চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে আমার স্নেহভাজন সহকর্মী ও প্রিয় ছাত্র প্রফেসর মোহাম্মদ আলম চৌধুরী রচিত 'আসহাবউদ্দীন আহমদ ও মানবসমাজের মুক্তিভাবনা' গ্রন্থটি যখন হাতে এলো, তখন রাজা রামমোহন রায়ের সার্ধ-দ্বিশত জন্মবার্ষিকী পালিত হচ্ছে। কিছুদিন আগেই পালিত হয়েছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশততম জন্মবার্ষিকী। দুইবছর বাদেই অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন আহমদেরও ১১০তম জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হবে।
সত্য কবুল করে বলতে দ্বিধা নেই যে, আধুনিক ইতিহাসের ধারায় হিন্দু ও মুসলিমের মিলিত বৃহত্তর বাঙালি সমাজে শতবর্ষব্যাপী আলোচিত ও স্মরণীয় মনীষার সংখ্যা খুব বেশি নয়। অত্যল্প ব্যক্তিত্বই নিজের জীবন ও সমকালের পরিসরকে গৌরবের সঙ্গে অতিক্রম করে শতাব্দীর পরিসীমায় নিজের জাগরস্বপ্নকে প্রলম্বিত করতে সফল হয়েছেন। আর্থ, সামাজিক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অপরিসীম ও অমোচনীয় প্রভাবের কারণে তাদের জীবন ও কর্ম কাল-কালান্তরে ও প্রজন্মব্যাপী সতত আলোচিত হয়েছে।
সমাজ ও মানুষের কাছে চিরায়ত গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা লাভকারী অগ্রণী ও বিশিষ্ট বাঙালি আইকনিক চরিত্রের মধ্যে অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন আহমদ নানা কারণে অতুলনীয় ও উজ্জ্বল ব্যতিক্রম স্বরূপ। কারণ, তিনি তৎকালীন রাজধানী কলকাতা বা ঢাকায় অবস্থান করেননি এবং কোনরূপ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও বদান্যতার পরোয়া করেননি। স্বকীয় মেধা ও মননের শক্তিতে সম্পূর্ণ স্বনির্মিত মানুষ ছিলেন তিনি। ছিলেন প্রথা ও গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে নীতি, নৈতিকতা ও শুদ্ধাচারের বিদ্রোহী প্রতিমূর্তি। তিনি জীবনভর সক্রিয় ও ভূষিত ছিলেন মাটি, মানুষ ও সমাজ-সংশ্লিষ্টতার শাশ্বত চৈতন্যের আলোকমালার বর্ণালীতে।
এমনই এক বহুমাত্রিক, ঘটনাবহুল জীবনের অধিকারী মানুষের জীবনচরিতের সামগ্রিক বিশ্লেষণ শুধু সাহিত্যিক দিক থেকেই নয়, ও সামাজিক গবেষণার নিরিখেও অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শুধু গুরুত্বপূর্ণই নয়, কাজটি ব্যাপক, বিশাল অধ্যাবসায়ের ও শ্রমসাপেক্ষ। প্রফেসর মোহাম্মদ আলম চৌধুরী রচিত 'আসহাবউদ্দীন আহমদ ও মানবসমাজের মুক্তিভাবনা' গ্রন্থটি বহুবছরের প্রচেষ্টায় সম্পন্ন তেমনই এক নান্দনিক প্রয়াস, যা গতানুগতিক জীবনী সাহিত্য বলতে যা বোঝায়, তার চেয়ে অগ্রসর ও নিবিড় গবেষণামূলক প্রচেষ্টা।
সাধারণত কোন ব্যক্তির জীবন কেন্দ্রিক প্রত্যাগত মাধ্যমে রচিত সাহিত্যকে জীবনী সাহিত্য বলে। সংস্কৃতে এমন অনেক জীবনী সাহিত্যর পরিচয় মেলে, যেখানে জীবনী সাহিত্যকে 'কারিকা' বা 'বৃত্তি' বলা হত। মধ্যযুগের চৈতন্য দেবের আবির্ভাবের পর তাকে কেন্দ্র করে এবং তার পার্ষদদের কেন্দ্র করে এই জীবনী সাহিত্য রচনার সূত্রপাত হয়। পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যে অবিস্মরণীয় অনেক জীবনী রচিত হয়েছে। যার মধ্যে গোলাম মুরশিদের 'আশার ছলনে ভুলি' (মাইকেল মধুসূদন জীবনী) ও সুমন চট্টোপাধ্যায়ের 'প্রথম নাগরিক' (ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি জীবনী) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 'আসহাবউদ্দীন আহমদ ও মানবসমাজের মুক্তিভাবনা' ভাষায়, বর্ণনায়, বিশ্লেষণে, তথ্যের সমাবেশে, কাঠামো ও পরিসরের বিস্তৃতিতে উচ্চাঙ্গের জীবনী গ্রন্থের তালিকায় স্থান পাওয়ার যোগ্য।
আসহাবউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশি লেখক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ ও দক্ষ সংগঠক ছিলেন। তিনি যুক্তফ্রন্টের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এবং একজন কমিউনিস্ট ছিলেন। চট্টগ্রাম সিটি কলেজ, সাধনপুর পল্লী উন্নয়ন উচ্চ বিদ্যালয়, বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজসহ বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। তিনি বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় মোট ২৭টি গ্রন্থ রচনা করেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ২০০৫ সালে মরণোত্তর বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক-এ ভূষিত হন।
শিক্ষকতা দিয়ে আসহাব উদ্দীন আহমদ কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি প্রথমে চট্টগ্রাম কলেজ, পরে একে একে তৎকালীন ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমান হাজী মুহম্মদ মুহসীন কলেজ), লাকসাম নবাব ফয়েজুন্নেসা কলেজ, ফেনী সরকারী কলেজ-এ ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি থেকে ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ-এ ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন বেসরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতির মুখপত্র 'দি টিচার'-এর সম্পাদক।
আসহাব উদ্দীন ১৯১৪ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমান বাংলাদেশ) চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর গ্রামের সচ্ছল এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মুনশী সফর আলী চৌধুরী ও মা নাসিমা খাতুন। তিনি ১৯৩২ সালে বাণীগ্রাম-সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ১৯৩৪ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বিএ পাস করার পর ১৯৩৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এমএ পাস করেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় উঠেন এবং কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে দেন। মার্ক্সবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে যোগ দেন কৃষক-শ্রমিকদের পাশে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী লীগের (ন্যাপ) সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বিপ্লবী রাজনীতির অনুসারী হওয়ায় তাকে পাকিস্তান আমলে এক বছর জেল খাটতে হয়। আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসার পর তার রাজনীতি নিষিদ্ধ হয় এবং তার নামে হুলিয়া জারি হয়। ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত আন্ডারগ্রাউন্ডে হুলিয়া মাথায় নিয়ে জীবন কাটাতে হয়। পাকিস্তান সরকার তাকে ধরে দেওয়ার জন্য পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে।
১৯৬৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টি দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেলে তিনি পিকিংপন্থিদের সাথে ছিলেন এবং ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। সেই সময়ে তিনি বিভিন্ন গ্রামে কৃষকদের বাড়িতে তাদের আশ্রয়ে আত্মগোপন করে কাটান। ১৯৮০ চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে গণচীন সফর করেন ও সে বছরের শেষের দিকে সক্রিয় রাজনীতি হতে অবসর নেন।
আসহাব উদ্দীনের লেখালেখির মূল উপাদান ছিল শোষণমুক্তি ও সমাজ পরিবর্তন। ১৯৪৯ সালে তার রচিত প্রথম 'বই বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর' প্রকাশিত হয়। তিনি তার আমার সাহিত্য জীবন বইতে বলেছেন, আমার লেখায় হাসি-ঠাট্টার ভেতর দিয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও অবিচারকে তুলে ধরা হয়েছে এবং জনগণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিকে প্রচার করা হয়েছে, জনপ্রিয় করা হয়েছে, প্রোপাগান্ডার আকারে নয়, সাহিত্য রূপে।
অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৪ সালের ২৮ মে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজ প্রাঙ্গণে দাফন করা হয়।
প্রফেসর মোহাম্মদ আলম চৌধুরী রচিত 'আসহাবউদ্দীন আহমদ ও মানবসমাজের মুক্তিভাবনা' গ্রন্থটিতে একটি সুগভীর বিশ্লেষণাত্মক ভূমিকার পাশাপাশি তিনটি অধ্যায় ও ১২টি পরিশিষ্ট রয়েছে। একটি বিশুদ্ধ উচ্চতর গবেষণা কাঠামোয় সুনিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে গ্রন্থটি রচিত হয়েছে। আসহাবউদ্দীন সংক্রান্ত যাবতীয় আকর তথ্য এবং প্রাথমিক ও প্রকাশিত সূত্রের ব্যবহারে গ্রন্থটি আহসানউদ্দিনের সামগ্রিক জীবন ও কর্মের পর্যালোচনাতেই সীমাবদ্ধ নয়, ভাবীকালের গবেষকদের জন্যেও অনুপ্রেরণার উৎস।
একজন ব্যক্তিমানুষের মানস গঠন ও ব্যক্তিত্ব নির্মাণের দীর্ঘতম পর্যায়গুলো খুঁড়ে বের করেছেন লেখক। দক্ষিণ চট্টগ্রামের এক প্রত্যন্ত জনপদ থেকে একজন মানুষের পক্ষে জাতীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কণ্ঠস্বরে পরিণত হওয়ার রোমাঞ্চকর বৃত্তান্ত এই গ্রন্থ। এই গ্রন্থ এক প্রতিবাদী, প্রতিষ্ঠানবিরোধী, দ্রোহী ও অসঙ্গতির বিরুদ্ধে বিদ্রূপমাখা কণ্ঠ আর অক্ষরের অধিকারী এক লেখকসত্ত্বাও ইতিবৃত্ত।
লেখকের ভাষা অনন্য, বিশ্লেষণ অতলস্পর্শী, পর্যালোচনা সুদূরপ্রসারী, বিন্যাস বহুমাত্রিক নান্দনিকতায় দীপ্তিময়। অতীতে আহমদ ছফা ও উইল ডুরান্ডকে নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতায় বক্ষ্যমান গ্রন্থে লেখকের কুশলী কৃতিত্ব ও সুনিপুণ পারঙ্গমতা সুস্পষ্ট। 'প্রকৃতি' থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটি মুদ্রণ সৌকর্যে উন্নততর ও প্রতিনিধিত্বমূলক।
ঘটনাচক্রে গ্রন্থের লেখকের মতো প্রচ্ছদ শিল্পী জাওয়াদ উলআলম চৌধুরী আমার স্নেহভাজন ছাত্র, যিনি অধুনা শিল্পকলার ইতিহাস ও সমকালীন প্রপঞ্চ নিয়ে উচ্চতর গবেষণা সম্পন্ন করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। সামাজিক বিজ্ঞানের ব্যাপক পরিধিকে শিল্প-নন্দনের মেলবন্ধনে উদ্ভাসিত করার পারঙ্গমতায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে বহু প্রশংসনীয় কাজ করছেন। একইভাবে সাহিত্যিক ঘরানার জীবনীচর্চাকে সামাজিক-রাজনৈতিক বিজ্ঞানের ব্যাপকতর পরিপ্রেক্ষিতে জারিত করে নবতর বীক্ষণে উপস্থাপনায় ও বহুবর্ণা দৃষ্টিকোণ উন্মোচনায় লেখক প্রফেসর মোহাম্মদ আলম চৌধুরীর সাবলীল কৃতিত্বপূর্ণ দক্ষতা সমকালীন মননচর্চা ও গবেষণায় দৃষ্টান্তমূলক ও সাধুবাদের যোগ্য। 'আসহাবউদ্দীন আহমদ ও মানবসমাজের মুক্তিভাবনা' বিশেষভাবে আহসাবচর্চায় ও সাধারণভাবে বাংলা জীবনী সাহিত্যে মূল্যবান সংযোজন রূপে বিবেচিত হবে বলে আশা করা যায়।
ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম