ইংরেজিতে যাকে বলে জু, জুলজিক্যাল পার্ক। কিন্তু এই ব্যাপারটা কী এতই স্বাভাবিক ও প্রাণীসংরক্ষণের নিয়ম মেনে হত?? না জানলে অবাক হতে হয় প্রাণী নয় মানুষও এর শিকার ছিল। এইকথায় পরে আসছি।দেড়শ থেকে আড়াই’শ খ্রিঃপূ তেই আগমন হয়েছিল এই চিড়িয়াখানা ভাবনার। একটি জাতির সম্মান, গর্ব তাদের শক্তি তারা প্রদর্শন করত তাদের উন্নত পশুশালার মাধ্যমে। সেই পশুশালায় আস্তে আস্তে চিড়িয়াখানার রূপ নেয়।রাজা রাজরারা সখে যে পশুপাখি পুষতেন সে আমরা জানি কিন্তু খাঁচায় রেখে প্রদর্শন করার বিষয়টা একটু আলাদা ছিল। চীন, মেসোপটেমিয়া, মিশর এই বিষয়ে এগিয়ে ছিল।মিশরের রানি হাশেপসাটের কথাই উল্লেখিত ভাবে পাওয়া যায়। তিনি আফ্রিকা থেকে প্রাণীদের নিয়ে এসে তার নির্মিত চিড়িয়াখানায় রাখতেন। এই প্রথম চিড়িয়াখানায় মানুষ বাইরে থেকে প্রাণীদের দেখতে পারল। ২৪০০ খ্রিঃপূ দক্ষিণ-পূর্ব ইরাকে সম্ভবত প্রথম চিড়িয়াখানা তৈরি হয় কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য দ্রষ্টব্য ছিল না ।
এখানকার চিড়িয়াখানায় প্রাণীরা হল লেপার্ড, বানর, বাঘ, পাখি। পরবর্তীতে টলেমিও আলেকজান্দ্রিয়াতে চিড়িয়াখানা বানিয়েছিলেন। শোনা যায় । মেসোপটেমিয়াতেও রাজাদের সব আলাদা চিড়িয়াখানা ছিল এর মাধ্যমেই তারা তাদের ক্ষমতাও প্রদর্শন করত। ব্যাবিলনের রাজা নেবুচাডরজার বুনো প্রাণীর বন্দীশালা বানিয়েছিলেন। কলকাতায় ১৮০১ পরবর্তী চিড়িয়াখানা তৈরী হয়। প্রথম চোরাবাগানেই এই চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। বাংলাদেশে প্রথম রমনা পার্কে প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র তৈরী করা হয়। এর কিছুদিন পর সুষ্ঠভাবে মিরপুরে চিড়িয়াখানার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটি বর্তমান বাংলাদেশের জাতীয় চিড়িয়াখানা।খ্রিঃপূ ১৫০০ তে চীনে শ্যাং রাজবংশের সময় চিড়িয়াখানার প্রসার দেখা যায়।১৮২৬ সালে লন্ডনের রিজেন্ট পার্কে লন্ডন জু খোলা হয়।
বিংশ শতাব্দীতে এর নাম হয় গুছিয়ে “ বায়োপার্ক”। সব থেকে পুরোনো চিড়িয়াখানার অস্তিত্ব রয়েছে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে। ১৭৫২-তে রোমান সম্রাট প্রথম ফ্রান্সিসের আমলে এটি পশুশালা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। উনিশ শতকের আগে অবধি চিড়িয়াখানা তৈরীর পেছনে কোনো বিজ্ঞান সম্মত ভাবনা ছিল না রাষ্ট্রীয় শক্তির প্রদর্শন ছাড়া।আধুনিক উন্নত চিড়িয়াখানার যেমন বহু উন্নতি হয়েছে ভাগ হয়েছে যেমন সাফারি পার্ক, অ্যাকোয়ারিয়া, রোডসাইড জু, পেটিং জু,অ্যানিম্যাল থিম পার্ক ইত্যাদি।
তো এই হল মুখ্যত প্রাথমিক চিড়িয়াখানার আগমন ইতিহাস তাও এই পদ্ধতি পশুপাখির পক্ষে ঠিক কিনা তা নিয়ে বহু বিতর্ক আছে; কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে যে মানুশ এই চিড়িয়াখানার প্রতিষ্ঠা করেছে তারা নিজেদেরও স্বজাতিকেও চিড়িয়াখানায় বন্দী রাখত কেবল নিজেদের আমোদ-প্রমোদের জন্য এর মধ্যে সংমিশ্রিত হয়েছিল বর্ণবাদও; যা মানবসভ্যতার অভিশপ্ত ইতিহাস। ম্যাক্সিকোর মোক্তজুমায় মানব শরীরকে বন্দী করে তাদের পশুর মতো প্রদর্শন করানো হত।ইটালীর মেডিসি পরিবারের নিজস্ব মানব সংগ্রহশালা ছিল। এমনকি মানুষের সামনে মানুষের মৃত্যু অবধি বন্দী অবস্থায় প্রদর্সিত হত। প্যারিস, লন্ডন, নিউইয়র্ক এই সমস্ত উন্নত শহরের ব্যবসায়ীরা প্রাণীর সঙ্গে মানুষের রপ্তানি করে তাদের বন্দী অবস্থায় প্রদর্শন করতেন।
কালো চামড়ার মেয়েরা কিম্বা গ্রাম্য আদিবাসীদের দিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় রেখে পশুর মতো আচরণ করতে বলা হত। কখনো কখনো জলচর প্রাণীদের সঙ্গে জলভর্তি খাঁচাও তাদের রেখে দেওয়া হত। আমেরিকা ফিলিপাইওনদের যুদ্ধে হারিয়ে ক্রীতদাস বানিয়ে জংলি জীবের মতো এদের প্রদর্শন করাতো। ওটাবেংগা, আন্দামানের আদিবাসী, নুবিয়ান এরকম মানুষদের তো বটেই এমনকি, ভারতীয়, তুর্কী, আফ্রিকানদের বন্দী করেও মানবচিড়িয়াখানার মজা নিত মানুষ।
তাই মানুষ আজ যতই মজা করুক, চিড়িয়াখানার গা জুড়ে বসে পিকনিক করুক, এর আগমনীটা এত সুখের ছিল না। আমোদে-প্রমোদে-অত্যাচারের ইতিহাসে এর আগমন তবে বিজ্ঞানমনস্ক ভাবনার সম্প্রসার হওয়ায় চিড়িয়াখানার ভাবনা উন্নত হয়েছে এবং বাস্তবিক তা মানুষের কল্যাণেও এগিয়েছে।