মেয়েটির নাম চুমকি। মধুময় কণ্ঠ, আকর্ষণীয় দেহবল্লবী, স্বতঃস্ফূর্ত হাসি, সাহসী, দৃপ্ত চাহনি, অমৃতধারায় বহমান চোখজোড়া। বয়সের তুলনায় বড়োবেশি বিচক্ষণ, বুদ্ধিদীপ্ত আর প্রত্যয়ী। দৈহিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি পড়াশোনাও আছে বেশ। সুন্দরী প্রতিযোগিতায় তার বিজয় পরিবারটির নজর কাড়ে। এমন দ্যূতিছড়ানো মেয়েই খুঁজছিলেন শিমুলের মা-বাবা তাঁদের একমাত্র পুত্রের জন্য।
শিমুলও কম কিসে? সুদর্শন, ব্যাক্তিত্বময়, প্রতিভাবান,সুগঠিত পেশির বাঁধন, চোখ যেন হৃদয়ের জানালা। অসাধারন মেধাবী শৈশব হতেই। শিমুল যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সের ছাত্র তখন সহপাঠিনী রিমির মনে ধরে তাঁকে। রিমির আগ্রহেই শিমুল তাঁর স্টাডি পার্টনার হন। পড়াশোনার নামে সময়ে অসময়ে শিমুলের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে বসে আড্ডা দিতেন রিমি। মাঝে মাঝে মায়ের রান্না ভুনা খিচুড়ি নিয়ে এসে শিমুলের সাথে ভাগাভাগি করে খেতেন। সুযোগমতো পড়াশোনার বাইরের ব্যক্তিগত বিষয়ও আলোচনায় আনতেন। নিজের পছন্দ-অপছন্দ, এমনকি পরিবারের খুঁটিনাটিও শিমুলের সাথে সহভাগ করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন রিমি। শিমুল যেন তাঁর সাক্ষাৎ স্বজন, একান্ত কাছের মানুষ।
মাসের পর মাস এভাবে পেরুলেও শিমুলের দিক হতে ভালোবাসার ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে রিমির। এমনি অবস্থায় একদিন শিমুলকে সরাসরি বলে ফেলেন তাঁর জন্য পরিবারের পক্ষ হতে পাত্র দেখার কথা।
- শিমুল, তোমার সাথে একটা ব্যক্তিগত বিষয় শেয়ার করতে চাইছি; বলবো?
- বন্ধুদের সাথে কথা বলতে অনুমতি লাগে নাকি? তাড়াতাড়ি বলো।
- বাবা-মা কিন্তু আমার বিয়ের কথা সিরিয়াসলি ভাবছে।
- কিন্তু, তোমার তো অনার্স শেষ হতে আরো এক বছর বাকি। এখনই কেন তাঁরা বিয়ে দিতে চাইছেন?
- আমার ছোট খালা রুনু আমেরিকা প্রবাসী এক পাত্রের প্রস্তাব এনেছে। গ্রীনকার্ড নয়, একেবারে আমেরিকার পাসপোর্টধারী। বিয়ের পর স্পনসর করে আমেরিকা নিয়ে যেতে যে সময়টা লাগবে সে সময়ে আমার অনার্স শেষ হয়ে যাবে। মানে, পড়ার ক্ষতি হচ্ছে না মোটেও।
- তাই নাকি? তাহলে তোমাকে তো আর খুব বেশিদিন দেখছি না মনে হয়, সহসাই স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় উড়াল দিচ্ছো।
- কিন্তু ..., আমি তো কোথাও যেতে চাইনা শিমুল, দেশেই থাকতে চাই।
- তবে তা তোমার পরিবারকে জানাও না কেন?
- কোন ভরসায় জানাবো?
- মানে?
- মানে, কার ভরসায় জানাবো?
- বুঝলাম না রিমি, একটু খুলে বলো।
- খুলে আর কি বলবো? এটুকুতে না বুঝলে আমার আর বলার কি আছে? তুমি তো দেখছি ক্লাস ফাইভের খোকাকেও হার মানালে হে।
- সরি রিমি, আমি আপাতত পড়াশোনার বাইরে কিছু ভাবছি না। সহপাঠী আর বন্ধু হিসেবে তুমি অদ্বিতীয়, এটা আমি মানি, তবে, এর বেশিকিছু ভাবার সুযোগ যে আমার আপাততঃ নেই।
রিমির উচ্ছাস, ব্যাকুলতা শিমুলের মনে ঢেউ জাগাতে পারেনি দেখে তিনি নিজেকে ব্যর্থ ভাবতে থাকতে থাকেন। অথচ, হৃদয়ের গভীরে এই শিমুলকে নিয়ে তিনি কতো স্বপ্নের জালই না বুনেছেন। সেই থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে শিমুলের কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে লাগলেন রিমি। - -
বরাবরের মতো পরীক্ষায় খুব ভালো ফল করায় শিমুল তার বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার পদে চাকুরী পেলেন। তিন বছরের শিক্ষকতাকালে সঞ্চিতা নামের এক জুনিয়র সহকর্মীও তাঁর দিকে ভালোবাসার হাত বাড়িয়েছিলেন। শিমুল সে প্রস্তাবও এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে।
অবশেষে সুযোগ এলো বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য কানাডা যাবার। শিমুল তা কাজে লাগলেন। কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় বৃত্তিসহ মাস্টার্স লিডিং-টু-পিএইচডি প্রোগ্রামে স্টুডেন্ট ভিসা বাগিয়ে নিলেন তিনি। পাড়ি জমালেন হাজারো কিলোমিটার দূরের দেশ কানাডায়। জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো তাঁর।
পড়াশোনায় প্রতিভার স্বাক্ষর কানাডায়ও রেখে চলেন শিমুল। এক টানে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করে টরোন্টোর এক নামি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
লেখাপড়ার পাশাপাশি কানাডার বর্ণিল জীবনধারা তাঁর মুক্ত চিন্তার ক্ষেত্রও প্রশস্থ করে। সময়ের পরিক্রমায় তিনি আরো প্রবলভাবে অনুভব করতে শুরু করেন সমাজের আর দশটা পুরুষের মতো গতানুগতিক চিন্তা বা অনুভবের মানুষ তিনি নন। মানে, নারীর প্রতি তাঁর আকর্ষণ ঠিক অন্য দশ পুরুষের মতো নয়। নারীদের শ্রদ্ধাসম্মান করেন তিনি, ভালোবাসেনও, কিন্তু কোন নারীকে জীবনসঙ্গিনী করে দুই জীবন এক ফ্রেমে বন্দি করবেন এমন চিন্তা ঘুনাক্ষরেও তাঁর মাথায় আসে না।
এরই মাঝে সপ্তাহান্তের এক সকালে মায়ের ফোন বেজে উঠে।
- বাবা, তোকে আজ খুব মিষ্টি একটা খবর দেব। তুই কিন্তু না বলবি না, কথা দেয়।
- বলই না মা, না শুনে কেমনে হাঁ বলি?
- তোর জন্য অসম্ভব গুণী, লক্ষী একটা মেয়ে পেয়েছি, দেখতে পুতুলের মতো সুন্দর; বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী সে।
- বলো কি মা? মেয়েটা কে?
- এই যে, মিস বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় সেদিন প্রথম স্থান পেলো। টিভিতে দেখালো তাকে। তোকে ঝুমা (শিমুলের ছোটবোন) ছবি পাঠাবে কাল। তার আগে তোকে বলে রাখছি, মেয়েটা আমাদের সবার, এমনকি তোর বাবারও পছন্দের। মেয়েপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে আমরা প্রাথমিক সম্মতিও পেয়েছি। নাম চুমকি। যেমন নাম, তেমনই দেখতে। বিবিএ শেষ করেছে। এমবিএ পড়ার পাশাপাশি কাজও করে। শত গুনে গুণী সে।
শিমুলের বাবা অসুস্থ, পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে শয্যাশায়ী আজ প্রায় তিনবছর। মা স্কুলে শিক্ষকতা করে সংসার চালান। ঝুমা আর সীমা, দুই ছোটবোন পড়ে কলেজে। শিমুলই এখন পরিবারের চালিকাশক্তি। তিনি কিছুতেই মায়ের, তথা, পরিবারের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বাবার কষ্ট আরো বাড়িয়ে দিতে পারেন না। অন্তত বাবাকে খুশি করতে হলেও শিমুলকে এ বিবাহে রাজি হতে হবে, যদিও নারীদের ব্যাপারে শিমুলের তেমন আগ্রহ নেই। - -
যেই কথা সেই কাজ। চুমকি এখন শিমুলের বিবাহিতা স্ত্রী। বিবাহের উদ্দেশ্যে চাকুরী হতে দুসপ্তাহের ছুটি নিয়ে তড়িঘড়ি শিমুল দেশে এসেছিলেন। বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা আর দুপক্ষের আত্মীয়স্বজনের দাওয়াতে হাজিরা দিতে দিতেই দুসপ্তাহ যেন দুদিনেই কেটে গেলো। চুমকি বনেদি পরিবারের মেয়ে। তাদের আত্মীয়স্বজনের পরিধি অনেক বড়ো। তাছাড়া, সুন্দরী প্রতিযোগিতায় বিজয়ী চুমকি কেবল সৌন্দর্যের চর্চাই করেননি, জড়িত থেকেছেন নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডেও। একটা সুইডিশ এনজিও'র কোঅর্ডিনেটর হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র একুশ বছর বয়সেই। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের সামাজিক উন্নয়নে তিনি কয়েকবছর কাজ করেছেন এরই মাঝে।
মাত্র দুসপ্তাহের এতো স্বল্প সময়ে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ খুব একটা হয়ে উঠেনি শিমুল-চুমকি দম্পতির। অতঃপর দুই পরিবারের চাপাচাপিতে দ্রুতই শিমুল তাঁর স্ত্রী চুমকিকে কানাডায় নিয়ে এলেন। শুরুর কিছুদিন টরোন্টো শহরের কয়েক দর্শনীয় স্থানে ঘোরাফেরায় কেটে গেলো এ দম্পতির। পাশাপাশি পুরোনো বন্ধু অশেষ, জাবেদসহ পরিচিত বাঙালিদের বাসায়ও বেড়ানো হলো কয়েকদিন। সময়টা কাটছিলো ভালোই; তবে, দুজনের একান্ত মুহূর্তগুলোতে শিমুলের অস্বাভাবিক আচরণে চুমকি বেশ অবাকই হলেন।
মাস তিনেক এভাবে পার হবার পর তার এক বিবাহিত বন্ধু সাথী সেনগুপ্তার সাথে এ নিয়ে কথা বলেন চুমকি। সাথীর সাথে শৈশব হতেই তাঁর বন্ধুতা। দুজনই দুজনার অনেক ব্যক্তিগত বিষয় জানেন। ইন্টারমিডিয়েটে পড়া অবস্থায় সাথীর বিবাহ হয়েছিল। সঙ্গতকারণেই, সংসার ধর্মে তাঁর রয়েছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা।
- সাথী, তোকে একটা কথা বলবো, কারো সাথে শেয়ার করবি না বলে প্রমিজ কর।
- কেন, অতীতে তোর কোন কথা কাউকে বলে দিয়ে তোকে বিপদে ফেলেছি নাকি? প্রমিজ করতে হবে কেন, যা বলার খুলে বল।
- ওই যে, ডঃ শিমুল, মানে, তোর দুলাভাইয়ের কথা বলছিলাম।
- কেন, কি হলো রে? তুই তো খুব লাকি, শিমুল ভাই যেমন ব্রিলিয়ান্ট দেখতেও তেমন হ্যান্ডসাম। দেশে যেমন সফল মানুষ ছিলেন, বিদেশেও তেমনই সাকসেসফুল। কি, তাঁর উপর আর কারো নজর পড়েছে নাকি?
- না, তেমন কিছু না, ওরকম সমস্যা নেই।
- তবে কি? চটজলদি বলে ফেল।
- ও না একটু কেমন।
- কেমন মানে?
- মানে ..., ঘনিষ্ঠ হতে চায়না।
- আরে, ওটা কোন ব্যাপার না, আমাদেরও তো ঘনিষ্ঠ হতে টানা একমাস লেগে গেছে। তোর দুলাভাই তো আমার ঠোঁটে ঠোঁট মেলাতেই তিনদিন ফেলেছে। আমি তো জোর করে তাঁকে দিয়ে প্রথম আমার বুক স্পর্শ করিয়েছি। ... শিমুল ভাই বেশি পড়াশোনা জানা আঁতেল মানুষ তো, মাথায় হয়তো নানাপদের বুদ্ধি কিলবিল করে। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। খামাখাই দুশ্চিন্তা করছিস।
- কিন্তু, আমাদের যে সময়টা একটু বেশিই লাগছে। কানাডা এসেছি চারমাসে পড়লো তো।
- বলিস কি? চারমাসেও ...!
- না, একবারও না।
- যা, কি বলছিস?
- সত্যি।
- তুই কি নিজে থেকে চেষ্টা করেছিস? পুরুষদের জাগাতে হয়, সবাই একরকম না, অনেকে খুব ইন্ট্রোভার্ট। তেমন হলে তোকে কিন্তু এগ্রেসিভলি চেষ্টা চালাতে হবে।
- দেখি।
- তাতেও কাজ না হলে ডাক্তারের সাথে কথা বল। আর দেরি করা ঠিক হবে না। চারমাস তো মেলা সময়রে !
আরো সপ্তাহ দুয়েক অপেক্ষা করে চুমকি এক রাতে নিজে থেকেই শিমুলের কাছে নিজেকে মেলে ধরেন।
চুমকি আজ নির্লজ্জ্ব, বেহায়া, তাঁর যা কিছু আছে সব বিলিয়ে দিয়ে শিমুলকে জাগিয়ে তোলাই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। তিনি চান, শিমুল আজ তাঁকে দুমড়ে-মোচড়ে একাকার, আর, বুকে চেপে চূর্ণবিচূর্ণ করুক। নিজের ব্লাউজ নিজেই খোলেন চুমকি, বক্ষবন্ধনী খুলে বাথরুমের দরোজার দিকে ছুঁড়ে মারেন, দুধে আলতা স্তন্যচূড়ায় ঘষতে থাকেন শিমুলের মুখ-বুক, ভেজা চুমুতে ভাসিয়ে দেন শিমুলের লোমশ প্রশস্থ বুক।
প্রথমটায় শিমুল অনাঘ্রাতা রমণীর মতো গুটিসুটি মেরে থাকলেও একসময় চুমকিকে বুকে টেনে নেন। অর্ধ উলঙ্গ চুমকির শাড়ির বাকি অংশ খুলে তাঁর খাঁজকাটা তুলতুলে দেহ বাহুডোরে বন্দী করেন শিমুল। জানালায় ঝুলানো ভেলভেটের পুরু পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইর হতে ছুটে আসা নিয়ন লাইটের আলোয় তখন বিজলি চমকাচ্ছিল চুমকির দেহে। তখন চুমকিকে আক্ষরিক অর্থেই চুমকির মতো লাগছিলো। মিলনের আকাঙ্খায় থরথর কাঁপছিলেন তিনি। শিমুলও এগিয়ে এলেন। তবে, শিমুল যে পন্থায় সম্পর্ক গড়তে চাইছেন তা স্বাভাবিক নয়। চরম মুহূর্তে অনিচ্ছাসত্ত্বেও চুমকি তাতে রাজি হন। এভাবে মেলামেশা ভীষণ কষ্টের ঠেকে চুমকির কাছে। তিনি আহত, রক্তাক্ত হন। তারপরও স্বামীর পছন্দ মেনে নিজেকে মানিয়ে নিতে প্রানপন চেষ্টা চালান চুমকি।
এভাবেই চলতে থাকে দুজনের ঘনিষ্ঠ সময়গুলো। বারবার অনুরোধ করেও চুমকি কোনভাবেই শিমুলকে নারীপুরুষের স্বাভাবিক মেলামেশায় রাজি করাতে পারেননি। ফলে, শারীরিক-মানসিক অতৃপ্তি, লোকলজ্জার ভয়, সামাজিক চাপ, ইত্যাদি নানা ভাবনা ক্রমশ চুমকিকে গ্রাস করতে থাকে। একইসাথে, এ দাম্পত্য সম্পর্কের গন্তব্য কোথায় তা ভেবেও তিনি অস্থির হন। এভাবেই পার হতে থাকে অনিশ্চিত যুগল জীবন।
টরন্টো শহরের যে বহুতল ভবনে এ দম্পতি বসবাস করেন সেটি ভিকটোরিয়া পার্ক সাবওয়ে স্টেশনের অনতিদূরে। ভবনের চৌদ্দ তলা হতে নিচে হেটে চলা মানুষগুলো খানিক খর্বাকৃতি দেখালেও তাদের মুখমন্ডল পরিষ্কার দেখা যায়। সাতসকালে কর্মব্যস্ত মানুষের আনাগোনায় প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠে এ এলাকা। এক প্রত্যুষে ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে রাখা চেয়ারজোড়ার একটিতে বসে ভবনের নিচে সরু রাস্তায় কর্মব্যস্ত মানুষের আনাগোনা দেখছিলেন চুমকি। চোখ পড়ে পাশের ভবনের সপ্তম তলার বাসিন্দা তৃষ্ণা ভাবীর দিকে।
তৃষ্ণাদের দুই সন্তান। এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেটি অটিজমে আক্রান্ত; বয়স দশ কি এগারো। তাকে প্রতিদিন স্পেশাল নীড স্কুলে নিতে হয়। দুই সন্তানকে নিয়ে সেই তৃষ্ণাও সাবওয়ে স্টেশনের দিকে দৌঁড়াচ্ছেন। সুন্দরী প্রতিযোগিতায় জেতার আগে চুমকি অটিস্টিক বাচ্চাদের স্কুলে পড়াতেন বাংলাদেশে। তাই তাঁর বেশ জানা অটিজমে আক্রান্ত বাচ্চাদের দেখভাল কি করে করতে হয়। তৃষ্ণাদের দিকে চোখ থাকলেও ক্ষনিকের জন্য চুমকি নিজেকে তাঁর স্কুলের বাচ্চাদের মিষ্টিমধুর স্মৃতিতে হারিয়ে ফেলেন। তাঁর মানসপটে ভেসে উঠে অটিজমে আক্রান্ত অনেকগুলো নিষ্পাপ শিশুমুখ।
এরই মাঝে দুকাপ চা নিয়ে কাঁপো হাতে শিমুল এসে হাজির।
- কী, একা বসে আছো যে?
- ঘুম ভেঙে গেলো খুব ভোরে; আর ঘুম আসছিলো না। তাই তোমাকে ডিস্টার্ব না করে এখানে চলে এলাম। তুমি কখন বিছানা ছেড়েছো?
- আমি তো তুমি উঠার খানিক পরই উঠে পড়ি। আমারও ঘুম আসছিলো না।
- ঠিক আছে, বসো।
দুজনই নিচে তাকিয়ে কর্মব্যস্ত মানুষের আনাগোনা দেখছেন। এরই মাঝে চুমকি প্রশ্ন ছুড়ে দেন শিমুলের উদ্দেশ্যে।
- আচ্ছা শিমুল, আমাদের বিয়ের আগে তোমার কি কোন মেয়েকে ভালো লেগেছে কখনো?
- হঠাৎ এ প্রশ্ন?
- না, জানতে চাইছি, তোমার কি বলতে আপত্তি আছে?
- আপত্তি থাকবে কেন? সত্যি বলতে কি, দুটো মেয়ে আমাকে কাছে পেতে চেয়েছিলো, কিন্তু ...
- থামলে কেন? ভালো ছাত্র, তাই তুমি পাত্তা দাওনি, তাইতো?
- তা না, পাত্তা না দেবার কি আছে? ওরা খুব ভালো মেয়ে।
- আমার চেয়েও?
- আরে পাগল, তুলনা করছো কেন? প্রতিটি মেয়েই তো যারযার মতো সুন্দর।
- তাহলে তুমি জড়ালে না কেন?
- আমি আসলে ...
- বলে ফেল, থামলে কেন?
- অনেস্টলি, আমি তাদের প্রতি বন্ধুতার বাইরে অন্যরকম কোন আকর্ষণবোধ করিনি কখনো। বলতে পারো, সম্পর্কে জড়ানোর চিন্তা মাথায় আসে নি।
- তার মানে মেয়েদের প্রতি কি তুমি কোন আকর্ষণ বোধ করো না?
- না না, তা বুঝাইনি। তেমন হলে তোমার সাথে এতগুলো দিন একসাথে কাটালাম কি করে?
- শিমুল, আমার সাথে তোমার প্রায় ছয়মাস হতে চলেছে। তুমি যেভাবে আমার সাথে দিন কাটাচ্ছো তাকে কি আসলে দিন কাটানো বলা চলে? বিবাহিত দম্পতির জীবন কি এভাবে কাটে? চলো, তোমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো।
- ডাক্তার কেন? আমি অসুস্থ নাকি?
- আগে যাই, পরে বুঝবে কেন নিয়ে গেলাম?
- বলো না, কেন ডাক্তারের কাছে নিতে চাইছো? ডাক্তারের এখানে করার কি আছে?
- ডাক্তার কি করবে মানে? ডাক্তার তোমাকে তোমার স্ত্রীর সাথে কিভাবে ঘনিষ্ঠ হতে হয় তা শিখিয়ে দেবে, প্রয়োজনে ওষুধও দেবে। ছ মাসেও তুমি আমার সাথে ঠিকমতো মেলামেশা করতে পারলে না, এটা কি এড়িয়ে যাবার বিষয়?
- কেন? করলাম তো; গতরাতেও তো আমাদের ইয়ে হলো।
- আমাদের নয়, বলো, তোমার মেলামেশা হয়েছে। এভাবে আমি আর পারছি না। তুমি যেভাবে মেলামেশা করছো তা স্বাভাবিক নয়। না না, এভাবে হয়না, আমি ভীষণ কষ্ট পাই। তোমাকে স্বাভাবিক ধারায় ফিরে আসতে হবে শিমুল। আমি আর এসব সহ্য করতে পারছি না। ডাক্তার নিশ্চয়ই একটা উপায় বাতলে দেবেন। - -
চুমকির পীড়াপীড়িতে অবশেষে ডাক্তারের কাছে যেতে রাজি হলেন শিমুল। বিস্তারিত শুনে ডাক্তার মুখ গম্ভীর করলেন। তিনি পরিষ্কার বুঝলেন, শিমুলের সেক্সচুয়াল ওরিয়েন্টেশন অন্যসব পুরুষের মতো নয়; তিনি একজন পায়ুকামী, বা সডোমিস্ট, যা কোন ওষুধে সংশোধিত হবার নয়। প্রকৃতিগতভাবেই তিনি তেমন; ডাক্তারের খুব কিছু করার নেই এ অবস্থায়। তারপরও, বিদায় জানাবার আগে পায়ুকামের বিশেষ ঝুঁকি ও স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে কিছু মেডিক্যাল পরামর্শ দিলেন ডাক্তার।
চিকিৎসকের পরামর্শ শুনে চুমকি চোখে সর্ষে ফুল দেখছিলেন। অতৃপ্তি, অক্ষমতা, লোকলজ্জা, জগদ্দল পাথর হয়ে দাঁড়ালো চুমকির সামনে। মা-বাবা বা পরিবারের কারো সাথে এমন বিব্রতকর গোপন বিষয়ে আলাপও অসম্ভব। তবে কি বান্ধবী সাথীকে তিনি সব খুলে বলবেন? তাঁর কাছে চাইবেন সমাধান? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করেন চুমকি।
আবার ভাবলেন, ডাক্তার যেখানে না করে দিয়েছেন সেখানে সাথী আর কি করবে? তবে কি শিমুলকে বুঝিয়ে সুজিয়ে স্বাভাবিক সম্পর্কে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাতেই থাকবেন, একদিন যদি কিছু হয়? বুঝানোর চেষ্টা হয়তো করা যায়, কিন্তু তাতে কাজ হবার সম্ভাবনা যে তেমন নেই। জোর করে তো মানুষের সেক্সচ্যুয়াল ওরিয়েন্টেশন পরিবর্তন করা যায় না। তেমন কিছু সম্ভব হলে ডাক্তার নিশ্চয়ই একটা পথ দেখিয়ে দিতেন।
যৌন জীবনে স্বামীর এ অস্বাভাবিক আচরণ চুমকির কাছে কানাডার চাকচিক্য, রংচঙা জীবন, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, সবই ম্লান করে দিয়েছে। এই কানাডা জীবনের চেয়ে বনজঙ্গলে সন্ন্যাসিনীর জীবন অনেক ভালো, এমনই চিন্তাই তাঁর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে আজকাল। পাশাপাশি, পুরুষজাতির প্রতি কেমন এক ঘেন্নাবোধও পুঞ্জীভূত হলো তাঁর মনে।
অবশেষে চুমকি একদিন হঠাৎই ফিরে এলেন দেশে। তার আকস্মিক কানাডা ত্যাগে সাথীসহ অন্য বন্ধুরাও বিস্মিত হলেন; পরিবারের কৌতূহলী প্রশ্নেরও মুখোমুখি হলেন তিনি। তাঁর হৃদয়ের একান্ত গভীরে লুকিয়ে থাকা নির্জলা সত্য, ধর্মীয় সংস্কার, লজ্জাবোধ আর সামাজিকতার বেড়াজালে আলোর মুখ দেখেনি কোনদিন।
সুন্দরী প্রতিযোগিতার জয়লাভের পরপরই চুমকি বাংলাদেশে নামিদামি মডেল হয়ে উঠেছিলেন। মাত্র দুবছরেই তাঁর পরিচিতি হয় আকাশচুম্বী। নাটক সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাবও পেতে থাকেন সমানে। বিজ্ঞাপনের আয় তো ছিলই, তাছাড়া ব্র্যান্ড এম্বেসেডারও হয়েছিলেন এক কোম্পানির। নিজদেশের এমন ফকফকা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পেছনে ফেলে মেধাবী কানাডা প্রবাসীর জীবনসঙ্গিনী হতে পাড়ি জমিয়েছিলেন স্বপ্নের দেশে। অথচ, জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁর স্বপ্নগুলো চুরমার করে দেয় দ্রুতই। কারো কারো কাছে জীবন এমনই নিস্পন্দ, নিষ্ঠুর।
এমন অনাকাঙ্খিত অভিজ্ঞতার পরও দমে যাবার পাত্রী নন চুমকি। তবে, পুরুষ মানুষ সম্পর্কে তাঁর যে অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা হয়েছে তা তাঁকে পুরোদমে পুরুষবিমুখ করে তুলেছে। শিমুলকে তিনি ডিভোর্স দেননি কোনদিন, শিমুলও তা আগ বাড়িয়ে চাননি। তবে, কেবল নামেই তাঁরা আজও স্বামী-স্ত্রী। শিমুল মাঝে মাঝে দেশে এলে চুমকির সাথে কিছু সময় কাটিয়ে যান, তবে চুমকি কখনো তাঁর সাথে শারীরিক মেলামেশায় আগ্রহ দেখাননা। শিমুলও তা এড়িয়ে যান বোধগোম্যকারণেই। কানাডায় ফিরে না যাবার চুমকির যে সিদ্ধান্ত তাও শিমুল মেনে নেন।
দেশে ফেরার পর আর মিডিয়ার মুখোমুখিও হননি চুমকি। বলা চলে, মিডিয়ার লোকজনকে এড়িয়েই চলেছেন পাছে তাঁর কানাডা জীবন, বিবাহ, স্বামী-সংসার ইত্যাদি অপ্রিয় প্রসঙ্গ আলোচনায় চলে আসে সে ভয়ে, সে লজ্জায়। কিছুদিন এভাবে কাটিয়ে ধাতস্থ হয়ে আগের সেই স্কুলে শিক্ষকতায় যোগ দেন চুমকি। স্পেশাল নীড বা, বিশেষ চাহিদার শিশু কিশোরদের দেখভালেই সময় কাটে তাঁর। ওরাই তাঁর পরমাত্মীয়, পরিবার বা স্বজন। আর, কানাডার কথা মনে হতেই তাঁর চোখে ভেসে উঠে তৃষ্ণা ভাবীর সেই অটিস্টিক ছেলেটিকে, যার হাত ধরে তিনি ভোরের আলো-আঁধারিতে দ্রুতলয়ে টরোন্টোর ভিকটোরিয়া পার্ক সাবওয়ে স্টেশন অভিমুখে হাঁটছিলেন।
লেখক: এম এল গনি
পেশা: কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট (RCIC-IRB)
ইমেইল: info@mlgimmigration.com