শুধু ইংরেজি সাহিত্য নয়, তাবৎ বিশ্বসাহিত্যে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ লেখকের মর্যাদা উইলিয়াম শেক্সপিয়ার ছাড়া আর কাউকে দেওয়া সম্ভব হয় না। রেকর্ডবুক বলছে, তিনি অল-টাইম বেস্ট সেলার। তার লেখা পড়েছেন চার বিলিয়ন মানুষ। বিশ্বের প্রতিটি জীবিত ভাষায় অনুদিত হয়েছেন তিনি। ইংল্যান্ডের জাতীয় কবি শেক্সপিয়ারের সঙ্গে মিশে আছে বিশ্ব বই ও কপিরাইট দিবস।
গ্রামীণ ইংল্যান্ডের অ্যাভনের কবি বলা হয় শেক্সপিয়ারকে। আর গ্রীষ্মের এপ্রিল মাসটি যেন পুরোটাই তাঁর। ২৬ এপ্রিল (১৫৬৪ সাল) তাঁর জন্মদিন আর ২৩ এপ্রিল (১৬১৬) মৃত্যুদিন। মাত্র ৫২ বছরের জীবনের সংক্ষিপ্ত পরিধি পেরিয়ে তিনি হয়ে আছেন বিশ্বসাহিত্যের অপরাজেয় সম্রাট।
শেক্সপিয়ারের নাম শুনলেই এক ধূসর যুগের কথা ভেসে ওঠে মনে। সেই রানি এলিজাবেথের রাজত্ব, বিশ্বব্যাপী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন, শেষ-মধ্যযুগের ইউরোপ, গ্লোব থিয়েটার, আর সেই স্ট্র্যাটফোর্ড গ্রাম। শেক্সপিয়ারের মতো অন্য কেউই পরিণত হতে পারেননি ইংরেজ জাতির আইকনে।
শেক্সপিয়ারের যুগ পেরিয়ে পথ চলতে চলতে প্রায় অর্ধ-সহস্র বছরেরও বেশি সময়কাল অতিক্রান্ত হয়েছে। তার রচনার প্রেক্ষাপট, আখ্যান, পাত্র-পাত্রীরা হারিয়ে গেছে অতীত ইতিহাসের অতল গর্ভে। তথাপি ৪৫৬তম জন্মদিনেও মনে হয় তিনি বড়ই জীবন্ত ও খুবই প্রাসঙ্গিক।
২৩ এপ্রিল তারিখে সারা পৃথিবী তার জন্মদিনে মেতে উঠে। কালজয়ী কবি ও নাট্যকারকে স্মরণ করে অবিস্মরণীয় রচনাসমূহের মাধ্যমে। ফিরে যায় ওথেলো, ম্যাকবেথ, কিং লিয়ার, জুলিয়াস সিজার, মার্ক এন্টনি, রোমিও-জুলিয়েট কিংবা ভেনিসের চরম নিষ্ঠুর ইহুদি সুদখোর শাইলকের আমলে।
'দ্য ফিনিক্স অ্যান্ড দ্য টার্টল'-এর কবি পরিণত হন বিশ্ববাসীর নিজস্ব সাংস্কৃতিক সম্পদে। বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত অক্সফোর্ড বুকস্টোরের চা বারের ঘেরাটোপ ডিঙিয়ে সেক্সপিয়ার হয়ে যান বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ বা ওয়ার্ল্ড ইনটেলেকচুয়াল প্রোপার্টি।
জন্মের এতো শতাব্দী পরেও চলছে শেক্সপিয়ারের কৃতিত্ব ও অবদান নিয়ে গবেষণা। ব্রিটিশ কাউন্সিলের উদ্যোগে ইংরেজি প্রবাদ-প্রবচন-বাগধারায় শেক্সপিয়ারের অবদান নিয়ে কাজ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। গবেষণার হাত ধরে জানা যাচ্ছে অনেক তথ্য। ‘Bedroom’, ‘lonely’, ‘excitement’, ‘addiction’, ‘eyeball’-এর মতো অসংখ্য শব্দ যেমন আমরা শেক্সপিয়ারের কাছ থেকে উপহার পেয়েছি, তেমনই “wild goose chase”, “green eyed monster”, “seen better days”, “apple of my eye”-এর মতো বাগধারা কিংবা “Better a witty fool than a foolish wit”, “What is past is prologue”, A fool thinks himself to be wise, but “a wise man knows himself to be a fool” -এর মতো প্রবাদও আমরা পেয়েছি শেক্সপিয়ারের হাত ধরেই।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের জন্মদিন উপলক্ষ্যে ইংল্যান্ড ও বিশ্বের নানা দেশে আয়োজিত হয় ‘দ্য শেক্সপিয়ার ফিস্ট’। ডাইনিং টেবিলে উঠে আসে এমন সব পদ, যেগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে শেক্সপিয়ারের সৃষ্টি করা বিখ্যাত সব চরিত্রগুলোর থেকে। যেমন: ব্যাংকো’জ ব্যাংকোয়েট, ওফেলিয়া’জ ইংলিশ গার্ডেন স্যালাড, হ্যামলেট’স ম্যাডনেস চকো মাফিনস, পোর্শিয়া'জ পেস্ট্রি এবং আরও অনেক সুস্বাদু সব খাবার। এই মহৎ সাহিত্যিককে স্মরণ করে ভুরিভোজের সঙ্গে সঙ্গে চলে মননচর্চা।
আশ্চর্যের বিষয় হলো- বিশ্ববরেণ্য উইলিয়াম শেকসপিয়ারের জন্মদিন এতো আয়োজন করা হলেও তার জন্মের সঠিক তারিখ ও জীবনীর অনেকটাই অস্পষ্ট। তবে ২৩ এপ্রিল অর্থাৎ, সেন্ট জর্জ’স ডে-এর দিনে তার জন্মদিন পালন করার প্রথা রয়েছে।
তার পিতা জন শেক্সপিয়ার ছিলেন একজন সফল গ্লোভার ও অল্ড্যারম্যান। মা মেরি আরডেন। শেক্সপিয়ার মাত্র ১৮ বছর বয়সে অ্যানি হ্যাথাওয়েকে বিবাহ করেন। অ্যানির গর্ভে শেক্সপিয়ারের তিনটি সন্তান হয়েছিল।
১৫৮৫ থেকে ১৫৯২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি অভিনেতা ও নাট্যকার হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন। লর্ড চেম্বারলেইন’স ম্যান নামে একটি নাট্যকোম্পানির তিনি ছিলেন সহ-সত্ত্বাধিকারী। এই কোম্পানিটিই পরবর্তীকালে কিং’স মেন নামে পরিচিত হয়।
কিন্তু ১৬১৩ সালে তিনি হঠাৎ নাট্যজগৎ থেকে সরে আসেন এবং লন্ডন থেকে স্ট্র্যাটফোর্ডে ফিরে যান। তিন বছর বাদে সেখানেই তার মৃত্যু হয়।
শেক্সপিয়ারের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে নথিভুক্ত তথ্য বিশেষ পাওয়া যায় না। তার চেহারা, যৌনপ্রবৃত্তি, ধর্মবিশ্বাস, এমনকি তার নামে প্রচলিত নাটকগুলো তারই লেখা নাকি অন্যের রচনা তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে।
শেক্সপিয়ারের পরিচিত রচনাগুলোর অধিকাংশই মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৫৮৯ থেকে ১৬১৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। তাঁর প্রথম দিকের রচনাগুলো ছিল মূলত মিলনান্তক ও ঐতিহাসিক নাটক। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে তার দক্ষতায় নাট্যসাহিত্যের এই দু’টি ধারা শিল্পসৌকর্য ও আভিজাত্যের মধ্যগগণে উঠেছিল।
১৬০৮ সাল পর্যন্ত তিনি প্রধানত কয়েকটি বিয়োগানৃত নাটক রচনা করেন। জীবনের শেষ পর্বে তিনি ট্র্যাজিকমেডি রচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এই রচনাগুলো রোম্যান্স নামেও পরিচিত। ঐতিহাসিক ঘটনা ও চরিত্র নিয়েও তিনি অসাধারণ নাটক উপহার দিয়েছেন।
১৬২৩ সালে প্রকাশিত শেক্সপিয়ার রচিত নাট্যসাহিত্যের সমগ্র বা ফোলিও প্রকাশিত হলে তাঁর ৩৬টি নাটক কমেডি, হিস্ট্রিক্যাল ও ট্র্যাজেডি শ্রেণিতে স্থান পায়। তবে পরবর্তী কালের গবেষকগণ তার কয়েকটি নাটককে রোমান্টিক শ্রেণিভুক্ত করেন। তাঁর হেমলেট, ওথেলো, কিং লিয়ার, ম্যাকবেথ, মার্চেন্ট অব ভেনিস, দ্য টেমপেস্ট, জুলিয়াস সিজার, এন্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা, মেজার ফর মেজার ইত্যাদি ইংরেজি ভাষার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তির পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।
সমকালে শেক্সপিয়ার ছিলেন একজন সম্মানিত কবি ও নাট্যকার। রোম্যান্টিকেরা তার রচনার চরম গুণগ্রাহী। ভিক্টোরিয়ানরা রীতিমতো তাকে পূজা করতেন, যা ছিল চারণপূজা (bardolatry)।
আজও তার নাটক অত্যন্ত জনপ্রিয় ও বহুচর্চিত। সারা বিশ্বের নানা স্থানের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নানা আঙ্গিকে তার নাটকগুলো মঞ্চস্থ ও সাহিত্যের ক্লাসে ব্যাখ্যাত হয়ে থাকে।