রেলগাড়ি তথা ট্রেন উচ্চারণেই জীবন গতিময়তার সাক্ষী হতে থাকে। রেলগাড়ি এমন এক যান্ত্রিক সভ্যতার জন্ম দিয়েছে যা কখন যে আমাদের অজান্তেই আমাদের সভ্যতা ও শিল্পের আত্মীয় হয়ে গেছে তা আমরাই বুঝিনি। সাহিত্যে-সিনেমায় রেলগাড়ি কী যে এক অভিনব অনুভূতিকে ধরে রাখে তা বলে বোঝানো যায় না । বিভিন্ন রোমাঞ্চকর ভূতের গল্পের ক্ষেত্র তৈরি করতে ট্রেনের বিকল্প খুঁজে পাওয়া মুশকিল। টেনিদার লেখায় কী তীব্র ভাবে এসেছে ট্রেন, বিখ্যাত নায়ক সিনেমার দৃশ্য, রেল নিয়ে অপু দূর্গার সেই অপার বিস্ময়, বিখ্যাত হলিউড ছবি বিফোর সানরাইজ এমন কত কত দৃশ্য রেলগাড়ির আপ্যায়নে, মুহূর্তে রাজকীয় হয়ে গেছে তার প্রায় হিসেব নেই।
রেলগাড়ি আসলে এক জীবনের ছোট বিকল্প গতির চিহ্ন, ক্রমাগত গতিশীল মাঝে মাঝে কিছু বিরতি। পৃথিবীর জনজীবনে রেল বা ট্রেন যেহেতু মাটি সংলগ্ন দীর্ঘসূত্রকে ধরে রাখে তাই রেল সত্যি জীবনের ধারক মনে হয় কখনো কখনো, প্লেনে, নৌকায়, বাসে, ট্যাক্সিতে সেই সম্পর্ক সেই অনুভূতি, সেই আত্মীয়তা খুব সহজ নয় যা কিনা ট্রেনে সুলভ। গাছ-গাছালি, অপূর্ব প্রকৃতিকে পেছনে রেখে সে চলে যায় , কী তার জীবনমুখী আত্মময়তায় পূর্ণ অঙ্গীকারের মতো গতি। যারা দূরপাল্লার এক্সপ্রেস ট্রেনে ভ্রমণ করেন তারা নিশ্চয় অনুভব করেন মাটির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্র তৈরির কথা। বিদেশে এই ট্রেনকে মানুষের জীবনে আরো কাছাকাছি তুলে ধরা হয়েছে তথা যারা বৈভবশালী তারাও যেন রেলগাড়ি ভুলে না যায়। ভাবতে অবাক লাগে একটি চলন্ত যানকে কী অপূর্ব নির্মাণশৈলীর মাধুর্যে ভরিয়ে রেখেছেন এরা। ১৯৩৮ সালে শিকাগো শহর থেকে লস অ্যাঞ্জেলস অবধি এক ট্রেনের আগমন হয় যার নাম “সুপারচিফ লং ডিসট্যান্স ট্রেন। এই ট্রেনের বিশাল দূরত্ব অতিক্রমের ক্ষমতা ও সুস্বাদু খাবারের আকর্ষণে শোনা যায় হলিউড তারকারাও এই সফরে সামিল হন। বিলাসবহুল রেলের এরকম উদাহরণ পেয়ে চমকে যেতে হয়।১৯২৩ সালে আগমন হয় এরকমই আরো এক বিলাসবহুল ট্রেনের যার নাম “ দ্য ব্লু ট্রেন” এই ট্রেনের গতি যদিও খুব ধীর কিন্তু সেই ধীর গতি পর্যটকের কাম্য কারণ প্রকৃতির উজাড় করা রূপের বাহার... দক্ষিণ আফ্রিকার এই ট্রেনে রয়েছে সুদৃশ্য স্নানঘর, লাক্সারি স্যুট, লাউঞ্জ। এরপর আসা যাক “ দ্য ফ্লায়িং রয়্যাল স্কটসম্যান ট্রেনটির কথায়” স্কটল্যান্ডের ট্যুরিজম এই ট্রেনে ঘোরার পরামর্শ দেয়। সম্পূর্ণ স্কটল্যান্ড –এর সংস্কৃতিকে বোঝার দারুণ উপায় এই ট্রেন। তবে যাত্রীর সংখ্যা নিতান্তই কম।ট্রেনে ওঠার সময় রেড কার্পেটে পা রেখে আপনাকে উঠতে হবে। অভ্যর্থনা জানাবে স্কটিশরা তাদের নিজস্ব সঙ্গীত গেয়ে।ট্রেন তো নয় যেন ভেতরে গোটা একটা শহরসমেত যাত্রীরা চলেছেন।সাতদিন ধরে চলা এই ট্রেনে বার, রেস্টুরেন্ট, পার্লার, অপূর্ব সব স্কটল্যান্ডের খাবার কী নেই! ১৮৮৩ সালে প্রস্তুত করা “ভেনিস সিম্পলন-দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস” এক অন্যতম বিলাসবহুল ট্রেন ; পৃথিবীবিখ্যাত ডিজাইনার রেনে লালিক এর নির্মাণশৈলীর শিল্পী। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ্ড্রেসকোড পরিধান করে পার্টি করা, এখানে খাদ্য পরিবেশিত হয় কেবল চিনেমাটি ও রূপোর পাত্রে। ইউরোপ থেকে রোমানিয়া যাওয়ার এই ট্রেনে উঠলে আপনার সারাজীবনের স্মৃতি হয়ে যেতে পারে এই সফর।
এইসব তো গেল সুখের গল্প বহনকারী যাত্রার গল্প কিন্তু ভয়ানক বিপজ্জনক যেসব রেলপথ ছাড়া মানুষের চলে না তা শুনলে হাড় হিম হয়ে যেতে পারে। কী বিপদসঙ্কুল সেসব পথে রেলগাড়ি যাত্রীদের নিয়ে যাতায়াত করে তা জানলে চমকে উঠতে হয়। অস্ট্রেলিয়ার কুরান্দা রেলওয়েকে বিশ্বের ভয়ঙ্করতম রেলপথ ভাবা হয়।এটি বানাতে গিয়ে বহু মানুষের প্রাণ যায়। সুইজারল্যান্ডের বারনিনা ও অ্যালবুলা রেলওয়ে যা বর্তমানে ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেলেও এর পথ বেশ দুর্গম। ট্রেনে উঠছেন না রোলার কোস্টার রাইডে ফারাক বোঝা মুশকিল যদি জেলমারবান ফুনিকুলার এই ট্রেনটিতে ওঠেন। বিশ্বের দ্বিতীয় সরুতম এই রেলপথে চড়লে আপনার শিহরণ জাগবেই।কিংঘাই ও তিব্বতকে সংযুক্ত করে যে রেলওয়ে রয়েছে চীনে তাও ভয়ঙ্কর দুর্গম।ভারতে পাম্বান সেতু যা চেন্নাই থেকে যাত্রা করে, ঘূর্ণিঝড়পূর্ণ সমুদ্রের ওপর দিয়ে এই ট্রেন যাত্রা করে ৬৭৭৬ ফুট দৈর্ঘ্য অতিক্রম করে এই ট্রেন।
ভাবা যায় সেই উনিশ শতকে জর্জ স্টিফেনসন ইংল্যান্ডে প্রথম রেলওয়ে ্সৃষ্টি করেন। এর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, সুইডেন এবং ব্রিটিশ শাসনের দৌলতে ভারতেও রেলগাড়ি চলে আসে। অবিভক্ত ভারতে১৮৫৩ সালে মুম্বই তে প্রথম থানে অবধি রেললাইন প্রতিষ্ঠা পায়।এরপর হাওড়া থেকে হুগলীতে ১৮৫৪ সালে ব্রিটিশদের প্রচেষ্টায় রেলপথের প্রসার ঘটে।অবিভক্ত বাংলার বর্তমান বাংলাদেশের রেলপথও ব্রিটিশরাই চালু করেন; গঙ্গা নদীর ধার ধরে সুন্দরবন হয়ে ঢাকায় রেলপথ বানানোর কথা ভাবা হয়। তারা অবশ্য কলোনি স্থাপন করে নিজেদের ব্যবসায়িক কারণেই এই যোগাযোগকে উন্নত করেছিলেন কিন্তু যেভাবেই হোক এই পথ ধরেই রেলগাড়িতে চলার পথ শুরু হয়।বলা হয় ভারতের মোট রেললাইনগুলো যদি যোগ করা হয় তা দিয়ে ব্যাস মেপে পৃথিবীকে এক থেকে দেড়বার মোড়ানো যাবে। প্রথম রেলওয়েতে বাথরুম আসে ভারতীয় রেলপথ থেকেই। ভারতীয় ট্রেন চালক বা লোকো পাইলটদের কখনো কোনো দুর্ঘটনার জন্য চাকরি থেকে সরানো হয়নি
একদম শিশুবয়সের শুরুতে একটি বাচ্চার কাছে অপার কৌতূহল থাকে লাইন ধরে একটি লম্বা গাড়ির চলে যাওয়া , এই শিশুমনকে সম্ভবত যত্নের সঙ্গে চিনেছিলেন বিভূতিভূষণ ্তাই ঐ অপরূপ দৃশ্য ভুলতে পারি না যারা দেখেছি সেই চিত্রকে। একটি চলমান ট্রেন আসলে জীবনের অভিব্যাক্তিকেই শেখায়।আমাদের রেলযাত্রা জারি থাক, কারণ এখান থেকেই শিল্প, সম্পর্ক, প্রেম, সভ্যতা সব আলোকিত হতে থেকেছে।