হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা

কবিতা, শিল্প-সাহিত্য

হাসান হাফিজ | 2023-09-01 05:32:57

পরম চরম ত্যাগ

সাধারণ সূর্য সে তো নয়
রক্তসূর্য, স্বাধীনতা বলে ওকে ডাকি
সে এক আশ্চর্য পাখি
ডানায় রক্তের ছোপ সমুদ্র সমান
কার? কার??
শহীদের। লাখো শহীদের।
স্বাধীনতা পেতে এতো রক্ত লেগেছিল।
পতাকার লাল সূর্য
তার তৃষ্ণা গভীর প্রচণ্ড ছিল
লক্ষ প্রাণ বলিদান ছাড়া
ওই বৃত্ত সম্পূর্ণ ও সম্পন্ন হওয়ার মত
অধিকার, প্রত্যয় রাখে না
তার স্পর্ধা, উড্ডীন থাকবার শক্তি
কে কবে জোগান দেবে? কোত্থেকেই বা দেবে
ওই রক্ত। কার? কার??
শহীদের। স্বাধীনতা-স্বপ্নিল-বিভোর।
এই সোঁদা মৃত্তিকার
সাহসী সন্তান সেই বীর শহীদের
পরম চরম ত্যাগ
সেই সঙ্গে মা-বোনের
তিতিক্ষা সম্ভ্রম।

কেন চোখ ছলোছলো

থামতে হয়, থামি
নত হয়ে চর্চা করি কাঙালিপনার
নামতে নামতে
সংশয়ের কাঁটা বিঁধে
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি
দ্বিধাতুর আমি।
থেমে থেমে
মেঘের আড়াল ফুঁড়ে
আকাক্সিক্ষত বৃষ্টিকণা
আসুক অঝোরে নেমে
ধারাজলে হতে পারে স্নান সমাপন
গোপন আনন্দটুকু না যায় বর্ণন।
মনোবাঞ্ছা তোমার অঙ্কুরে দিই
সতেজ প্রফুল্ল দ্যুতি
আলো হাওয়া জল
মৃত্তিকা মমতা স্নেহ
শর্তহীন অপত্য কোমল
তাও কেন মালিন্যমণ্ডিত থাকো
দুই চক্ষু কেন ছলোছলো ?

আর্ত, দীর্ণ, পলাতক

বন্ধুবেশে এসেছিল
মায়াবী সে আততায়ী
ঘাতকেরও মনে ছিল
ভালোবাসা কোমল দ্রবণ
সেই হাত কেন ও কীভাবে
বশীভূত হয়েছে এমন
রক্ততৃষ্ণা কেন হলো
অতটা প্রবল
এই প্রশ্ন ঘুরপাক
এ জিজ্ঞাসা জেগে থাকবে
সমস্ত জীবন
আশ্চর্য ব্যাপার হলো
আততায়ী যে বান্ধব
তারই জন্য
এই মন অহর্নিশ পোড়ে
গোপন জ্বলুনি কষ্ট
অন্যকে বলার মত
শক্তি ও সাহস কিছু অবশিষ্ট নাই !
নিজেই নিজের কাছ থেকে
অজ্ঞেয় কারণে আর্ত পালিয়ে বেড়াই।

নিয়তি ও ক্ষয়

নিজের ছায়াকে নিজে ভয় পাও আজকাল।
ভয়ের ব্যারামে দেখি ভালোই হয়েছো কাবু
ভীরুতা লালন করে মনোমাঝে
কী যে সুখ পাও!
ডেকে আনো আতঙ্ক অসুখ।
পাখির ছানার মতো
ভয়ে কাঁপে বুক।
ভয় আছে পরাজয়ও আছে
হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছো
সন্নিকটে কাছে
ফেরবার রাস্তা গেছো ভুলে
বিষাদ পুঞ্জিত আছে হাসনাহেনা
বেলি চাঁপা ফুলে
ছায়াও ফুলের কষ্টে ম্রিয়মাণ হয়
ছায়ার নিজেরও আছে ঊনতা ভীরুতা
গ্লানি কষ পরাজয়
এলোমেলো সংকটে নাস্তানাবুদ
ছায়ারাও হয়
নিয়তিনির্দিষ্ট সেই প্রণেতা
আত্মধ্বংসী ক্ষয়।


কেন ভয় কেন জাগরণ

বাধার পাথর পাহাড় ভেঙে
উচ্চে ওঠেন ভালোবাসায়
ডানায় আছে শক্তি সাহস
দ্বিধান্বিত নয় উড়ানে
উড়তে উড়তে মুক্ত পাখি
ছাড়পত্রের নাই দরকার
পাখি শুধুই উড়তে জানে
ওড়ার মধ্যেই নিহিত সুখ
থামলে পরেই নীল অধোমুখ
রঙের নীলে আকাশঝিলে
অবদমন আছড়ে পড়ে
বাধা এবং পাথর ঝড়ে
গা ঝাড়া দেন ভালোবাসা
সে উত্থানে পাই ভরসা
নয় ফাঁপা সেই বিপত্তারণ
বুঝলে নাকি ধিক পোড়ামন।
বোঝোই যদি কাঁদছো কেন
বোঝোই যদি ভিতর ভিতর
আলগোছে ভয় জাগছে কেন ?

ছন্দ খুঁজি মুক্তি খুঁজি

কথার পিঠে
বলাই যেত
অনেক কথা,
কিন্তু কেন
বসলো জেঁকে
আদিম সত্য
নীরবতা ?
নৈঃশব্দ্যের
তেজ গরিমা
এক আধটুকু
গর্ব অহং
কথায় যদি
রঙ ছড়াতো
এই পোড়া মন
ধন্য হতো।

কথা এবং কথকতার
ক্লান্তি আছে
কষ্ট আছে
পড়বে ধরা
পড়তে পারে
এমনিতর
আশঙ্কাও
ঠিক জেগে রয়।
গাঙের জলে
নাও ভাসানোর
বৈঠা দাঁড়ের
শব্দ ছলাৎ
গোপন করা
যায় কখনো ?
কিংবা পালে
ঝোড়ো হাওয়ার
শনশনানি
দূর ঠিকানার
হাতছানি জোর
প্রবলতর
সেই মোহিনী
আকর্ষণের
আসক্তি খুব
তীক্ষè প্রখর
সাধ্য তো নাই
উজান ঢলে
দ্বন্দ্বমুখর
সংঘাতে সব
উল্টে দেওয়া
তাই তো কথায়
মুক্তি খুঁজি
স্বাধীনতার
ছন্দ খুঁজি
সত্য আঁধার
ফুরায় পুঁজি !!

চেষ্টা নিরন্তর

পাথরে পাথর ঠুকলে
আগুনের জন্ম হয়
জীবনে জীবন ঘষলে
সমর্পণ ভালোবাসা
প্রস্তর এবং এই জীবনের
অন্ধি সন্ধি একত্রে মেলালে
কী হয়, কী হবে?
চেষ্টা করে দেখতে হয়
সন্ধিৎসা পূরণ হয় তবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর