১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ কেবল বাংলাদেশের জন্যই নয়, সারা বিশ্বের জন্যই এক ঐতিহাসিক ঘটনা। বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি ও ইতিহাসের ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ অতীব গুরুত্বপূর্ণ মাইল ফলক এবং জাতীয় জীবনের সবচেয়ে মহত্তম অর্জনে সিক্ত অধ্যায়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক ভিত্তি রচিত হয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এবং জাতির আশা ও স্বপ্নের ক্ষেত্রটিও রয়েছে একাত্তরের রক্তাক্ত রণাক্ষণের পবিত্র অঙ্গনে। ফলে একাত্তর ইতিহাসের অংশ হয়েও বাংলাদেশের এক চলমান বাস্তবতা।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার দিকটি উপেক্ষিত না হলেও অপর্যাপ্ত। ভারতীয় বা পাকিস্তানি সামরিক অফিসাররা নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ ও অভিজ্ঞতার আলোকে যত স্মৃতিচারণ করেছেন, নৈব্যক্তিক গবেষণা তত হয় নি। তদুপরি, ভারতীয় ও পাকিস্তানি লেখকদের রচনাগুলো তাদের স্ব স্ব অবস্থানকে সামনে রেখে রচিত। ফলে স্বাভাবিক কারণেই সেসব লেখায় সামগ্রিক চিত্র উদ্ভাসিত হওয়ার সুযোগ পায় নি। স্থান পেয়েছে তাদের নিজস্ব দৃষ্টভঙ্গি ও মূল্যায়ন।
ফলে সেসব লেখায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাদের নিজ দেশ ও মানুষের উপস্থিতি যত বেশি, বাংলাদেশের উপস্থিতি তত কম। এজন্য বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট থেকে এবং বাঙালির দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে মুক্তিযুদ্ধকে সমীক্ষা করা এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যায়তনিক দায়িত্ব। বিশেষত, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এবং সামরিক-বেসামরিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এ জাতির জীবনে যে অমূল্য আর্থ-সামাজি-রাজনৈতিক অবদান রেখে বাঙালির জাতিরাষ্ট্র বিনির্মাণ করেছে, তা জাতির ভবিষ্যত পথচলার স্বার্থে জানা ও অনুধাবণ করা অপরিহার্য।
বর্তমানে স্ট্র্যাটেজিক সায়েন্স, পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজ, সোসাল চেঞ্জ অ্যান্ড পিপলস মুভমেন্ট বুঝতেও দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান যে রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক ঘটনাটি বিশ্বের সামনে এসে দাঁড়ায়, তা হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। অতএব, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা ও চর্চা একটি অনিঃশেষ তৎপরতার নাম।
বাংলাদেশ থেকে, বাংলাদেশের স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দিয়ে রচিত তেমন আকর্ষক মেধার বুদ্ধিবৃত্তিক গবেষণা গ্রন্থের অভাব আমরা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ পাঠ দানকালে অনুভব করি। কিন্তু অপ্রতুল গ্রন্থের মধ্যে কোনো কোনোটি ঊষর মরুভূমিতে তৃপ্তিদায়ক মরুদ্যানের মতো আশার সঞ্চার করে। মেজর জেনারেল মোঃ সরোয়ার হোসেন রচিত ইংরেজিতে গবেষণামূলক তেমনি একটি বই, যা '১৯৭১: প্রতিরোধ সংগ্রাম বিজয়' শিরোনামে বাংলা ভাষায়ও প্রকাশ পেতে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা, বিশিষ্ট পণ্ডিত, প্রফেসর ড. গওহর রিজভী বইটি সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, তাতে এর উচ্চতর একাডেমিক মর্যাদা স্পষ্ট হয়। বইটিকে 'নিখুঁত গবেষণা' এবং 'বাংলাদেশীর দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য ইতিহাসের প্রথম প্রয়াস বা প্রকাশনা' হিসাবে অভিসিক্ত করা হয়েছে বিষয়বস্তুর গভীরতা ও বহুমাত্রিকতার কারণে।
মেজর জেনারেল (ড.) সরোয়ার একজন নেতৃস্থানীয় সামরিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে ইতিহাস বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের সুবাদে তার গ্রন্থে নিবিড়ভাবে গবেষণার উজ্জ্বল প্রমাণ রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত দিক ছাড়াও তিনি যুদ্ধে বাংলাদেশ বাহিনির গঠন, ভূমিকা, কার্যক্রম সবিস্তারে তুলে এনেছেন। চূড়ান্ত বিজয়ে বাংলাদেশ বাহিনির অবদান এবং যুদ্ধ ও বিজয়ের শিক্ষাকে তিনি চমৎকারভাবে সুগ্রন্থিত করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতি এই গ্রন্থ থেকে পাবে ঐতিহাসিক তথ্য ও শিক্ষা। আর মুক্তিযুদ্ধের পথে বাংলাদেশকে গতিশীলভাবে পরিচালিত করার প্রণোদনা ও প্রেরণার অন্যতম উৎসস্থল হয়ে কাজ করবে বইটি। ফলে গবেষণা মূল্যের পাশাপাশি বইটির রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, কৌশলগত, ভূরাজনৈতিক ও সামরিক পরিকল্পনা এবং প্রয়োগগত মূল্য, মর্যাদা ও তাৎপর্য অপরিসীম।
বাংলাদেশের চাঁদপুরের এই কৃতি সন্তান বর্তমানে বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব পদে কর্মরত। তার সামরিক ও একাডেমিক প্রশিক্ষণের বর্ণাঢ্য অভিজ্ঞতার সুস্পষ্ট ছাপ '১৯৭১: প্রতিরোধ সংগ্রাম বিজয়' গ্রন্থে পরিলক্ষিত হয়েছে, যা গ্রন্থটিকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণার ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত করেছে।