১৯৬৭ সনে রমনার বটমূলে এই অনুষ্ঠানের সূচনা ছায়ানটকে বৃহত্তর জনসম্মূখে আনতে সাহায্য করেছে। এ কথা তো সত্যি রবীন্দ্রনাথ বাঙালি সংস্কৃতিকে হিমালয়ের মতো রক্ষা করে চলেছেন। রবীন্দ্রনাথ বরাবরই বলে এসেছেন যে রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করতে হলে এর ভেতরের শক্তিকে জাগ্রত করতে হবে সমাজে, সংস্কৃতিতে। তাই বাঙালির উৎসবগুলোর পুনরুজ্জীবনের পক্ষে ছিলেন তিনি। গ্রামীণ মেলাগুলো পরিচালনা করতে তিনিই বলেছেন।
এর ফলে বাঙালির সামাজিক বন্ধন পোক্ত হবে বলে তিনি মনে করতেন। সেই অভিপ্রায়েই ছায়ানট বাঙালির নিজস্ব ‘শুভ নববর্ষ’ উদযাপনের এই আয়োজনের সূত্রপাত করে। বলা যায় ছায়ানট রবীন্দ্রনাথের সেই জাগরণের অগ্রগামী এক প্রতিষ্ঠানের নাম। এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পেছনের ভাবনাটির কথা সনজীদা খাতুন এভাবে জানিয়েছেন, “আমরা এক সময় ‘শ্রোতার আসর’ নামে একটা অনুষ্ঠান করতাম। গান শুনিয়ে আমরা ‘অতীতচারী’ করতে চাইতাম। সেইসব গান বাঙালির বলে মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করতাম। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে দেখা গেল, আমাদের দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুবই কম। কারণ শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। তখন শুধুমাত্র ঐ বুলবুল একাডেমী ছিল। সেইজন্য আমরা একটা স্কুল করা দরকার বলে মনে করতাম। ... গান মানুষের জীবনে সংস্কৃতির বড় একটা ছাপ ফেলে।”
সেই ছায়ানট এখন এক মহিরূহে পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া জমিতে সকলের প্রচেষ্টায় এক কর্মচঞ্চল সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের নাম ছায়ানট। এর সঙ্গে সম্পূরক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাঙালির মননকে সিক্ত করে চলেছে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ। এই পরিষদের সাথে আমি গভীরভাবে যুক্ত। সারাদেশে রবীন্দ্রচর্চা ও রবীন্দ্রসংগীত প্রসারে আমরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছি।
এই সংস্কৃতিভবন উদ্বোধনের দিন প্রয়াত ওয়াহিদুল হক বলেছিলেন, “নগরের মানুষদের অসাম্প্রদায়িক করার আন্দোলনে ছায়ানট খানিকটা সফল হয়েছে। এবারে গ্রামের সাধারণ মানুষকেও শুদ্ধ সংস্কৃতির পরশ দিতে হবে। সকলকে সঙ্গে নিতে পারলে সম্পূর্ণ বাঙালি হওয়া যাবে।”
সুদীর্ঘ তিপ্পান্ন বছরে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। রমনা বটমূলের এই নববর্ষ উদ্যাপন এখন সারা দেশ এবং বাঙালি অধ্যুষিত বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। লক্ষ লক্ষ বাঙালি বাংলা নববর্ষে পথে নেমে পড়ে। নুতন জামা-কাপড় পড়ে এক উজ্জ্বল সকালে তাদের আনন্দঘন উপস্থিতি বাঙালির অস্তিত্বের জানান দেয়। পাশাপাশি চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশের এক অসাধরণ অগ্রযাত্রার প্রতীক বাঙালির এসব আয়োজন।
কিন্তু তা সত্ত্বেও সম্প্রতি ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে আমাদের আলোর পথযাত্রাকে পুরোনো সেই সাম্প্রদায়িক শক্তিসমূহ অন্ধকারাচ্ছন্ন করতে চাইছে। কোমলমতি তরুণদের বিভ্রান্ত করে ফেলতে চাইছে। অথচ সেই কতো আগে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “যে দেশে প্রধানত ধর্মের মিলেই মানুষকে মেলায়, অন্য কোন বাঁধনে তাকে বাঁধতে পারে না, সে দেশ হতভাগ্য। সে দেশ স্বয়ং ধর্মকে দিয়ে যে বিভেদ সৃষ্টি করে সেইটে সকলের চেয়ে সর্বনেশে বিভেদ। মানুষ বলেই মানুষের যে মুল্য সেইটেকেই সহজপ্রীতির সঙ্গে স্বীকার করাই প্রকৃত ধর্মবুদ্ধি।” (রবীন্দ্র রচনাবলী, দ্বাদশ খণ্ড, পৃ. ৬৬৬)। বড়ই দুর্ভাগ্য আমাদের পাঠক্রম নির্ণয়েও ধর্মীয় বিভেদ বিতর্ক আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনকে কুলষিত করে চলেছে।
এমন বিভেদকে ঠেকানোর একটা বড়ো উপায় হতে পারে সংগীত চর্চা। কেননা, সংগীতই পারে জীবনের অসামঞ্জস্যগুলোর অবসান ঘটিয়ে এক নয়া পারসপেকটিভ দিতে। সংগীত শিল্পের এই অসাধারণ ক্ষমতার কথা রবীন্দ্রনাথই তাঁর ছিন্নপত্রে বলে গেছেন ।
কিন্তু সংস্কৃতির এই সক্ষমতার কথা অনুদার বিভেদকামীরাও জানে। তাই তো এই বটমূলেই নিক্ষিপ্ত হয়েছিল মানবতা বিধ্বংসী বোমা। সংস্কৃতি প্রিয় কয়েকজনের প্রাণ যায় ওই বোমা হামলায়। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যাই আমিও। যেখানে বোমাটি পড়েছিল সেখানেই দাঁড়িছিলাম সস্ত্রীক আমি। তাড়া ছিল বলে মাত্র কয়েক মিনিট আগেই সেখান থেকে বের হয়েছিলাম আমরা। তবে উদার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আক্রমণ কিন্তু এখনও থামে নি।
প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে মানবতার শত্রুরা বড়ই সোচ্চার এই ক্ষণে। আর সে কারণেই মুক্তমনা মানুষের শক্তি সঞ্চয়ের উৎস হতে পারে বাঙালির পহেলা বৈশাখ উদযাপন। আশার কথা স্বদেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করা হচ্ছে বেশ জোরেসোরেই। এ বছর নিউইর্য়কের টাইমস্কোয়ারে সহ¯্র কণ্ঠে উচ্চারিত হতে যাচ্ছে পহেলা বৈশাখের গান। বাংলা নববর্ষের আয়োজন সারা বিশ্বেই এখন প্রবাসীদের মনে ফেলে আসা বাংলা মায়ের জন্য বিশেষ দরদ ও আকর্ষণ বাড়ায়। কায়মনে বাঙালি হবার, সম্পূর্ণ বাঙালি হবার অসাম্প্রদায়িক বাঙালি হবার বড়ো অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে বাংলা নববর্ষ।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক, রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধু গবেষক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।