তরুণ গল্পকার শফিক হাসানের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘প্রতিদিন একটি খুন’ এর তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে এবারের বইমেলাকে সামনে রেখে। ছোট বড় আটটি গল্পে সাড়ে পাঁচ ফর্মায় সাজানো হয়েছে বইটি। বয়সে তরুণ হলেও জীবনের অভিজ্ঞতায় শফিক হাসান ঋদ্ধ। সেই সাথে গল্প বলার ঢংয়েও পরিপক্ব। তার গল্পগুলো সে কথাই জানান দেয়।
‘প্রতিদিন একটি খুন’ গ্রন্থের গল্পগুলোতে আমাদের প্রতিদিনের রোজনামচা উঠে এসেছে একজন পরিণত পর্যবেক্ষকের নিপুণতায়। পর্যবেক্ষক বলেছি এ কারণে যে গল্পকার মাত্রই প্রথমে একজন পর্যবেক্ষক। কিন্তু সেই পর্যবেক্ষণটি কথা সাহিত্যের পাতায় পুনরুস্থাপনের মুনশিয়ানা সবার সমান থাকে না। শফিক হাসান নিঃসন্দেহে সেই মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। তার গল্পগুলোতে দেখা যায় সমাজ চিন্তা, মনোদৈহিক জটিলতার অভিজ্ঞান এবং আমাদের চারপাশের অনাচার অন্যায়ের বিরুদ্ধে দ্রোহের আকাঙ্ক্ষা। এ সব কথাচিত্র আঁকতে গিয়ে শফিক হাসান কখনো নিছক ধারা বর্ণনা, কখনো রূপক আবার কখনোবা পরাবাস্তবতার আশ্রয় নিয়েছেন। প্রতিটি গল্পেই তিনি কোন না কোন ম্যাসেজ দিতে চেয়েছেন। একজন গল্পকারের এখানেই বোধহয় সবচেয়ে বড় সার্থকতা। একটি গল্প পড়ে পাঠক যদি কোন চিন্তার খোরাকই না পান তাহলে তার সময়ের প্রতি সুবিচার করা হয় কি?
গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘শরীর’। একজন পড়ন্ত মধ্যাহ্নের বিধবার মনোদৈহিক জগতের যে টানাপোড়েন তার একটি চমৎকার চিত্রকল্প। কোথাও কোথাও গল্পের নায়ককে রায়প্রবণ (জাজমেন্টাল) মনে হলেও লেখক নিজেকে গল্পের নায়ক সত্ত্বা থেকে পৃথক করেছেন সফল ভাবে। সেখানে তিনি নৈর্ব্যক্তিক। তবে গল্পের প্রথম লাইনটি যথাযথ মনে হয়নি। ‘বৈধব্যের কী যন্ত্রণা – জানবেন বিধাতা আর বিধবার সন্তান!’ – কেবল তা’ই হতে যাবে কেন? বৈধব্যের যন্ত্রণা তো সবচেয়ে বেশি জানবেন বিধবা স্বয়ং। দেখা যায় নায়ক তার বিধবা মায়ের মনোদৈহিক পরিবর্তন লক্ষ করে একটি উভয় বলতার (এম্বিভ্যালেন্স) মধ্যে প্রবেশ করে। ‘মায়ের গুনগুনানি, উচ্ছল প্রজাপতি হয়ে উঠা দেখতে ভালো লাগে আবার ভালো লাগেও না’ – এই তার অভিব্যক্তি। আমাদের সমাজের রায়প্রবণতার বিপক্ষে গিয়ে লেখক একজন চল্লিশ বছরের বিধবা মহিলার মন এবং শরীরের কান্নাকে সহমর্মিতার দৃষ্টিতে দেখেছেন। আবার তা দেখতে গিয়ে আমাদের প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন – ‘লাবণ্য অনেক সময় পবিত্রতা বয়ে আনে। মায়ের তাই ঘটছে’। কিংবা ‘পাপপুণ্য নাকি আপেক্ষিক বিষয়’। ‘শরীর’ নিঃসন্দেহে এই গ্রন্থের শ্রেষ্ঠ গল্প। গল্পটি শেষ হয়েছে একটি অমীমাংসিত বাঁকে, একটি সার্থক গল্পে যেমনটি হবার কথা, ‘শেষ হইয়া হইল না শেষ’।
‘কালো পর্দায় নীল অন্ধকার’ আমাদের রূপালী পর্দার কদর্য কাহিনী। এ ধরনের কাহিনী আমরা প্রায়ই শুনে থাকি কিংবা আঁচ করি। তবে শফিক হাসান এই চির চেনা গল্পটিই উপস্থাপন করেছেন নতুন আঙ্গিকে। কাহিনী গতানুগতিক হলেও উপস্থাপনের গুনে সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে। ‘প্রতিদিন একটি খুন’ একটি প্রতীকী গল্প। সমাজে বিদ্যমান নানা অনাচারের বিরুদ্ধে লেখকের ক্ষোভ এবং দ্রোহ ফুটে উঠেছে এই গল্পে। ইভটিজার, ঋণখেলাপি, প্রতারক প্রেমিক এবং রাজাকার এই চার জনকে খুনের গল্প সাজিয়ে লেখক সমাজের আরও অনাচারের বিরুদ্ধে তারুণ্যের দ্রোহকে জাগ্রত করেছেন। এখানে পাঠককে একটি ম্যাসেজ দেয়ার জন্য ‘খুন’ বিষয়টি রূপকার্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।
‘কুহক’ এবং ‘বুনোফুলের ঘ্রাণ’ গল্প দু’টোতে রহস্যের অবতারণা করা হয়েছে। শেষ দিকে এসে দু’টি গল্পকে পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত মনে হয়েছে। যেন একটি উপন্যাসের দুই অধ্যায়। এই প্রবণতা কি লেখকের সচেতন নিরীক্ষা তা না জেনেই বলা যায়, ‘বুনোফুলের ঘ্রাণ’ পড়া শেষ হলে আবারো ‘কুহক’ এ চোখ বুলানোর আগ্রহ জন্মাবে। ‘লিঙ্গান্তর’ গল্পে আছে পরাবাস্তবতার ছোঁয়া। ‘ফেইসবুক জেনারেশনের’ পাঠক একটি হাল্কা মেজাজের মজাদার কাহিনী পড়তে গিয়ে হঠাৎই একটি কঠিন প্রস্তাবনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাবেন – ‘নারী থেকে পুরুষ, পুরুষ থেকে নারী হওয়া বোধহয় অতটা খারাপ না’।
শেষ গল্প ‘কবির সংসার’ একজন অস্বীকৃত কবির সংসার জীবনের নিত্যদিনের টানাপোড়েনের গল্প। যদিও ‘কবির সংসার’ আমাদের চেনা গল্পেরই নতুন চিত্রকল্প, তবুও গল্প বলার ঢংয়ে হয়ে উঠেছে সুপাঠ্য। পড়তে পড়তে পাঠক নিজেকে আবিষ্কার করবেন গল্পের ভেতর। শেষ দিকে বেরিয়ে যাবে একটি দীর্ঘশ্বাস। এই গল্প কয়েকটি উপশিরোনামে বিভক্ত করা হয়েছে। এই বিন্যাসে পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে গল্পটিতে একটি উপন্যাসের ভ্রূণ রয়েছে।
শফিক হাসানের রচনা শৈলী পরিশীলিত। কোথাও কোথাও তিনি এলাকা বিশেষের কথ্য ভাষাও ব্যবহার করেছেন। ‘ইহজিন্দেগী’, ‘সালামালকি’, ‘ঠাটবাট’ – এ সব শব্দের ব্যবহারে পাঠক সহজেই গল্পের সাথে একাত্ম হতে পারেন। ইংরেজি শব্দকে বাংলা হরফে লিখতে গিয়ে কোথাও কোথাও আরেকটু সাবধানতার দাবি রাখে। ‘শার্টটা নাকি আমাকে শুট করেছে’ – এখানে ‘সুট করেছে’ হলে উচ্চারণ যথার্থ হতো বলে মনে হয়েছে।
রাজিব রায়ের আঁকা প্রচ্ছদ দৃষ্টিনন্দন। অঙ্গসজ্জা মানসম্মত। তবে ‘সমীকরণহীন’ গল্পটির শিরোনাম শেষদিকে এসে ‘শয়তানের হাসি’ হয়ে গেলে কেন তা বোঝা গেল না। হয়তোবা মুদ্রণ প্রমাদ!
‘প্রতিদিন একটি খুন’ এর তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেছে অনুপ্রাণন প্রকাশন। মূল্য ১৯০ টাকা। বইমেলায় অনুপ্রাণনের স্টলে (স্টল নম্বর ৫৬৫, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাওয়া যাবে। কাঁটাবনস্থ কনকর্ড এম্পোরিয়াম শপিং কমপ্লেক্সে প্রকাশকের বিপণন কেন্দ্র থেকেও সংগ্রহ করা যাবে। গ্রন্থটির বহুল প্রচার ও বহুল পাঠ কামনা করি।