আজ ১২ ডিসেম্বর। একাত্তরের এই দিনে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে আরও বহু বিজয়ের আখ্যান লেখা হয় ইতিহাসের পাতায়। চারদিকে বহু মৃত্যু আর ধ্বংসযজ্ঞকে অশ্রুতে আলিঙ্গন করে স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয়ের সূর্যোদয়ের যখন অপেক্ষা তখন এক অন্য নারকীয়কতায় মেতে উঠে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দেশি-বিদেশি দোসররা। ইতিহাসে ব্রাত্য থাকা অনেক নির্মম সত্যই ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে আসে। চাপা থাকেনি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে হওয়া মার্কিন ষড়যন্ত্রও।
আমরা জেনেছি, স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ ‘মুজিব হত্যায় সিআইর রক্তাক্ত হাত’ শীর্ষক খবর। কিন্তু ইতিহাস আমাদের এও জানাচ্ছে যে, একাত্তরের রণাঙ্গনে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে ঠেকাতে কি নারকীয় প্রচেষ্টাই না চালিয়েছিল হানাদারদের দোসর যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও তাদের সংস্থাগুলো।
১০ জানুয়ারি ১৯৭২। কলকাতার খ্যাতনামা দৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মুহুর্তের খবর যারা পরম মমতায় প্রকাশ করে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিল সেই যুগান্তর প্রকাশ করে চাঞ্চল্যকর এক খবর। রুশ কমিউনিষ্ট পার্টির মুখপত্র ‘প্রাভদা’র বরাত দিয়ে দৈনিকটি জানায় ভারতের নাগা বিদ্রোহ ও ঢাকায় ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পেছনেও মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা ‘সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি বা সিআইএ’র সম্পৃক্ত থাকার প্রামাণ্য তথ্য।
পিটিআই’র বরাতে ‘যুগান্তর’ সাড়া জাগানো সেই প্রতিবেদনে জানায়, ‘‘নাগা বিদ্রোহে উষ্কানি দান এবং পূর্ববঙ্গে পাক সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পূর্বে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যার তালিকা প্রণয়নের পিছনে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিয়া বা সিআইএ) হাত ছিল। সোভিয়েট কম্যুনিষ্ট পার্টির মুখপত্র ‘প্রাভদা’য় আজ এক চাঞ্চল্যকর খবর বেরিয়েছে।’’
প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্ট তথ্যসূত্র উল্লেখ করে জানায়, ‘‘প্রাভদার ঢাকাস্থ সাংবাদিক মিঃ আইভান শেদ্রফ লিখেছেনঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিমানে করে গোপনে নাগাভূমির অভ্যন্তরে অস্ত্রশস্ত্র ও সমর সম্ভার পাঠিয়েছিল। মিঃ শেদ্রফ ঐ খবর প্রাভদায় ‘গোপন তথ্য ফাঁস’ শিরোনামায় প্রকাশিত হয়। ঐ খবরে প্রকাশ, ১৯৬৬ সালে নাগা বিদ্রোহীরা চীনে গিয়ে হাজির হয় এবং সেখানে তারা সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।’’
যুগান্তর আরও জানায়, ‘‘চীনে যাবার আগে বিদ্রোহী নাগা বাহিনীর জেনারেল থিনুসেলী পাক সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র পাবার আশায় পূর্ববঙ্গ সফরে যায়। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে নাগা বাহিনীর ছোট ছোট দল চীনে গিয়ে সামরিক সামরিক প্রশিক্ষণও গ্রহণ করে। চীন থেকে জেনারেল থিনুসেলির লোকজনদের ভারতে পাঠানো হয়। কিন্তু ভারতবাসীদের কাছ থেকে কোনরূপ সমর্থন না পেয়ে এরা জঙ্গলের মধ্যে আত্মগোপন করে এবং এরে দলকে পুনর্বিন্যাসের উদ্দেশ্যে এরা প্রতিবেশি রাষ্ট্র পূর্ববঙ্গে গিয়ে হাজির হয়’’
বাঙালি জাতিকে চূড়ান্তভাবে মেধাশূন্য করার নীলনকশা যে মার্কিন প্রসূত, সেই সুস্পষ্ট প্রামাণ্য সূত্র উল্লেখ করে দৈনিকটি জানায়, ‘‘গত মাসে বাংলাদেশে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে তথাকথিত নাগা বাহিনীর চার জন্য নেতাকে গ্রেপ্তারের খবরও প্রাভদা’য় প্রকাশ করা হয়েছে’’
‘‘বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার তালিকা প্রণয়নে ‘সিয়া’র হাত সম্পর্কে প্রাভদায় ঐ সাংবাদিক বলেছেন, ঢাকা পাক সেনাবাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার লেঃ জেনারেল ফরমান আলীর বাসভবন থেকে যে সব গোপন কাগজপত্র পাওয়া গেছে, তা থেকে ঐ খবরের সত্যতা প্রমাণিত হয়। ঐ সমস্ত গোপন কাগজপত্র থেকে ‘হোয়াইট’ ও ‘ডেট্রিক’ নামে সিয়ার দুজন চরের নাম পাওয়া গেছে’’
নীলনকশা প্রণয়নে যুক্ত সেই দুই মার্কিন চরের থাইল্যান্ডে পালিয়ে যাওয়ার খবরও নিশ্চিত করে দৈনিকটি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘‘ঢাকাসহ বহু দেশে গিয়ে এরা দীর্ঘদিন ধরে বিশেষ ধরণের দায়িত্ব পালন করতো। ঢাকা সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত খবরে জানা যায় যে, এরা দুই জন পরে ব্যাংককে পালিয়ে যায়।’’
লেখক: বার্তা২৪.কম এর পরিকল্পনা সম্পাদক ও ইতিহাস গবেষক।
গবেষণা ও অনুসন্ধানে ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।