলায় নিয়মিত লিখতে যাদের বাধ্য করতাম, তিনি তাদের একজন। ইউরো বাংলার জন্ম থেকে বিবিসি খ্যাত সাংবাদিক সিরাজুর রহমান নিয়মিত লিখতেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লিখে গেছেন। বৃটেনের খ্যাতিমান নাট্যকার অধ্যাপক জাফরী জোবোয়েদ ও সুলেখক জগলুল হোসেন প্রমুখ প্রায় নিয়মিত লিখতেন।
লেখক হওয়ার জন্য যে সাধনা ও নিষ্ঠার প্রয়োজন, সেটা ড. মালিকের মধ্যে দ্রুত জাগ্রত হয়েছিল। অবিরাম চর্চা করে তিনি মান সম্পন্ন প্রাবন্ধিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তারপর যখন তার বই প্রকাশিত হয়, সে আনন্দ আমার চেয়ে আর কেউ জানবেনা। কারণ আমি ছিলাম তার মূখ্য প্রেরণা সঞ্চারকারী। টেলিভিশন টকশোতে তার জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য সুধী মহলের প্রশংসা কুড়িয়েছে।
ড. মালিক একসময় টিভি দেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তখনই তিনি সৃজনশীল লেখকে পরিনত হন। একটি বিষয়ে অবশ্য প্রথম থেকে দৃঢ় ছিলেন, অন্যকে সন্তুষ্ট করার জন্য তিনি লিখেননি। বরং নিজের দায়িত্ববোধ থেকে লিখতেন। সত্য বলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। তা যত তিক্তই হোক। নিজের বিবেক ও প্রজ্ঞাকে কাজে লাগিয়ে জাতির প্রয়োজনে লিখতেন। লেখার বিষয়ে তিনি বহুমাত্রিক ছিলেন। মনোগ্রাহী করার জন্য প্রয়োজনে বারবার ফোন করতেন। শব্দ বা তথ্য মিলিয়ে নিতে দ্বিধাবোধ বা সংকোচতা ছিলনা।
ড. মালিক একসময় বাম রাজনীতির সমর্থক ছিলেন। ফলে শোষণ বিরোধী চেতনা তার মাঝে ছিল। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উন্নয়নের রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হবার পরও বাম ধারায় ছিলেন। মেহনতি মানুষের মুক্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তিনি। নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি আর বিত্ত-বেসাতের প্রতি তেমন মনযোগী ছিলেন না। এই মৌলিক গুণের কারণে পরবর্তীতে ধর্মীয় আদর্শের প্রতি তার আস্তা ও বিশ্বাস পরিলক্ষিত হয়েছে।
বিশ্ব রাজনীতির মোড়লিপনার বিরুদ্ধে এবং মুসলিম বিশ্বের বঞ্চনার বিষয়ে তার অনেক লেখা সর্ব মহলে সমাদৃত হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রসনের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার ছিলেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দুর্যোগ নিয়ে প্রচন্ড ব্যাকুলতা ছিল। অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি প্রচুর লিখেছেন।
ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ বিরোধী আন্দোলনে তিনি সামনের কাতারে ছিলেন। সীমান্ত আগ্রাসন প্রসঙ্গ বেশ গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেছেন। সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে তার কলম ছিল সোচ্চার।
ড. মালিক সংলাপ সাহিত্য-সংস্কৃতি ফ্রন্ট সহ বিভিন্ন সামাজিক ও সেবামূলক সংগঠনের সাথে সক্রিয় ভাবে জড়িত ছিলেন। অনেকটা হাস্যরসের মাধ্যমে সামাজিক ভণ্ডামি ও রাজনৈতিক কুসংস্কার তুলে ধরতেন তিনি। সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখা ও বিশ্লেষণ করার পারঙ্গমতা লেখক মহলে তাকে অনন্য মর্যাদায় অভিসিক্ত করেছে।
মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন।