‘Nobody deserves your tears, but whoever deserves them will not make you cry’
'কেউ তোমার কান্না দেখতে চায় না, যে দেখার যোগ্য, সে তোমাকে কাঁদতেই দেবে না।' কথাগুলো অনেক আগে পড়েছিলাম। এখনো মনে আছে। বলেছিলেন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, ভুলতে না-পারা এক সাহিত্যব্যক্তিত্ব তিনি।
আজ তার জন্মদিন। লাতিন আমেরিকার কলম্বিয়ার আরাকাতকা মাগদালেনায় ৬ মার্চ ১৯২৭ সালে জন্মে ছিলেন তিনি। আর মারা যান ২০১৪ সালের ১৭ এপ্রিল।
সত্যিই, মার্কেসকে ভুলে গিয়ে আধুনিক সাহিত্যের কথা মোটেও ভাবা যায় না। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত ও সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন স্প্যানিশ ভাষী এই লেখক। কলাম্বিয়ার সন্তান হয়েও জীবনের বেশির ভাগ সময় তিনি বসবাস করেছেন মেক্সিকো এবং ইউরোপের বিভিন্ন শহরে। জীবনের শেষ দুই যুগ ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে ছিলেন ‘জাদুবাস্তবতা’ ঘরানার অন্যতম রূপকার এই শ্রেষ্ঠ লেখক।
হোর্হে লুইস বোর্হেস এবং হুলিও কোর্তাসার এবং মার্কেসকে বলা হয় বিংশ শতাব্দীর সময়কালে দক্ষিণ আমেরিকার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য প্রতিভা। বিশেষত মার্কেসকে জনপ্রিয়তা ও দক্ষতার জন্য তুলনা করা হয় চার্লস ডিকেন্স, লেভ তলস্তয় এবং আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সঙ্গে। তার প্রতিটি গ্রন্থের প্রকাশনা বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মধ্যে স্থান পেয়েছিল।
পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন সাংবাদিক এবং কিউবান নেতা ফিদেল কাস্ট্রোর ব্যক্তিগত বন্ধু। সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতায় তিনি ছিলেন অকপট। আর ছিলেন বাস্তব আর কল্পনার মিশেলে কাহিনি বা আখ্যান নির্মাণে ওস্তাদ। বিভিন্ন সরকারি ভাষ্য, ঘটনা ও বিবরণকে তিনি এমনভাবে বিবৃত করেন, যা ক্ষমতাসীনদের চক্ষুশূল হয়। ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত কলাম্বিয়ার নৌ-দুর্ঘটনা নিয়ে তার উপন্যাস ‘দ্য স্টোরি অব অ্যা শিফরেকড সেইলর’-এ তিনি একটি বাস্তব ঘটনার প্রচলিত বিবরণকে চ্যালেঞ্জ করে ভিন্নমত উপস্থাপন করেন। পরিণামে দেশ ছাড়তে হয় তাকে।
মার্কেসের সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস হলো ‘শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা’। আশির দশকের বাংলাদেশে 'সাপ্তাহিক রোববার' ম্যাগাজিনে আবদুন নূরের অনুবাদে ধারাবাহিক ছাপা হয়েছিল উপন্যাসটি। সারা বিশ্বে ২৫টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে বইটি। ১৯৬৭ সালে প্রকাশের পর থেকে মার্কেসের মৃত্যুর বছর (২০১৪) পর্যন্ত ৪৫ বছরে বইটির ৫ কোটি কপি বিক্রি হয় বলে প্রকাশক জানিয়েছিল। ১৯৮২ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
মার্কেস ছিলেন বিচিত্র মানুষ। তার প্রিয় রঙ হলুদ। প্রিয় চরিত্র কাউন্ট ড্রাকুলা। প্রিয় ঐতিহাসিক চরিত্র রোমান বীর জুলিয়াস সিজার। সবচেয়ে বেশি অপছন্দত করতেন আমেরিকা দখলকারী স্পেনিশ নাবিক কলম্বাসকে।
তিনি বিয়ে করেছিলেন মিশরীয় বংশজাত সুন্দরী মের্সেদেস বার্চা নামক এক রমণীকে। দীর্ঘ জীবন তাদের মধ্যে প্রেম, প্রণয় ও বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল।
মৃত্যুকালে মার্কেস অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি রেখে যান, যা ছিল তার আত্মজীবনীর অংশ। তিনি মারা যান মেক্সিকোতে। হাজার হাজার ভক্ত ছাড়াও একাধিক দক্ষিণ আমেরিকান রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান তার শেষকৃত্যে অংশ নেন।
মার্কেসের বিভিন্ন গল্প ও উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হয়ে ব্যাপক সাফল্য পায়। সবচেয়ে বড় যে অবদান তিনি রেখে গেছেন, তা হলো ‘প্রভাব’। বিশ্ব সাহিত্যে একটি প্রভাব-বলয় তিনি তৈরি করেছেন। বাস্তব ও কল্পনার মিশেলে ঘটনার বর্ণনা ও বিশ্লেষণের যে শৈলী, যাকে জাদুবাস্তবতা বলা হয়, তা অসংখ্য পাঠকের প্রিয়তা ও বহু লেখকের অনুপ্রেরণার বিষয় বলে বিবেচিত হচ্ছে।
মার্কেস তার লেখায় বলেছেন এমন কথা, যা বলা হয় নি, কিন্তু বলা যেতো। তিনি বর্ণনা করেছেন এমন ঘটনা, যা ঘটে নি, কিন্তু ঘটতে পরতো। চলমান বাস্তবে যা ঘটেছে এবং কল্পনার অতল জগতে যা ঘটতে পারতো, জাদুবাস্তবতার পরশে সাহিত্যের ভাণ্ডারে তারই সেতুবন্ধ রচনা করেছেন মার্কেস ।