বাংলাদেশের অনলাইন সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ও অসংখ্য তরুণ সাংবাদিকের জনক হিসেবে খ্যাত আলমগীর হোসেন জানেন, কাকে দিয়ে কোনো বিষয়ে ভালো লেখা পাওয়া যাবে। লেখক সৃষ্টির অলৌকিক কৌশল ও সূত্রটি করতলগত বলেই শুধু সার্বক্ষণিক সাংবাদিকদের নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, তরুণ কবি, বিদেশে অধ্যয়নরত গবেষক এবং এমনকি আপাত ভবঘুরের সুপ্ত সম্ভাবনাকেও বের করে আনেন একালের অনলাইন-মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিকতার কিংবদন্তিতুল্য-ব্যক্তিত্ব আলমগীর হোসেন, যার ফলিত প্রমাণ পাওয়া গেছে জাকারিয়া মন্ডলের বহুমাত্রিক ভ্রমণ বৃত্তান্তে।
ঝরঝরে ভাষা, নিখুঁত বর্ণনা, সরেজমিন পর্যবেক্ষণ এবং ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও পৌরাণিক তথ্যসম্ভারের আলোকে রচিত ভ্রমণালেখ্যগুলো নিয়ে জাকারিয়া মন্ডল তার প্রথম গ্রন্থ ‘পাহাড়ের ভাঁজে মহাকাব্য’ প্রকাশ করেছেন চলতি বছরের বইমেলায়। এর কিছুদিন পর প্রকাশ করেন আরেক ভ্রমণ গ্রন্থ ‘বাড়ির পাশে তীর্থ’, যাতে উন্মোচিত হয়েছে চারপাশের জানা ভূগোলের অজানা ইতিবৃত্ত।
জাকারিয়া মন্ডলের বই দু’টিতে স্থান পেয়েছে দেশ-বিদেশের মোট ১৯টি ভ্রমণ আখ্যান, যা কেবল মাত্র স্থান-দর্শন নয়, ব্যাপকার্থে প্রত্নতত্ত্ব ও ঐতিহাসিক পর্যটন। তার গভীর ও বীক্ষণসমৃদ্ধ ভ্রমণকথাগুলো ঋদ্ধ হয়েছে ইতিহাসের তথ্যনিষ্ঠ মেলবন্ধনে।
বাংলা সাহিত্যের গতানুগতিক ভ্রমণ রচনার ধারায় জাকারিয়ার পরিশ্রমী ও গবেষণামনস্ক লেখাগুলো অনন্য ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এইজন্য যে তার সরেজমিন অভিজ্ঞতার সঙ্গে সভ্যতা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভূগোল, কিংবদন্তি, পুরাতত্ত্ব ও মহাকাব্যের বিশ্লেষণ যুক্ত হয়ে নির্মাণ করেছে ভ্রমণের বহুমাত্রিক, স্বাদু ও সুগভীর ন্যারেশান। অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞান ও তত্ত্বগত উপাদানের জারিত রসায়নে তিনি যে টেক্স তৈরি করেছেন, তা পরিণত হয়েছে ‘ট্র্যাভেল থ্রু হিস্টি’ নামক এক ‘মাল্টিডাইমেনশনাল পার্সপেক্টিভ’-এ।
আমরা ক’জন জানি, মুসলিম দেশ মালয়েশিয়ায় রয়েছে ভারতীয় পৌরাণিক-মহাকাব্য রামায়ণের কাহিনী চিত্রিত এক প্রাচীন পর্বতগাত্র! রাজধানী কুয়ালালামপুরের উত্তরে গমবাক জেলায় অবস্থিত বাতু কেভ বা গুহায় সেই কাব্যিক বিবরণের বর্তমান বিন্যাস ও কাঠামো লেখায় আর ছবিতে অপরূপ ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন জাকারিয়া। বাতু কেভের অতিকায় মুরুগান মূর্তি নিয়েও উপস্থাপন করেছেন ঐতিহাসিক তথ্য আর বাস্তব ভ্রমণ অভিজ্ঞতা। অতিনিকটের মালয়েশিয়ার অন্তর্মূলে বিচিত্র সংস্কৃতি ও প্রত্নতত্ত্বের যে অতীত গৌরব আর ঐতিহ্যের বিভা ছড়িয়ে রয়েছে, জাকারিয়ার আগে খুব কম লেখকই তা উন্মোচিত করতে পেরেছেন।
নিকট প্রতিবেশী নেপালের ক্ষেত্রেও জাকারিয়ার সাবলীল কলম ভ্রমণের পায়ে পায়ে ছুটে চলেছে বর্তমান পেরিয়ে অতীতের অন্তর্গত আলোকমালায়। কাঠমান্ডুর প্রধান দ্রষ্টব্য স্বয়ম্ভূকে কেন্দ্র করে তিনি সে দেশ, নগর আর জনজাতির বিশ্বাস, লোককথা স্পর্শ করেছেন। বাঘমতী আর বিষ্ণুমতী নদীতে ঘেরা উপত্যকাময় জনপদ একদা বৌদ্ধ ধর্মের জন্মস্থান হলেও কিছুদিন আগেও ছিল সাংবিধানিকভাবে ঘোষিত বিশ্বের একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র। রথ, ঢোল, ঘণ্টা, বাঁশি, উৎসব মুখরিত নেপালে ফুল, চন্দন, ধূপ, ধুনা, সৌরভের সমান্তরালে ধর্ম ও জনবিশ্বাসে আবর্তিত যে সংস্কৃতি ও জনজীবন প্রবহমান, তার সচল-সজীব প্রতিচিত্রটুকু অনন্য ভাষা ও শৈলীতে তুলে ধরেছেন জাকারিয়া মন্ডল।
একই কৃতিত্বে জাকারিয়া পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার অন্যতম সুমেরীয় সভ্যতার এক অদেখা ঝলক তুলে আনেন মধ্যপ্রাচ্যের বাহরাইন থেকে। বোর্নিও দ্বীপের অবারিত প্রকৃতি আর জিন দেবতা, বাড়ির পাশের ত্রিপুরার অনিন্দ্যসুন্দর লোকালয়, জনজাতির বিচিত্র জীবনাচার, বিশ্বাস ও প্রত্নতত্ত্ব সম্পদের বর্ণিল বিবরণ দিয়েছেন তিনি।
‘পাহাড়ের ভাঁজে মহাকাব্য’ গ্রন্থে জাকারিয়া ত্রিপুরা, নেপাল, মালয়েশিয়া, বোর্নিও ও বাহরাইনের যে প্রাঞ্জল্য, তথ্যপূর্ণ, বহুমাত্রিক ভ্রমণালেখ্য উপস্থাপন করেছেন, তা দেশগুলো সম্পর্কে এক সুগভীর জ্ঞান সঞ্চার করে।
জাকারিয়া মন্ডল ‘বাড়ির পাশে তীর্থ’ গ্রন্থে বাংলাদেশের কয়েকটি অপূর্ব ও সমৃদ্ধ জনপদের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক জীবনকে ভ্রমণের মাধ্যমে তুলে এনেছেন। জাকারিয়ার দেশ ও বিদেশের ভ্রমণ বিষয়ক লেখাগুলো পড়ে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়। তাহলো উত্তর জনপদের নান্দনিক ত্রিভুজ বিরামপুর-দিনাজপুরের জাতক জাকারিয়া মন্ডল ঢাকার নটরডেম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং শান্তি ও সংঘর্ষ নিয়ে উচ্চতর পর্যায়ে অধ্যয়ন করলেও, এটা নিশ্চিত যে তার অন্যতম আগ্রহ ইতিহাস ও সভ্যতা এবং তার অনুসন্ধানের পদ্ধতিগত অ্যাপ্রোচ নৃতত্ত্বীয়। যে কারণে তার ভ্রমণ ও বীক্ষণ ইতিহাসের গভীরতা ছুঁয়ে জনজীবনের সঙ্গে আন্তরিক সংশ্লেষ ও বন্ধনের দীপ্তিতে উজ্জ্বল এক বহুবর্ণা চিত্র উদ্ভাসিত করে।
বিশেষত ‘বাড়ির পাশে তীর্থ’ গ্রন্থে পাহাড়ে, হাওরে, প্রত্যন্ত জনপদের সুগভীর ভাঁজে ভাঁজে লুক্কায়িত প্রকৃতি, লোকাচার ও বিশ্বাসের সন্ধান করা হয়েছে ভ্রমণ পথের রেখায় । সনাতন ধর্ম ও চিরায়ত সংস্কৃতির বিবর্তন ও বর্তমান বিশ্বাসের জায়গাটুকু আর আচারিক অনুষঙ্গগুলো একজন গবেষকের নিবিষ্টতায় জাকারিয়া তুলে এনেছেন। তার দেখা ও লেখায় পার্বত্য চন্দ্রনাথ মন্দির, পাহাড়ি দ্বীপের বা জলজ ভূগোলের বিভিন্ন দেব, দেবি, আখড়ায় লোকচক্ষুর অন্তরালে যে জীবন ও যাপন প্রবহমান, তা বর্ণপ্রভায় প্রস্ফুটিত হয়েছে।
ইতিহাস, লোককথা, সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্বের গভীর জ্ঞান ও পরিশ্রমী সরেজমিন ভ্রমণের যে সুসমন্বিত ও মিলিত রূপ জাকারিয়া মন্ডল উপস্থাপন করেছেন, তাকে মূলগত অর্থে ভ্রমণ আখ্যান বললেও এতে রয়েছে নান্দনিক বহুমাত্রিকতা, ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ, সাংস্কৃতিক সমীক্ষণ, পৌরাণিকত্বের তুলনামূলক পর্যালোচনা।
ভ্রমণ যে শুধু ‘দেখে এসে লিখে ফেলা নয়’ গভীর অনুধ্যান ও গবেষণার বিষয়, জাকারিয়া তা সপ্রমাণিত করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি ও অসংখ্য রঙিন ছবির সমাবেশে তিনি ভ্রমণের যে ঐতিহাসিক ও ভিজ্যুয়াল মাত্রাগুলো রয়েছে, তাও সংযোজিত করেছেন প্রতিটি লেখার শরীর ও কাঠামোতে।
মোদ্দা কথায়, ভ্রমণ সাহিত্য, ইতিহাস অন্বেষা ও লোকজীবন আর সংস্কৃতির নৃতাত্ত্বিক অন্বেষার মিলিতশৈলীতে একটি নবতর রচনাধারা সৃষ্টির প্রচেষ্টা জাকারিয়া মন্ডলের বইগুলোতে প্রতীয়মান। তদুপরি, বাংলাদেশের ভ্রমণ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ঐতিহাসিক গবেষণা এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় জাকারিয়া মন্ডল নিজের অগ্রসর ও আলাদা লেখকসত্ত্বাকেও প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন।